জুনেই সরে গেলেন মে। এবং সেটা পূর্ব ঘোষণা দিয়েই। তেরেসা মে-র পদত্যাগ ব্রেক্সিটকে ঘিরে। মে-র উত্তরসূরি কে হতে যাচ্ছেন তার আভাস মিলছে। আইসিসি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হতে পারে কে, এই প্রশ্নের উত্তর দূরে থাক, কোন আভাস দেয়ার মত জ্যোতিষীও খুঁজে পাবেন না। বিশ্বকাপের আটচল্লিশ ম্যাচের একুশ ম্যাচ হয়ে যাওয়ার পরও না। কারণ, চ্যাম্পিয়নশিপের দাবিদার এবার অনেক। কাকে সরিয়ে কার গায়ে এঁটে দিবেন ফেবারিটের তকমা, তা নিয়ে দ্বিধান্বিত ক্রিকেট বিশ্ব। সেই সঙ্গে ফেবারিট নির্ধারণে বৃষ্টিও বড় এক ভূমিকা রাখছে এবারের বিশ্বকাপে।
Advertisement
প্রাক ফেবারিট হিসেবে ধারা হয়েছিল র্যাংকিং-এ এক নম্বরে থাকা ইংল্যান্ডকে। শুরু করেছিল স্বাগতিকরা ফেবারিটের মত। ক্রিকেট ইতিহাসের অনেক অবিস্মরণীয় স্মৃতি যার বুকে সেই ওভালে উদ্বোধনী ম্যাচেই গুড়িয়ে দিল ‘দ্য চোকার’ খ্যাত সাউথ আফ্রিকাকে। চোকার সাউথ আফ্রিকা কেন যেন এখন জোকারে পরিণত হচ্ছে! বিশ্বকাপ এলেই কেন যেন তাদের বুদ্ধিনাশ ঘটে। কিন্তু অহমিকা বাড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।
এবারের বিশ্বকাপটা খেলতে চেয়েছিলেন তাদের সাবেক অধিনায়ক এবি ডি ভিলিয়ার্স। দল ঘোষণার একদিন আগে নিজের সেই ইচ্ছের কথা জানিয়েছিলেন ‘মিস্টার থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি’। কিন্তু অবসরের ঘোষণা দেয়া এবি -কে ফেরালে টিমের সম্প্রতি নষ্ট হবে। কিন্তু তাদের টিমের এমন অবস্থা যে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়ার পথে তারা। ইংল্যান্ডের পর বাংলাদেশ তাদের দুরমুশ করলো সেই ওভালেই। পাত্তা পেলো না ভারতের কাছেও।
কিন্তু ফেবারিট এবং স্বাগতিক ইংল্যান্ড মুখ থুবড়ে পড়লো নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচেই। আনপ্রেডিকটেবল পাকিস্তান বুঝিয়ে দিল এই জায়গায় এখনও তারাই সেরা। এই দলটা কখন কী করবে কিংবা কি করতে পারে, তা তারা নিজেরাও জানে না! এবারের পাকিস্তান কিন্তু ’৯২ এর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে! সেবার ইমরান খানের পাকিস্তান প্রথম পাঁচ ম্যাচের একটা মাত্র ম্যাচ জিতেছিল। সঙ্গে বৃষ্টি ভেজা ইংল্যান্ড ম্যাচ থেকে পেয়েছিল এক পয়েন্ট। কিন্তু বিশ্বকাপের ইতিহাসে নৈশালোকে প্রথম ট্রফি উচিয়ে ধরেছিলেন ইমরান খান। তাই পাকিস্তানের চ্যাম্পিয়নশিপের দাবি খারিজ করে দেয়ার আগে একবার নয়, একাধিক বার ভাবতে হবে যে কোন ক্রিকেট পন্ডিতকে। বৃষ্টির সৌজন্যে এবারও তারা পয়েন্ট পেতে শুরু করেছে। কিন্তু বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে তাদের পরিসংখ্যান মোটেও ভাল না। এবার সেখানে কোন পরিবর্তন আনতে পারে কী সেটা দেখার অপেক্ষায় গোটা ক্রিকেট বিশ্ব।
