খেলাধুলা

লর্ডস, ওভাল, ট্রেন্টব্রিজ কিংবা এজবাস্টনের আসল মালিক কে?

ব্রিস্টল কাউন্টি ক্লাব মাঠের মূল প্রবেশ পথে ঢুকতেই চোখে পড়বে এক শশ্রুমন্ডিত চেহারার ভদ্রলোকের ছবি। তিনি আর কেউ নন, ‘ডব্লিউ জি গ্রেস।’ বিশ্ব ক্রিকেটের আদি পিতা। ক্রিকেটের জন্মভুমি ইংল্যান্ডে খেলাটির প্রচার প্রসার ও জনপ্রিয়তায় ডব্লিউ জি গ্রেস অনন্য। পাইওনিয়র।

Advertisement

স্টেডিয়ামটি তার নামে না হলেও প্রবেশ পথে তার পাথরে খোদাই করা মুর্তি আছে। ঠিক এমন মুর্তির দেখা না পেলেও আপনি ওভালে ঢুকতে গেলে দেখবেন নামকরা কোন ক্রিকেটারের ছবি। একইভাবে ক্রিকেটের তীর্থস্থান লর্ডসের ভিভিআইপি লাউঞ্জে ওঠার পথেও মিলবে কোন না কোন বিশ্ব বরেণ্য ক্রিকেটারের ছবি।

বলার অপেক্ষা রাখে না, তাদের বেশির ভাগই ইংলিশ। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটার; কিন্তু কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনে গিয়ে আপনি কয়েক জনের ক্রিকেটারের পাশে পাবেন উপমহাদেশের দু’জন নামি-দামি ব্যাটসম্যান মাজিদ খান আর জাভেদ মিয়াদাঁদের ছবিও।

একইভাবে ব্রিস্টলের লাউঞ্জে আছে পাকিস্তানের সব সময়ের অন্যতম স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান জহির আব্বাসের ছবি। বাংলাদেশ দলের গন্তব্য এখন যে টনটনের সমারসেট কাউন্টি ক্লাবের মাঠ, সেখানে ১৪ জুন শুক্রবার দুপুরে প্রথম অনুশীলন করলো মাশরাফির দল, তার মিডিয়া সেন্টারের প্রবেশ পথে কিছুদুর যেতেই দুটি ছবির দিকে আপনার চোখ আটকে যাবে নিশ্চিত।

Advertisement

যার দুজনই ক্রিকেট ইতিহাসের দুই বড় সম্রাট স্যার ভিভ রিচার্ডস আর স্যার ইয়ান বোথাম। মানা গেল ডব্লিউ জি গ্রেস, স্যার ইয়ান বোথাম জাতিতে ইংলিশ। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটার। ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন। নেতৃত্বও দিয়েছেন। তাই তাদের ছবি এভাবে লাগানো; কিন্তু স্যার ভিভ রিচার্ডস তো আর ইংলিশ নন। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান, তার ছবি কেন টানানো? মাজিদ খান, জহির আব্বাস আর জাভেদ মিয়দাঁদরাও ইংরেজ নন। তাদের ছবিই বা কিভাবে কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেন আর ব্রিস্টল মাঠের প্যাভিলিয়নে ঠাঁই পেলো?

একবার ভাবুন তো, বাংলাদেশের কোন স্টেডিয়ামে কি কোন ভিনদেশি ক্রিকেটারের ছবি টানানো আছে? প্রশ্নই ওঠে না। হোম অফ ক্রিকেট শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের প্রবেশ পথ দিয়ে গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডের নীচে আছে বাংলাদেশের বর্তমান আর সাবেক অধিনায়কদের ছবি।

শুধু একটি ছবি চোখে পড়বে, সেটা ২০১১’র বিশ্বকাপের আর ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ টি-টোয়েন্টি আসরের সব প্রতিযোগি দলের অধিনায়কের ছবি আঁকা আছে। এর বাইরে বিশ্বের যত বড় তারকাই হোন না কেন, আর কোন বিদেশী ক্রিকেটারের ছবিই বাংলাদেশের কোন ক্রিকেট ভেন্যুতে নেই।

তাহলে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন ভেন্যুতে বাইরের দেরে ক্রিকেটারের ছবি কেন? ধাঁধায় পড়ে গেছেন? গোলমেলে ঠেকছে? মেলাতে গিয়ে বিপাকে পড়ে গেছেন। নিশ্চয়ই খুব জানতে ইচ্ছে করছে, তাই না?

Advertisement

তাহলে শুনুন, এই প্রত্যেকটা ছবি টানানোর পিছনে একটি ইতিহাস আছে এবং সেই ছবি টানানোর ইতিহাস শুনতে গিয়ে জানবেন এক নতুন কাহিনী। যুক্তরাজ্যের প্রত্যেকটি ভেন্যুতে ইংলিশ, ক্যারিবীয়, ভারতীয় আর পাকিস্তানী ক্রিকেটারদের ছবি টানানোর কারণ শুনতে গিয়ে জানবেন অন্য এক তথ্য। কি সেই তথ্য ?

ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসের মানে যুক্তরাজ্যের সব আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যু কোন না কোন ইংলিশ কাউন্টি ক্লাবের নিজস্ব মাঠ। অর্থাৎ লর্ডস, ওভাল, ট্রেন্টব্রিজ, এ্যাজবাস্টন, প্রতিটি ভেন্যুর মালিক কোন না কোন কাউন্টি ক্লাব। বিভিন্ন সময় সেই ক্লাবগুলোয় যে সব দেশি-বিদেশি নামী ও আন্তর্জাতিক তারকা খেলে গেছেন তাদের ছবিই শোভা পাচ্ছে।

আর সে কারণেই ব্রিস্টলে ডব্লিউ জি গ্রেসের স্থাপত্য তৈরি করা হয়েছে ইংল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার ও অধিনায়ক হিসেবে নয়, এ কিংবদন্তি ক্রিকেটারের মুর্তি তৈরি করা হয়েছে, কারণ তিনি ব্রিস্টলের কাউন্টি ক্লাব গ্লস্টারশায়ারের হয়ে খেলেছেন এবং গ্লস্টারশায়ারের অধিনায়কও ছিলেন।

একইভাবে কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনের মিডিয়া ভবনের প্রবেশ পথে দুই পাকিস্তানী মাজিদ খান আর জাভেদ মিয়াদাঁদের ছবি টানানো। কারণ ওই মাঠের মালিক হচ্ছে ইংলিশ কাউন্টি ক্লাব ‘গ্লেমারগন।’ ওই ক্লাবের ক্রিকেটার ছিলেন মাজিদ খান আর জাভেদ মিয়াদাঁদ। একইভাবে টনটনের সমারসেট কাউন্টি ক্লাব মাঠে স্যার ভিভ রিচার্ডস আর স্যার ইয়ান বোথামের ছবি পাশাপাশি টানানো আছে, কারণ ওই দুই গ্রেট দীর্ঘদিন সমারসেটের হয়ে কাউন্টি খেলেছেন।

শুধু বিশ্ব ক্রিকেটের সব সময়ের দুই সেরা পারফরমার ভিভ রিচার্ডস আর ইয়ান বোথামই নন। সমারসেট ক্লাবের হয়ে আশির দশকের বড় সময় ইংলিশ কাউন্টি খেলেছেন ওয়েস্ট তথা বিশ্ব ক্রিকেটের সব সময়ের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার জোয়েল গার্নার।

এই তিন ক্রিকেট ‘গ্রেট’ একসাথে ঠিক একযুগ ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটে সমারসেটের হয়ে খেলেছেন। প্রায় একই সময় সমারসেটে বোথাম আর রিচার্ডসের সঙ্গী ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফাস্ট বোলার ‘বিগ বার্ড’ জোয়েল গার্নার। আশির দশকের প্রথমভাগে তাদের সাথে ইংলিশ কাউন্টি খেলে গেছেন বিশ্ব ক্রিকেটের আরেক বড় তারা ‘সুনিল মনোহর গাভাস্কার।’

কিন্তু ইতিহাস জানাচ্ছে, গাভাস্কার-রিচার্ডসের মত সর্বকালের দুইঅন্যতম সেরা উইলোবাজ, সর্বকালের সেরা চার অলরাউন্ডারের অন্যতম ইয়ান বোথাম আর ৭০ ও ৮০’র দশকের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার জোয়েল গার্নার এক সাথে খেললেও তখন সমারসেট কাউন্টি ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। আশির দশকেই শুধু নয়, আজ অবধি ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটের শিরোপা জেতেনি সমারসেট।

তার মানে কি দাঁড়ালো? যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন ক্রিকেট ভেন্যুতে দেশি ও বিদেশি ক্রিকেটারের ছবি শোভিত হবার কারণ একটাই- এ দেশের সবগুলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যুর মালিক কোন না কোন ক্লাব বা কাউন্টি ক্লাব। যেমন ক্রিকেট ‘তীর্থ’ লর্ডসের আসল মালিক হলো ‘মিডলসেক্স কাউন্টি ক্লাব’। সেই সাথে বিশ্ব ক্রিকেটের অভিজাত মেরিলিবোন ক্রিকেট (এমসিসি) ক্লাবেরও মাঠ হিসেবে সমাদৃত।

এবার বাংলাদেশ লন্ডনের যে মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে বিশ্বকাপে উড়ন্ত সূচনা করেছে এবং তারপর নিউজিল্যান্ডের সাথে লড়াই করে হার মেনেছে, সেই আরেক ঐতিহ্যবাহী মাঠ ওভালের মালিক হচ্ছে ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটের সব সময়ের অন্যতম সফল ক্লাব ‘সারে।’

একই ভাবে কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেন ছিল আরেক নামী ইংলিশ কাউন্টি ক্লাব গ্লেমারগনের মাঠ। ব্রিস্টলের মাঠ হলো আরেক অভিজাত কাউন্টি ক্লাব গ্লস্টারশায়ারের নিজস্ব মাঠ। টনটনের যে ক্রিকেট ভেন্যুতে ১৭ জুন বাংলাদেশ মুখোমুখি হবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের- সেটা হচ্ছে ভিভিয়ান রিচার্ডস আর ইয়ান বোথামের ক্লাব সমারসেটের মাঠ।

