সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৩২১ রানের পাহাড় তখন দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে হাতছোঁয়া দূরত্বে এসে গেছে। ৪১তম ওভারটি শুরু করলেন জেসন হোল্ডার। প্রথম বলটি অফ স্ট্যাম্পের সামান্য বাইরে হাফ ভলি। লিটন দাস ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো একটি কভার ড্রাইভ করলেন- চার। ধারাভাষ্যকার ইয়ান বিশপের কণ্ঠে যে প্রশস্তি ঝরল সেটি একেবারে চিত্রকলা থেকে উঠে আসা, ‘লিটন দাস ইজ ড্রয়িং মোনালিসা...।’
Advertisement
এর আগেই কিন্তু লিটন শ্যানন গ্যাব্রিয়েলের এক ওভারে পর পর তিনটি ছক্কা মেরেছেন। ওটাও কি তবে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির তুলির কোমল ছোঁয়ায় আঁকা রেখাচিত্র? হবে হয়তোবা।
কাঠিন্যের মধ্যেও তো থাকে কোমল পরশ। ভয়ংকর কখনো কখনো চিত্রপটে আঁকা সুন্দর ছবি হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ যেমন বজ্রনির্ঘোষে শোনেন বাঁশির সুর, ‘বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি।’
লিটন কাল তার ব্যাটের কোমল–কঠোর ছোঁয়ায় যদি মোনালিসা এঁকে থাকেন, তাহলে সাকিব আল হাসান এঁকেছেন আরো সুন্দর ছবি। কারণ সাকিবই ছিলেন ২২ গজের মূল চিত্রকর, লিটন তার যোগ্য সহযোগী এবং কোথায় তীব্রতর আঁচড় বুলাতে হবে, কোথায় দিতে হবে কোমল পরশ, এটি সাকিবই ঠিক করেছেন।
Advertisement
বোধ করি, সাকিবের এই লড়াইটা চোখসওয়া হয়ে যাওয়ায় ইয়ান বিশপ তাকে কোনো বর্ণনায় আবদ্ধ করতে চাননি। এই বিশ্বকাপের শুরু থেকেই সাকিবের ব্যাট শিল্পীর তুলি, যোদ্ধার হাতের তলোয়ার, আক্রান্তের ঢাল, কৃষকের হাতের কাস্তে কিংবা শ্রমিকের হাতুড়ি। ক্যারিবীয় ক্রিকেট ভাষ্যকার হয়তো সামনের ছবিটাও দেখে ফেলেছেন। যে ছবিতে সাকিবের পিঠেই সওয়ার হয়ে যতটা যাওয়ার এগিয়ে যাবে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ স্বপ্নের ক্যারাভান।
বিশ্বকাপের বাংলাদেশ–ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচে বিশপ যখন চিত্রকলার প্রসঙ্গ এনেছেন, আমরাই বরং সাকিবের ব্যাটিংয়ের তুলনা টানতে পারি কোনো অমর শিল্পীর শিল্পকর্মের সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় রেনেসাঁ বা ইমপ্রেশনিস্ট যুগের কোনো শিল্পীর দ্বারস্থ না হয়ে এই বাংলারই দুই অমর শিল্পীর কাছে যেতে পারি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজকে চূর্ণ করা সাকিবের অপরাজিত ১২৪ যেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আকাঁ ‘বিদ্রোহী’। সব বাধার নিগড় ভেঙে ছুটে যাওয়ার তীব্রতম আকাঙ্ক্ষা। একেকজন যুগস্রষ্টা খেলোয়াড়ও দর্শকাঙ্খার নিগড়ে বাধা পড়ে যান। জয়ের আনন্দ আপনি সাধারণ জনতা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবেন, যেখানে খেলোয়াড়টি নিতান্তই আপনার ইচ্ছাপূরণের দাস। তাকে সামান্যতম মানবিক ভুল করা চলবে না, একবিন্দু এদিক–ওদিক করা যাবে না। সেটি হলেই আপনার ওপর নেমে আসবে খড়গ। হতে হবে রক্তাক্ত, সমালোচনার তীব্র বিষে নীল। আবার মাঠে আপনার প্রাণ সংহারে সর্বক্ষণ সাজানো থাকবে শত্রুপক্ষের উদ্ধত তলোয়ার।
