মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে সমাহিত করা হয়েছে রাজধানী কায়রোতে। ১৭ জুন ২০১৯ মুরসি আদালতের কাঠগড়ায় মারা গেছেন। তার মৃত্যু সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষদের স্তম্ভিত করে দিয়েছে। যারা তার আদর্শ ধারণ করে না তাদেরকেও। উসকে দিয়েছে বিতর্ক। কারণ নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে ছিলেন তিনি।
Advertisement
বন্দী অবস্থায় মৃত্যুর কারণ উদঘাটনে স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান মুরসির মৃত্যুর জন্য মিশরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আস-সিসি ও ইউরোপীয় দেশগুলোর সমালোচনা করেছেন। তিনি মুরসিকে শহীদ আখ্যা দিয়েছেন বলেছেন, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মিশরীয়দের মুক্তির জন্য কাজ করেছেন।
আরব বসন্তের পর মিশরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন মুরসি। হোসনি মোবারকের ৩০ বছরের শাসনের অবসান হয়েছিল আরব বসন্তের কারণে। শুধু হোসনি মোবারক নন, লিবিয়ার গাদ্দাফি, তিউনিশিয়ার বেন আলী সবারই পতন হয়েছিল আরব বসন্তের কারণে। ২০১১ সালের আরব বসন্তের সময় শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ এখনো চলছে সিরিয়ায়।
২০১২ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন মুরসি কিন্তু যেহেতু ডক্টর মুরসি ছিলেন ইসলামিক ব্রাদারহুড তাই তাকে ইসরায়েল মেনে নেয়নি। ইসরায়েল আর আমেরিকার ষড়যন্ত্র এবং গণ আন্দোলনের মুখে সামরিক বাহিনী তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল সিসির রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে।
Advertisement
ইসরায়েল কখনো চায় না যে মিশরে এমন একটি শক্তি ক্ষমতায় থাকুক যার কারণে ইসরায়লের নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে। ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির পর মিশর, আমেরিকা আর ইসরায়েলের মধ্যে এমন একটা বোঝাপড়া হয়েছিল। তখন মিশর আর ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর বেতন আমেরিকা দিত। সুতরাং এমন একটি সম্পর্কের মধ্যে মুরসির প্রেসিডেন্ট হওয়া তো বিষফোঁড়ার মতো কারণ তিনি হচ্ছেন ইখওয়ানুল মুসলিমিন বা ব্রাদারহুড নেতা। পার্লামেন্টেও তাদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল আর শক্তি নিরঙ্কুশ পর্যায়ে নেওয়ার জন্য তারা পার্লামেন্টে অপর ইসলামিক দলের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তুলেছিলো।
ডক্টর মুরসি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত লোক। তিনি তার ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছিলেন আমেরিকা থেকে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি আমেরিকা সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। মিশর আর ইসরায়েল রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে এসেছিলেন।
ওবামা তার কথায় সন্তুষ্ট হলেও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর চাপে পড়ে মুরসির উৎখাত ষড়যন্ত্রে সাহায্য করেছিলেন। আমেরিকায় ইহুদি লবি এত শক্তিশালী যে ওবাবার অনুপস্থিতিতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু প্রতিনিধি পরিষদ এবং সিনেটের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছিলেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্টকেও অসহায় করে ফেলার ক্ষমতা রাখে ইহুদি লবি। এখনকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পতো সম্পূর্ণ ইহুদীরা ক্রীড়নক।
আরব বসন্তের অনুঘটক ছিলেন ওবামার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। বেন আলী, মুয়াম্মার গাদ্দাফি, বাশার আল আসাদ, হোসনি মোবারকের মত জগদ্দল পাথর হয়ে জাতির ঘাড়ে চেপে বসা শাসকগোষ্ঠীকে ক্ষমতা থেকে সরানো ছিল আমেরিকার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু শূন্যস্থান পূরণের সময় তারা হতভম্ব হয়ে যায় কারণ দেখে যে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে ইসলামিক শক্তি ক্ষমতাসীন হচ্ছে। তারা খেয়াল করেনি যে স্বৈরশাসকগুলোর অধীনে কোনও রাজনৈতিক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। ইসলামিক আন্দোলনের শক্তিগুলোই স্বৈরশাসকদের সময়ে কর্মতৎপর ছিল এবং প্রয়োজনে সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তারা তাদের শক্তি সুসংগঠিত করে রেখেছিল।
Advertisement
মিশরের ইসলামিক ব্রাদারহুড একটি প্রাচীন সংগঠন। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা হাসান আল বান্নার প্রচেষ্টায় মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় সব দেশেই এই সংগঠনটি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা সামাজিক কর্মকাণ্ডে যেমন স্কুল-কলেজ গড়া, হাসপাতাল করা, কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করা- ইত্যাদি সমাজসেবামূলক কাজের মধ্য দিয়ে মানুষের উপকারে কাজ করেছে আবার তাদের রাজনৈতিক দর্শনও প্রচার করেছেন।
