বাংলা সাহিত্যে সনেট বা চতুর্দশপদী বলতে বোঝায় ১৪টি চরণে সংগঠিত ও প্রতিটি চরণে সাধারণভাবে মোট ১৪টি করে অক্ষর সম্বলিত কাব্যশৈলী। ষোড়শ শতাব্দিতে ইংরেজিতে প্রথম সনেটের আবির্ভাব। তারপরের দুই শতকে মূলত উইলিয়াম শেক্সপিয়র, মাইকেল ড্রায়টন এবং এড স্পেন্সর ইংরেজি সনেটকে নতুন নতুন ধাপে অগ্রসর করেছে।
Advertisement
অন্যদিকে বাংলা সাহিত্যে প্রথম সনেট ‘কবি-মাতৃভাষা’ রচনা করেছেন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনিই সনেটের নাম পরিবর্তন করে বাংলায় ‘চতুর্দশপদী’ রেখেছেন। সর্বমোট ১০৮টি চতুর্দশপদীও রচনা করেছেন। কবি দেবেন্দ্রনাথ সেন চতুর্দশপদীতে পেত্রার্কীয় রীতি অবলম্বন করে ভিন্নধারা আনার চেষ্টা করেন। বাংলার আর কোন কবি সনেটকে নতুন নতুন ধাপে অগ্রসর করতে পারেননি।
কবি ড. রাজুব ভৌমিক এ বছরের শুরু থেকে বাংলা সনেটের নতুন ধারা সৃষ্টি করতে ‘আয়না সনেট’ পদ্ধতি প্রচলন করেছেন। আয়না সনেট নামকরণের ব্যাখ্যায় কবি রাজুব ভৌমিক বলেন, ‘আয়না সনেট নামটি দিলাম কারণ সনেটগুলো দুই দিক থেকে পড়া যাবে। এ কবিতার অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে- এ কবিতার ভেতরে আরেকটি কবিতা আছে।’
আয়না কবিতাগুলো দুই দিক থেকেই চৌদ্দ অক্ষরের, চৌদ্দ লাইন বিশিষ্ট, ককখখ, গগঘঘ, ঙঙচচ এবং ছছ অন্ত্যমিল নিয়ে সাজানো। আয়না সনেটগুলো সাধারণত পর্ব্যবিন্যাস (৮+৬) রীতি মেনে চলে না।
Advertisement
যেমন:
পেতে শুধু অবহেলা জন্মায় গরীব;২+২+৪+৩+৩=১৪ক্ষেতে করে শ্রম বন্ধ্য, ফসলে মুনীব।২+২+২+২+৩+৩=১৪
শেষ দিক থেকে পড়লে হবে:গরীব জন্মায়, অবহেলা শুধু পেতে; ৩+৩+৪+২+২=১৪মুনীব ফসলে, বন্ধ্য শ্রম করে ক্ষেতে।৩+৩+২+২+২+২= ১৪
বাংলা সাহিত্যের প্রথম আয়না সনেটের নাম ‘গরীবের জন্ম’ কবিতাটি দিয়ে। কবিতাটি পড়া যাক-
Advertisement
‘পেতে শুধু অবহেলা জন্মায় গরীবক্ষেতে করে শ্রম বন্ধ্য, ফসলে মুনীবনিষ্ফল কপাল তার, শোষিত জীবনবলহীন বুকে সর্ব, লাথিতে মরণ।
ক্লেশ দুঃখ নিয়ে, অতিবাহিত সংসারবেশ হল ভাবে, ধনাঢ্য যে পরিবার করুণ কাহিনী তার, ভূতেও না শুনে তরুণ আত্মা ঝরে, রাখে না কেউ মনে।
মহাকাব্য হয়নি কভু, কথা নিঃস্বের অদ্রাব্য তাহার গল্প, করুণা ভবের ডরে নাহি চলে, ভবে দিন গরীবের মরে সে অযথা, নিয়ে বোঝা সংসারের।
গরীবের জন্ম ভবে, জন্যে ভুলিবার পাপের কুদৃষ্টি যে, সারাজনম তার।’
ঠিক আয়নার মতো। তাই না? কিন্তু চতুর্দশপদী শব্দটি ব্যবহার না করে কেন সনেট রাখা হলো? সনেট শব্দ ব্যবহারের যুক্তিতে তিনি বলেন, ‘কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা ভাষায় সনেটের প্রবর্তক হলেও ‘চতুর্দশপদী’ শব্দটি দ্ব্যর্থবোধক হওয়ায় সনেটের প্রতিশব্দ হিসেবে পাঠকের মন জয় করতে পারেনি। তাছাড়া সনেটের প্রকৃত বাংলা প্রতিশব্দ তৈরি করা মুশকিল। ইচ্ছে করলে যে কোন শব্দের প্রতিশব্দ তৈরি করা যেতে পারে কিন্তু সনেটের ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দ তৈরিতে অযথা সময় নষ্ট করাই ভালো। সনেট শব্দটি ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে তাই পাঠককে গোলানো এখানে নিরর্থক। তাই আমার মনে হলো সনেটের প্রতিশব্দ না হলেই যথার্থ।’
কবি রাজুব ভৌমিক আরও বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যের কোষে নতুন কিছু জমা দেব বলে সনেটের নতুন এ ধারার সৃষ্টি করা। এটি খুব একটি সহজ পদ্ধতি নয়। আয়না সনেটের সাথে প্যালিনড্রোম বা Palindrome কবিতার সামান্য মিল আছে। পূর্বে প্যালিনড্রোম পদ্ধতিতে সাধারণ কবিতা লেখা হয়েছে। কিন্তু কখনো সনেট লেখা হয়নি। ৭৯ সালে প্রথম প্যালিনড্রোম কবিতা লেখা হয়েছে কিন্তু হেনরি পিচাম সর্বপ্রথম ১৬৩৮ সালে প্যালিনড্রোম পদ্ধতিতে লেখা তার বই ‘দ্য ট্রুথ অব আওয়ার টাইমস’ প্রকাশ করেছেন। চীনের বিখ্যাত কবি সু হুই সবচেয়ে জটিল একটি প্যালিনড্রোম কবিতা লিখেছেন। কিন্তু তিনি একটিই লিখেছেন। এ পর্যন্ত কেউ প্যালিনড্রোম সনেট লেখেননি।’
এসইউ/এমকেএইচ