Advertisement
কিন্তু লর্ডসের ব্যালকনিতে প্রথম দুটো বিশ্বকাপ উচিয়ে ধরা ওয়েষ্ট ইন্ডিজ যেন তাদের ক্রিকেট ইতিহাসের পুনরুত্থানের রুপ কথা লিখতে চায় ইংল্যান্ডে। ক্যারিবীয় ক্রিকেটের সৌন্দর্য্য আর ঐতিহ্যের প্রতীক ছিল যে ফাস্ট বোলিং। সেটা তারা আবার দেখাতে শুরু করেছে। আটলান্টিকের ওপারে বিশ্বকাপ নিয়ে যাওয়ার দাবিটাও জোরালভাবে জানাচ্ছে তারা। যদিও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিজেদের সেই ছন্দে দেখা যায়নি শেষ ম্যাচে ক্যারিবীয়দের।
তবে বিশ্বকাপের আয়োজক যখন আইসিসি সেখানে ভারতের কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার প্রকাশ ঘটবে না তা কী করে হয়! সাউথ আফ্রিকা তিন নম্বর ম্যাচ খেলতে নামলো যেদিন, সেদিন ভারত খেললো নিজেদের প্রথম ম্যাচ। কারণ, তাদের ক্রিকেটারদের বিশ্রাম দরকার। ভারত চাইলে আইসিসি না করবে কীভাবে! ভারতীয় রুপী যে আইসিসি-র অ্যাকাউন্টে ঢোকে ডলার হিসেবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর পশ্চিমা বিশ্বের চাপে কোনঠাসা হয়ে পড়া চীন-রাশিয়া যখন জোটবদ্ধ হচ্ছে, পুতিন-শি জিং পিং বৈঠক করছেন ফাইভ জি নেট ওয়ার্ককে উন্নত করতে, তারাও ভারতকে পাশে চায় এই অর্থনৈতিক যুদ্ধে। কিন্তু অর্থের দাপট কী সেটা ভারত দেখাচ্ছে ক্রিকেট বিশ্বকাপে। ভারতীয় সেনা চিহ্ন ‘বলিদান’ কিপিং গ্লাভসে লাগিয়ে ম্যাচ খেললেন এম এস ধোনি। বুঝিয়ে দিলেন আইসিসির আইন কানুন আর যাই হোক সবার জন্য সমান নয়। আইসিসি বলছে, ‘সেনাবাহিনীর সংকেত দেয়া কোন লোগো ব্যবহার করা যাবে না।’
ভারতীয় বোর্ড থেকে সে দেশের ক্রীড়ামন্ত্রী পর্যন্ত বলছেন, ধোনি কোন ভুল করেননি। অন্যায় করেননি। ধোনি একজন ভারতীয়। সেনাকে সমর্থন করা সেটা কোন রাজনৈতিক পদক্ষেপ নয়!’ আইসিসির নিয়ম অনুয়ায়ী কোন ক্রিকেটার ধর্মীয়, রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক স্বার্থ বিরোধী বা সেনার লোগো লাগিয়ে খেলতে পারবে না। ধোনির এই গ্লাভস নিয়ে রীতিমত হুকার দিচ্ছে ভারতীয় বোর্ড থেকে সাধারণ মানুষ। টুইটারে হ্যাশট্যাগ চালু হয়ে গিয়েছে; ‘ধোনি কিপ দ্য গ্লাভস’! ধোনির সেভগার্ড হিসেবে ভারতীয়রা বলতে শুরু করেছে; বিশ্বকাপে ধোনির গ্লাভসের দিকে নজর না দিয়ে বাজে আম্পারিং এর দিকে নজর দিক আইসিসি!
