যার ভয়ে বিশ্বের সব বোলার কম্পমান, যে ক্যারিবীয় ওপেনারের উত্তাল উইলোবাজি থামাতে ঘেমে নেয়ে ওঠেন অনেক বাঘা বাঘা বোলার, যিনি দাঁড়িয়ে গেলে প্রতিপক্ষ বোলার ও ফিল্ডারদের আসলে তেমন কিছুর করার থাকে না-সেই ভয়ঙ্কর, বিপজ্জনক ক্রিস গেইল ১৩ বলে রান না করেই সাজঘরে।
Advertisement
ইনিংসের বয়স চার ওভার পুরো হবার (৩.২) হবার আগে মাত্র ৬ রানে ভাঙলো ক্যারিবীয় উদ্বোধনী জুটি। টনটনের সমারসেট কাউন্টি ক্লাব মাঠে বাংলাদেশ সমর্থকদের সে কি উল্লাস! ৮ হাজার দর্শকের আসন বিশিষ্ট স্টেডিয়ামের চার পাশে ছড়িয়ে থাকা অন্তত হাজার দুয়েক বাংলাদেশি সমর্থকের ‘বাংলাদেশ-বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে কেঁপে উঠলো চারপাশ।
দেশেও নিশ্চয়ই নড়েচড়ে বসেছিলেন টাইগার সমর্থকরা। ভাবছিলেন-যাক বাবা, আসলটা গেছে। এখন একটু মাপা বোলিং আর টাইট ফিল্ডিং করলেই চলবে। বাকি সময় খুব যে বাজে বোলিং হলো, তাও নয়। কিন্তু ৫০ ওভার শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর ৮ উইকেটে ৩২১ রান।
কি বলবেন? সেটা কি খুব বেশি? আসুন ছোট্ট একটা পরিসংখ্যান দেখে নেই। টনটনের ছোট আকৃতির মাঠে এবারের বিশ্বকাপে এর আগে হয়েছে দুটি ম্যাচ। ৮ জুন নিউজিল্যান্ডের সাথে আগে ব্যাট করে আফগানিস্তান ১৭২ অলআউট। নিউজিল্যান্ড ৩২.১ ওভারে ৩ উইকেট খুইয়েই ঐ রান টপকে গেছে। তারপর গত ১২ জুন সর্বশেষ ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩০৭ করে ৪১ রানে জিতেছে অস্ট্রেলিয়া।
Advertisement
ভুলে গেলে চলবে না, ঐ মাচে পাকিস্তানের মোহাম্মদ আমির ৩০ রানে দখল করেছিলেন ৫ উইকেট। তারপরও অস্ট্রেলিয়ার রান গিয়ে ঠেকেছিল ৩০০ ‘তে। আর আজ ক্যারিবীয়রা অসিদের ( ৩০৭) টপকে আরও ১৪ রান বেশি করলো।
খালি চোখে এই রান কম নয়, অনেক। তবে ভয় পাবেন না । ইতিহাস ও পরিসংখ্যান আশা দেখাচ্ছে। বাংলাদেশ কিন্তু বিশ্বকাপে ঠিক এই রানের কাছাকাছি স্কোর (৩১৮) টপকে ৬ উইকেটের দারুণ জয়ের রেকর্ড আছে।
এবং সেটা ঠিক আগের বিশ্বকাপেই। দিনটি ছিল ৫ মার্চ। নিউজিল্যান্ডের নেলসনে স্কটল্যান্ডের করা ৩১৮ রান টপকে ৬ উইকেট অক্ষত রেখে ১১ বল আগেই লক্ষ্যে পৌঁছে গিয়েছিল টাইগাররা।
তামিম ইকবাল খেলেছিলেন ১০০ বলে ৯৫ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস। সাথে দারুণ সঙ্গ দিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ (৬২ বলে ৬২), মুশফিকুর রহিম (৪২ বলে ৬০), সাকিব (৪১ বলে ৫২) আর সাব্বির রহমান রুম্মন (৪০ বলে ৪২)।
Advertisement
হয়তো ভাবছেন, স্কটিশ বোলিং আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং লাইন আপ কি আর এক? স্কটিশদের তো ওশানে থমাসের মত গতির বোলার নেই। সাথে কট্রেলের মত সুইং বোলারও ছিল না।