হাসান আল বান্না বলতেন, ‘সোভিয়েতরা কমিউনিজম বেছে নিয়েছে, পাশ্চাত্য বেছে নিয়েছে গণতন্ত্র আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলো ইচ্ছে করলে ইসলামকে তাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে বেছে নিতে পারে।’ কিন্তু মুশকিল হল যে আমেরিকা কমিউনিজমকে যেমন প্রতিহত করেছে এবং প্রতিহত করতে গিয়ে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করেছে ঠিক তেমনিভাবে ইসলামিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকেও এখন প্রতিহত করছে। আমেরিকার পররাষ্ট্র এবং স্বরাষ্ট্র দপ্তরের একটা শক্তিশালী থিংক ট্যাংক আছে যাদের কাজই হলো ভবিষ্যতে বিশ্ব ব্যবস্থায় কোন কোন শক্তি আবির্ভাব হবে তা নিয়ে গবেষণা করা এবং এই দুই মন্ত্রণালয়কে সেই বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া।
১৯৯৩ সালে স্যামুয়েল পি. হ্যান্টিংটন নামক এক বুদ্ধিজীবী তার ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশন নামক গবেষণাপত্র পেন্টাগন ও পররাষ্ট্র দপ্তরকে পেশ করেছিলেন। তাতে হ্যান্টিংটন দেখিয়েছেন যে দ্রুত মুসলিম সিভিলাইজেশনের উত্থান এবং চাইনিজ সিভিলাইজেশনের উত্থান হবে। আর পশ্চিমা সভ্যতাকে তা মোকাবেলা করতে হবে।
কাকতালীয়ভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় আমেরিকায় রাষ্ট্রটিকে শক্তিশালী করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে বিধ্বস্ত করে ফেলার পরিকল্পনা নিয়ে হাজার ১৯৪৮ সাল থেকে অগ্রসর হচ্ছে। এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যে কোনও ইসলামিক শক্তির জাগরণ আমেরিকা সহ্য করে না।
ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠাতা হাসান আল বান্নাকে হত্যা করা হয়েছিল গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে। ষাটের দশকের দিকে হত্যা করা হয়েছে সৈয়দ কুতুবকে। আর ২০১২ সালে যখন তারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলো তখন এক বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া হলো না। তাদেরকে ২০১৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। অভিযোগ করা হয়েছে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইসলামপন্থীদের একচ্ছত্র আধিপত্যের পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন মোহাম্মদ মুরসি এবং মনে হচ্ছিলো যেন মুসলিম ব্রাদারহুডই রাষ্ট্র পরিচালনা করছে।
বিরোধী বিক্ষোভকারীদের বেআইনিভাবে আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয় মুরসির নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে। একজন সাংবাদিক ও দুইজন সরকার বিরোধী বিক্ষোভকারীকে হত্যায় প্ররোচনা দেবার অভিযোগ আনা হয় মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থকদের বিরুদ্ধে। গ্রেফতার করা হয় মুরসিকে।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই জেলে তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেয়া হয়েছে। এক মামলায় ফাঁসির হুকুম দেয়া হয়েছিল। শুনানির প্রথম দিনে ডক্টর মুরসি কাঠগড়া থেকে চিৎকার করে বলেছিলেন, তিনি সেনা অভ্যুত্থানের শিকার এবং তার বিচার করার বৈধতা এ আদালতের নেই। পরে হত্যার অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়, কিন্তু বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার ও দমনের অভিযোগে তাকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
পরবর্তীতে মুরসির বিরুদ্ধে আরো অনেক অভিযোগ আনা হয়, এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। যদিও পরে সে রায় বাতিল করা হয়েছিল। যেদিন কাঠগড়ায় মারা যান সেই ১৭ জুন ২০১৯ গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তার বিচার চলছিল। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রায় সবটাই য়ড়যন্ত্রমূলক। তাকে একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে যেসব সুবিধা দেওয়ার তা দেওয়া হয়নি। তার স্বজন এবং ডাক্তারদের নিয়মিত দেখা করতে দেওয়া হয়নি। ফলে ৬৭ বছর বয়সে কাঠগড়াতেই তাকে মৃত্যবরণ করতে হয়েছে।
মিশরের শাসক গোষ্ঠি ভুল করেছে তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে। একটি লোক মারা যেতে পারে, জাতিসমূহের উত্থান পতন হতে পারে কিন্তু একটি আদর্শের মৃত্যু হয় না। মুরসি বরং মরেই বেঁচে থাকবেন তার সমর্থকদের মাঝে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।anisalamgir@gmail.com
এইচআর/জেআইএম