এখানেই শেষ নয়। ২০ জুন যে মাঠে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হবে মাশরাফির দল, সেই ট্রেন্টব্রিজ হলো আরেক ইংলিশ কাউন্টি ক্লাব ‘নটিংহ্যামশায়ারের’ মাঠ। আর ২৪ জুন আফগানিস্তানের সাথে টাইগাররা খেলবে সাউদাম্পটনের ‘রোজবোল মাঠে।’ সে মাঠটি আরেক নামি ইংলিশ কাউন্টি ক্লাব হ্যাম্পশায়ারের মাঠ।

ভারতের বিপক্ষে ২ জুলাই টাইগারদের লড়াই হবে বার্মিংহ্যামের ‘এজবাস্টনে।’ ওই মাঠটি আরেক অভিজাত ইংলিশ কাউন্টি দল ওয়ারউইকশায়ারের নিজস্ব মাঠ। সেমি ফাইনালের ভেন্যু ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ড হলো আরেক নামী ইংলিশ কাউন্টি ক্লাব ‘ল্যাঙ্কাশায়ারে’র নিজস্ব মাঠ। এই ক্লাবের হয়ে পাকিস্তান তথা বিশ্ব ক্রিকেটের সব সময়ের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার ওয়াসিম আকরাম দীর্ঘদিন খেলেছেন। মিডলসেক্সের মাঠ লর্ডসে হবে ফাইনাল।

মোটকথা, যুক্তরাজ্যের সব মাঠের মালিকই হচ্ছে ক্লাব। একইভাবে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ায় যেমন রাজ্য, প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক ক্রিকেট অধিদপ্তারের মাঠ। ভারতের বিখ্যাত ইডেন গার্ডেন হলো পশ্চিম বঙ্গ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের নিজস্ব মাঠ। পাঞ্জাবের ‘মোহালি’ হচ্ছে পাঞ্জাব ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের নিজস্ব মাঠ। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, ওয়াকা, অ্যাডিলেড সবই কোন না কোন অঞ্চল বা প্রদেশের নিজস্ব ক্রিকেট স্টেডিয়াম।

অথচ বাংলাদেশেই তার ব্যতিক্রম। বাংলাদেশের সব শীর্ষ স্টেডিয়াম প্রথম টেস্ট ভেন্যু বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, শেরে বাংলা স্টেডিয়াম, ফতুল্লা খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম, চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম, সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম- সব কটার মালিক জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) তথা সরকার।

কোন ক্লাবও না। আর আঞ্চলিক ক্রিকেট অধিদপ্তর বা অ্যাসোসিয়েশনের তো হবার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ বাংলাদেশে এখনো আঞ্চলিক ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনই নেই।

তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো বাংলাদেশের ক্রিকেট উত্তোরণে যে ক্লাব গুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য, যে ক্লাবগুলো বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘সুতিকাগার’। সেই মোহামেডান, আবাহনী, আজাদ বয়েজ, ভিক্টোরিয়া, বিমান, সূর্যতরুণ, ব্রাদার্স, কলাবাগান- ইয়াং পেগাসাস বিভিন্ন সময় রকিবুল হাসান, ইউসুফ বাবু, শফিকুল হক হীরা, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ, দিপু রায় চৌধুরী, রফিকুল আলম, সামিউর রহমান সামী, নজরুল কাদের লিন্টু, গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, নেহাল হাসনাইন, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, আতহার আলী, গোলাম নওশের প্রিন্স, আকরাম খান, এনামুল হক মনি, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, খালেদ মাহমুদ সুজন, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, খালেদ মাসুদ পাইলট, মেহরাব হোসে অপি, শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ, হাসিবুল হোসেন শান্ত, মোহাম্মদ রফিক এবং মোহাম্মদ আশরাফুল, আফতাব, নাফিস ইকবাল এবং আজকের পঞ্চ পান্ডব মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরাও ঢাকার ক্লা লিগ খেলেই জাতীয় দলে।

কিন্তু সেই ক্লাবগুলো আজ পর্যন্ত নিজেদের গরজ ও খরচে কোন স্টেডিয়াম তৈরি করতে পারেনি। বাংলাদেশে এমন কালচারই নেই। অথচ দেশের ক্রিকেটে ক্লাবগুলোর অর্থ লগ্নিও কম নয়। বছর অনুযায়ী হিসেব কষলে দেখা যাবে স্বাধীনতার পর চার যুগে অনেক ক্লাব দেুই থেকে তিন’শো কোটি কোটি টাকার ওপরে খরচ করে ফেলেছে; কিন্তু রাজধানী ঢাকা বা বন্দর নগরিতে যুক্তরাজ্যের মত কোন ক্লাবের নিজস্ব অর্থায়নে একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম গড়ে ওঠেনি।

এখনো বাংলাদেশে স্টেডিয়াম মানেই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সম্পত্তি। যা বিশ্বের আর কোথাও নেই !

এআরবি/আইএইচএস/এমএস