কখনো ওশান থমাসের ১৪৫ কিমি গতির বুলেট, শেলডন কটরেলের ঘাতক বাউন্সার, আন্দ্রে রাসেলের গতির ঝড়, জেসন হোল্ডারের সুইংয়ের বিষ বা ক্রিস গেইলের স্পিনের ফাঁস। আর তো নেকড়ের মতো ফিল্ডারদের সজাগ প্রহরা আছেই, পায়ের গতি একটু শ্লথ হলে, সামান্য ভুল বোঝাবুঝি হলেই দেখলেন এক ঝটকায় স্ট্যাম্প উপড়ে গেছে। এর মাঝখান দিয়েই সাকিব ১২৪ করলেন ৯৯ বলে।
Advertisement
বলতে গেলে এক ফুঁস মন্তরেই যেন বাংলাদেশকে নিয়ে গেলেন ৩২২ রানের কাঙ্খিত চূড়ায়। এ তো জয়নুলের সেই বিদ্রোহী যে সব বাঁধন ছিড়ে বেরিয়ে যায়, সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মুক্তির হাসি হাসে।
কিংবা বলা যায়, এস এম সুলতানের আঁকা ‘চরদখল’ বা ‘বৃক্ষরোপনের’ বাঙালি চরিত্র। চিরকালের সবল–সতেজ ও শ্রেষ্ঠত্বের ক্যানভাসে আঁকা পশ্চিমা মানব সমাজের পাশে বাঙালি সব সময়ই রুগ্ন, ভুখা, নাঙা; কিন্তু সুলতান বাংলার মানুষকে দেখেছেন অন্যচোখে। বাংলার কৃষক পুরুষ ও রমনীর মাঝে তিনি দেখেছেন অন্যরকম শক্তি। যে শক্তি সঞ্চারিত হয় অদৃশ্য পেশি থেকে, অদৃশ্য মানসিক দ্যোতনা থেকে। আর এটাই তাদের দিয়ে বহুশ্রমে ফসল ফলিয়ে নেয় রুক্ষ মাটিতে। সুজলা–সুফলা হয়ে ওঠে প্রান্তর।
সুলতান তার অন্তর্চোখে বাঙালিকে দেখেছেন শাশ্বত বলশালী। এই ক্রিকেটের পৃথিবীতেও বাংলাদেশ রুগ্ন, হাড় জির-জিরেই বিবেচিত হয়ে এসেছে এতদিন। এই বিশ্বকাপেও দু’একজন বাংলাদেশের কথা বলেছেন বটে, তবে জোরগলায় নয়। বাংলাদেশও ভালো দল, ইদানিং ভালো ক্রিকেট খেলছে। তারাও চমকে দিতে পারে! মানে বাংলাদেশের সামর্থ্য যদি কখনো জয়ে অনূদিত হয়, সেটি হয়ে যায় চমক।
সাকিব সেই রুগ্নতার পোস্টারটিকে এক হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে দিয়ে আশ্চর্য বলশালী ক্রিকেটের ছবি এঁকেছেন। ঠিক সুলতানের মতো। সেই অন্তর্গত শক্তিকে জাগ্রত করে। হাতের পেশিতে গেইল–রাসেলদের মতো আসুরিক শক্তি এখানে লাগে না। লাগে ক্রিকেট বোধ, আর মানসিক শক্তি।
আরেকবার ম্যাচের সেরা হয়ে সাকিব সংবাদ সম্মেলনেই এই মানসিক শক্তির কথা বলেছেন, ‘শারীরিক ফিটনেসের পাশে সবচেয়ে যেটি বেশি করে দরকার সেটি মানসিক দৃঢ়তা। এটাই আপনাকে ভালো কিছু করতে সাহায্য করে। সেই মানসিক প্রস্তুতিই আমি নিয়েছি, যে আমাকে ভালো কিছু করতে হবে, দলের জন্য অবদান রাখতে হবে।’
ক্রমাগত অনুশীলনের মধ্যে থেকে, পর্যাপ্ত ম্যাচ খেলে অনেকেই প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। সাকিব এখানে ব্যতিক্রম। অনেক কঠিন সময়ের আশ্রয় একজন কোচকে ভিনদেশে নিয়ে গিয়ে প্রস্তুতি নিলেন প্রায় অলক্ষ্যে। তবে এটা খুব সরলীকরণ হয়ে যাবে যে, তাতেই এই বিশ্বকাপে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন রবিনহুডের উচ্চতায়।
একটি ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেসে গেছে, বাকি চার ম্যাচে করেছেন ৩৮৪ রান। টানা দুটি অর্ধশতকের সঙ্গে টানা দুটি শতক। গড় ১২৮। ক্রিকেটের অতি পরিচিত বাহুবলীরা সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের আসন থেকে তাকে টেনে নামাতে চেষ্টা করেও পারছেন না। আসলে প্রতিভার সঙ্গে সংকল্প মিশলেই এমনটা হয়। ইংল্যান্ডের মাঠে মাঠে সাকিব যেটি করছেন সেটি তার প্রতিভা ও সামর্থ্যেরই অনুবাদ। যতদিন এটি চলতে থাকবে আমাদের আশার সলতেটা জ্বলতেই থাকবে।
সাকিব, তুমি এমনই থাকো। সুলতানের চিত্রকলার চরিত্র হয়ে। মানসিক দৃঢ়তায় অন্তর্লীন। আর ব্যাটে–বলে ২২ গজে ফোটাতে থাকো ফুলের মতো নীরব দম্ভ!
লেখক : বিশিষ্ট ক্রীড়া সাংবাদিক।
আইএইচএস/এমএস