Advertisement
বাজে আম্পায়ারিং কী সেটা গত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচে দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব। শুধু চোখ বন্ধ করে রেখেছিল আইসিসি। এবার তাদের চোখ খুলতে বলেছে ভারতীয়রা! এখনও পর্যন্ত বিশ্বকাপের এটা এক বড় বিস্ময়।
তবে এবারের বিশ্বকাপ শেষ পর্যন্ত বড় কোন বিস্ময়ের জন্ম কী দেবে! নাকি ১৪ জুলাই গোটা ক্রিকেট বিশ্ব দেখবে আরেকবার বিশ্বকাপের ঠিকানা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার জলিমন্ট স্ট্রিট। পাঁচ পাঁচবার যেখানে বিশ্বকাপ ঢুকেছে। সেখান থেকে কাপ বের করা আনা অন্যদের জন্য কঠিন হবে, তা ওয়েস্ট ইন্ডজি- অস্ট্রেলিয়া ম্যাচেই বোঝা গেলো। এই লেখা ইন্টারনেট দুনিয়ায় ছড়ানো পর্যন্ত মনে হচ্ছে ওটাই বিশ্বকাপের এখন পর্যন্ত সেরা ম্যাচ।
যে ম্যাচে নিষেধাজ্ঞার কয়েদখানা থেকে বেরিয়ে আসা স্টিভেন স্মিথ নামের এক ক্রিকেটার বুঝিয়ে দিলেন, তার ব্যাটিং এর কার্যকারিতায় কোন জং ধরেনি বছর খানেক নিষেধাজ্ঞার ঐ কয়েদখানায় কাটানোর পরও। অস্ট্রেলিয়ানদের ক্রিকেট দর্শন ‘ নেভার সে ডাই’ এর দুর্দান্ত প্রদর্শনী দেখলো বিশ্ব।
৭৯ রানে ৫ উইকেট হারানো অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস তিনশ কাছাকাছি পৌঁছে গেলো আট নম্বরে ব্যাট করতে নাম নাথান কুল্টার নাইনের ৯২ রানের রেকর্ড গড়া ইনিংসে। বিশ্বকাপ ইতিহাসে আট নম্বরে ব্যাট করা কোন ব্যাটসম্যানের ওটাই সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। ম্যাচটা হয়তো জিততে পারেনি উইন্ডিজ। কিন্তু বিশাল দৈত্যাকার এক শরীরের উপর নিষ্পাপ মায়াবী চেহারার এক মুখায়ব আর ফ্রিজ থেকে বের করে আনা ঠান্ডা মস্তিষ্কের এক তরুণ যেভাবে ব্যাট করলেন, অধিনায়কত্ব করলেন, তাতে এম এস ধোনি নয়, ‘মিস্টার কুল’ খেতাবটা উইন্ডিজ অধিনায়ক জেসন হোল্ডারের পাওয়া উচিত।
প্রাণের উচ্ছ্বাস আর মনের আনন্দে ক্রিকেট খেলে ক্যারিবীয়রা। সেখানে আবেগের জোয়ার থাকে। প্রাণের স্পন্দন থাকে। হতাশাও থাকে। কিন্তু বাঙালির মত এতো বাঁধভাঙা আবেগের জোয়ারে ভাসা ক্রিকেট জাতি ক’টা আছে! সেই বাঙালি এবারের বিশ্বকাপেও দেখাচ্ছে ক্রিকেট বিশ্বায়নের বিপ্লবের ধ্বজাটা তারা ওড়াচ্ছে ক্রিকেট গ্রহে।
ইংল্যান্ড বা ওয়েলসের মাঠ গুলোর গ্যালারিতে লাল-সবুজের ঢেউকে টেক্কা দিতে পারে হয়তো শুধু ভারতের নীল সমুদ্র। তবে বাঙালির বড় সমস্যা তার বাড়তি আবেগ। যা যুক্তি-বিবেককে ভাসিয়ে নিয়ে যায়! নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হারের পর নেট দুনিয়ায় চোখ রাখলে মনে হয়; সব দোষ মুশফিকুর রহিম নামক এক উইকেট কিপারের। কেন তিনি রান আউট হলেন! কেন তিনি কেন উইলিয়ামসনকে রান আউট করতে পারলেন না! কেন, বল ধরতে গেলেন! সব প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে মুশফিকের দিকে। অথচ সবাই ভুলে যাচ্ছেন ছোট-খাটো এই লোকটা গ্লাভস হাতে স্পটজাম্পে এক হাতে কী অ-সা-ধা-র-ণ এক ক্যাচ নিয়েছেন!