হ্যাঁ, তা হয়ত ছিলনা। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা দেখিয়েছিলেন ৩০০+ রানের বড়সড় টার্গেট টপকে যাবার ক্ষমতা আর সামর্থ্য আছে আমাদের। প্রতিপক্ষ বোলিং শক্তির কথা চিন্তা করলে ৪ বছর আগে নেলসনের সেই ম্যাচের পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয়ত কঠিনই । তবে অসম্ভব নয়।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, নেলসনে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৩১৮ রান অতিক্রম করে স্মরণীয় জয়ের সেই ম্যাচে যে দুজন রান করেছিলেন বেশি-সেই তামিম আর মাহমুদউল্লাহ এবার নিজেদের খুঁজে পাননি এখনো। কে জানে, আজ সেই সুখস্মৃতি মনে করে তারা জ্বলেও উঠতে পারেননি। আগের তিন ম্যাচে তামিমের রান (১৬+২৪+১৯) মোটে ৫৯। আর মাহমুদউল্লাহর ব্যাট থেকে এসেছে (৪৫*+২০+২৮) ।
আরও একটি কাকতালীয় তথ্য, স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ২০১৫ সালে নেলসনে ৩১৮ রান টকে বাংলাদেশ করেছিল ৩২২। আজও কিন্তু জিততে চাই সেই ৩২২। এত মিল যখন, শেষটাও না আবার মিলে যায়!
ওয়েস্ট ইন্ডিজের রানটা শেষ পর্যন্ত ৩২০ ‘র ঘরে দেখে ভাবার কোনই কারষ নেই, বাংলাদেশের বোলাররা বাজে বল করেছেন। আসলে তা নয়। ফিল্ডিংটা একটা সময় গিয়ে একটু নুয়ে পড়লেও গড়পড়তা মন্দ হয়নি। তামিম ইকবাল শুধু একবার দৌড়ে গিয়ে ক্যাচ ধরে রাখতে পারেননি। তবে এই তামিমই দুর্দান্ত একটি ক্যাচও নিয়েছেন। ম্যাচে আসলে সেভাবে একটি ক্যাচও ড্রপ হয়নি।
আসলে শুরুর ধাক্কা সামলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩০০ ‘র ঘরে পা রেখেছে মূলত একটি জুটি আর শেষ দিকে অধিনায়ক জেসন হোল্ডার আর সিমরন হেটমেয়ারের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে।
৬ রানে উদ্বোধনী জুটি ভাঙার পর দ্বিতীয় উইকেটে দায়িত্ব নিয়ে খেলে ক্যারিবীয়দের অবস্থান আবার শক্ত করে দেন ওপেনার এভিন লুইস আর শাই হোপ। তাদের ১২১ রানের জুটিতেই প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ওঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
তারপরও ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান হয়ত ২৭০ থেকে ২৮০ ‘র মধ্যে থাকতো-যদি না হেমেয়ার আর অধিনায়ক হোল্ডার হাত খুলে দুটি ঝড়ো ইনিংস উপহার না দিতেন। জেসন হোল্ডার ২২০.০০ স্ট্রাইকরেটে খেলে গেছেন ১৫ বলে ৩৩ রানের টি-টোয়েন্টি মার্কা ইনিংস। একই স্টাইলে হেটমেয়ারের ১৯২.৩০ স্ট্রাইকরেটে ২৬ বলে ৫০ রানের ইনিংসটিও এগিয়ে দিয়েছে অনেক।
উইকেটের চরিত্র, আচরণ, গতি আর মাঠের আকার আয়তনকে মানদন্ড ধরলে বোলিং খারাপ হয়নি। পেসাররা ভাল বল করেছেন। অধিনায়ক মাশরাফি ছাড়া সাইফউদ্দীন ও মোস্তাফিজ আর সমান তিনটি করে উইকেট পেয়েছেন যথাক্রমে ৭২ আর ৫৯ রান দিয়ে। এছাড়া বাঁহাতি স্পিনার সাকিব স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি রান (৮ ওভারে ৫৪) দিলেও দুটি ভাইটাল উইকেট দখল করেছেন।