এবারের বিশ্বকাপের সেরা দশ ক্যাচের মধ্যে মুশফিকের নেয়া ক্যাচ যে জায়গা করে নেবে তা নিয়ে কোন সংশয় নেই। যদিও ব্রিটিশরা সংশয়াছন্ন ব্রেক্সিট নিয়ে। তেরেসা মে-র পদত্যাগে রাজতন্ত্রের মধ্যেও ব্রিটিশরা উদার গণতন্ত্রের বিজয় দেখছেন। তবে তারা কল্পনায় দেখার সাহস কী পাচ্ছেন বিশ্বকাপটা লর্ডসেই থাকবে এবার?
একবার নয়। দুইবার নয়। তিনবার নয়। এই নিয়ে পাঁচ পাঁচবার বিশ্বকাপের আয়োজক ইংল্যান্ড। তিন বার ফাইনাল খেলেছে তারা। কিন্তু বিশ্বকাপ? সেটা ছুঁয়ে দেখা হয়নি তাদের। তবে বিশ্বকাপ নামক ক্রিকেট সাম্রাজ্যে অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানানোর আশে-পাশে কাউকে খুঁজে পায় না পরিসংখ্যান! পাঁচ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন তারা। টানা তিনবার বিশ্বকাপ জিতেছে। আগের এগারটা বিশ্বকাপের ছয়টার ফাইনাল খেলেছে তারা। ক্রিকেটগ্রহের সব মহাদেশ থেকে কাপ জেতার রেকর্ডটাও শুধুই তাদের। সেই অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটীয় শক্তি সম্পর্কে সংশয় থাকলে ভুল হবে।
এবারের বিশ্বকাপে গ্যালারিতে ব্রিটিশ বা উপমহাদেশীয়দের দাপটে অস্ট্রেলিয়ানরা হয়তো খানিকটা কোনঠাসা। গ্যালারিতে আপাতত তাদের কণ্ঠস্বরটা ক্ষীণ। তবে ক্রিকেটীয় কণ্ঠস্বর তাদের অনেক জোরালো। তাদের সেই ক্রিকেটীয় সভ্যতা একই সঙ্গে অসভ্যতার অস্ট্রেলীয় কণ্ঠস্বরকে চ্যালেঞ্জ জানানোর ক্ষমতা কার্যত: ইংল্যান্ডেরও নেই। বিশ্বকাপের টিকিট চাহিদা, বিক্রির পরিসংখ্যান, গ্যালারির উপস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে কয়েকগুণ এগিয়ে ভারত তথা এই উপমহাদেশ। কিন্তু বিশ্বকাপ এই উপমাদেশের সবাই মিলে যতবার জিতেছে, তারচেয়ে অস্ট্রেলিয়া একাই বেশিবার জিতেছে।
ব্রেক্সিট তাড়িত ব্রিটেনে সংকীর্ণ একমাত্রিক পরিচিতির দাবি যত জোরালো হচ্ছে ক্রিকেট বিশ্বকাপেও কেন যেন শুধু অস্ট্রেলিয়ানদের দাবিটাই জোরালো হচ্ছে! আবার যদি অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ জেতে, তাহলে ক্রিকেটের বিশ্বায়ন, বহুত্ববাদ কোথায় হোঁচট খাচ্ছে সেই প্রশ্নটা বড় হয়ে সামনে চলে আসবে ক্রিকেট বিশ্বের।
লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।
এইচআর/এমএস