তবে যিনি কাজে দেবেন বলে ভাবা হয়েছিল, সেই অফস্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ আর অকেশনাল অফস্পিনার মোসাদ্দেক কেউই সুবিধা করতে পারেননি। মিরাজ ৯ ওভারে ৫৭ রান দিয়ে উইকেটশূন্য। আর মোসাদ্দেক ৬ ওভারে ৩৬ রানে উইকেট পাননি।
তবে কেন যেন মনে হয়েছে, অধিনায়ক মাশরাফি নিজে (৮ ওভারে ১ মেডেনসহ ৩৭) ইনিংসের মাঝামাঝি এসে নিজের কোটা পূর্ণ করে ফেলতে পারতেন। আর সাইফউদ্দীনকেও প্রথম স্পেলে আর কয়েক ওভার চালিয়ে যেতে পারতেন। তাতে করে হয়ত মাঝখানে মিরাজ আর মোসাদ্দেককে ১৫ ওভার বল করতে হতো না। যদিও আর মিরাজ ও মোস্তাফিজ দুজন (৯ ওভার করে) পুরো ১০ ওভারে বোলিং কোটা পূর্ণ করেননি।
অথচ পুরো ১০ ওভার বল করানো হয়েছে সাইফউদ্দীনকে। যিনি শেষ ওভারে অপ্রয়োজনে অনাবশ্যক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে তিনটি ওয়াইড করেছেন। শুরুতে গেইলকে আউট করলেও সাইফউদ্দীন একটু বেশি বৈচিত্র্য আনতে গিয়ে ৭২ রান দিয়ে ফেলেছেন।
বাঁহাতি পেসার মোস্তাফিজ প্রথম দুই স্পেলে লাইন ও লেন্থ খুঁজে পাননি। তারপরও তিন ওভারের দ্বিতীয় স্পেলে যখন যাওবা একটু নিজেকে খুঁজে পেলেন, ঠিক তখনই আবার তাকে পাল্টে ফেলা হলো। তৃতীয় স্পেলে এসে এক ওভারে ১৯ দিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেললেন।
কিন্তু তারপর বেশ ভাল বল করেছেন। বিশেষ করে স্লোয়ারে হেটমায়ারের উত্তাল ইনিংসের সমাপ্তি টানার পর বিপজ্জনক আন্দ্রে রাসেলকে ০ রানে অফস্টাস্পের ঠিক বাইরে দারুণ সুইংয়ে পরাস্ত করে সাজ ঘরে পাঠিয়ে মোস্তাফিজ দেখিয়েছেন এখনো তার বলের কারুকাজ শেষ হয়নি।
তবে প্রথম দিকে এই বাঁহাতি একটু বেশি লেগ সাইডে বল করলেন। তাতে করে বাঁহাতি পেসার হিসেবে না পারলেন কোন কোন (অ্যাঙ্গেল) তৈরি করতে, না ব্যাটসম্যানকে অফস্টাম্পের আশপাশে পরীক্ষায় ফেলা গেল না। আর সেগুলো ব্যাটসম্যানের পায়ের আশপাশেই থাকলো। তাতে বরং সুবিধাই হলো ক্যারিবীয়দের। এছাড়া মাশরাফি, সাইফউদ্দীন , সাকিব চেষ্টা করেছেন জায়গামত বল ফেলতে।
অধিনায়ক মাশরাফি নিজে টানা ৭ ওভারে (৭-১-২৪-০) স্পেলে বেশ ভাল বল করেছেন। প্রথম ওভারটি মেডেনও নিয়েছেন গেইলের বিপক্ষে। একাধিকবার ব্যাটসম্যানকে সুইংয়ে পরাস্ত করেছেন নড়াইল এক্সপ্রেস। কখনো অফস্ট্যাম্পের বাইরে না হয় ভিতরে ঢুকিয়ে। কিন্তু উইকেট পাননি। ভাগ্য সহায় থাকলে হয়ত প্রতিপক্ষ অধিনায়ক জেসন হোল্ডারের উইকেট পেতে পারতেন। কিন্তু তামিম লং অন থেকে দৌড়ে গিয়ে তা ধরতে পারেননি। হোল্ডারের রান ছিল তখন ২২।
এআরবি/এমএমআর/জেআইএম