অর্থনীতি

রসালো সংবাদ সম্মেলনে ছিল বিব্রতকর পরিস্থিতিও

বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে শুল্ক আরোপ হলো, দাম বাড়ল, গরিব কিছু পেল না এ রকম কিছুটা কাটখোট্টা টাইপ প্রশ্নোত্তর হবে- এমনটাই অতীতের অভিজ্ঞতা। তবে এবারের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন ছিল অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন রকম। এবারের সংবাদ সম্মেলন যে ভিন্ন রকম হবে এটা আগে থেকেই আঁচ করা যায়।

Advertisement

কারণ এবারই প্রথম প্রধানমন্ত্রী সংসদে আংশিক বাজেট উপস্থাপনের একদিন পর বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। কিন্তু এতটা যে ভিন্ন রকম হবে তা মনে হয় কেউ কল্পনাও করেনি।

সংবাদ সম্মেলন চলাকালে বেশির ভাগ সময় হলভর্তি মানুষের মুখে ছিল হাসির রোল। এর মধ্যেই সাউন্ড সিস্টেমের সমস্যায় বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। আবার অর্থমন্ত্রীকে কাভার করা কয়েকজন সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে প্রশ্ন করার আগে নিজেকে জাহির করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

শুক্রবার বিকেল ৩টায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিবার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বক্তব্য দিলেও এবারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অসুস্থ থাকায় প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করেন।

Advertisement

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুল মান্নান, কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

প্রশ্নোত্তর চলাকালে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন অর্থপাচার এবং কর আদায়ে বাজেটে কলো টাকা বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে বলে আপনি বলছেন। এতে যারা সৎ আছেন তারা কি হতাশায় ভুগবেন না? এমন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা কালো টাকা অর্জন করেছে সেসব টাকা প্রথমেতো অর্থনীতিতে আসুক। এসব টাকা কে কোথায় গুঁজেটুজে রেখেছেন। সেগুলোকে আগেতো অর্থনীতিতে আনতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রীর এমন রসাত্মক উত্তরে হলভর্তি শ্রোতাদের মাঝে হাসির রোল পড়ে যায়। কালো টাকা সাদা করা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘জরিমানা দিয়ে অল্প কয়েকটি জায়গায় কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে। তাই যারা সৎ আছে তাদের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই।’

অপর এক সাংবাদিক খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা যারা পত্রিকা বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কাজ করেন, এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা কত ব্যাংক থেকে কত ঋণ নিয়ে পরিশোধ করে না সেটা খোঁজ নেন। এরা যদি সঠিকভাবে ঋণ পরিশোধ করতো তাহলে খেলাপি ঋণ এত বাড়তো না।’

Advertisement

এমন উত্তর শুনেও হলভর্তি মনুষ না হেসে থাকতে পারেননি। অবশ্য খেলাপি ঋণ বাড়ার জন্য খেলাপি ঋণ গণনার ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা আছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।

বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন সাধারণত প্রতিবছরই রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে হয়। এবারই প্রথম বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখানকার সাউন্ড সিস্টেম এমন যে মঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রী যা বলছেন সেগুলো সামনে শ্রোতারা স্পষ্ট শুনতে পারেন। কিন্তু অডিয়েন্স প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে কোনো প্রশ্ন করলে প্রধানমন্ত্রী তার কিছুই শুনতে পারছিলেন না বারবার ইকো (শব্দের পুনরাবৃত্তি) হচ্ছিল।

একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী তাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি একটু সামনের দিকে এসে বললে ভালো হয়। ইকো হচ্ছে, ভালো শোনা যাচ্ছে না।’

ওই সাংবাদিকের প্রশ্ন শেষ হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি খুব দুঃখিত, আমি একটা শব্দও বুঝতে পারিনি। এখানে একটু ইকো হচ্ছে। মনে হয় সাউন্ডটা একটু কমানো উচিত।’

মঞ্চ থেকে ওই সাংবাদিককে সামনে এসে প্রশ্ন করতে বলা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এভাবে শোনা যাবে না। আমি জানি না, কীভাবে ব্যবস্থা করা যাবে। ভীষণ ইকো হচ্ছে। মঞ্চে কোনো কথা বোঝাই যাচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘মঞ্চ থেকে কোনো কথাই শোনা যাচ্ছে না। সাউন্ডটা কারা কন্ট্রোল করে? একটু কমান। আমি জানি না কী ধরনের সাউন্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

এ সময় ওখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাউন্ড কন্ট্রোলারদের ডাকতে গেলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ওদের আসা লাগবে না, সাউন্ডটা একটু কমালেই হবে।’

এ সময় প্রধানমন্ত্রী যেমন বিরক্ত হন তেমনি বিব্রত পরিস্থিতিতে পড়েন হল কর্তৃপক্ষ। সাউন্ড সিস্টেমের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে শেষে মুখে না বলে লিখিত আকারে প্রশ্ন নেন প্রধানমন্ত্রী।

এরই মাঝে প্রধানমন্ত্রীর সামনে প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়ে এক সাংবাদিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, অভিনন্দন জ্ঞাপন ও লম্বা প্রশংসা করতে থাকেন। বাদ দেননি নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের কথা প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে। প্রশ্ন করা বাদ দিয়ে আনুসঙ্গিক কথা এত বেশি বলতে শুরু করেন যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাকে থামিয়ে বলেন, ‘আপনার প্রশ্নটা কী? শুধু সেটুকু বলুন।’

এভাবেই হাস্যরস, বিব্রতকর পরিস্থিতি আর প্রশ্ন বাদ দিয়ে নিজেকে চেনানোর মধ্য দিয়েই শেষ হয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন। তবে প্রায় দেড় ঘণ্টার সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের কাছ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও আসে। সেগুলোরও উত্তর দেন প্রধানমন্ত্রী।

এর আগে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করা হয়। এটি দেশের ৪৮তম এবং বর্তমান সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট। ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’ শিরোনামে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয় ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট এটি।

গতকাল বেলা ৩টায় জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বাজেট অধিবেশন শুরু হয়। শুরুতে বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে এটি তার প্রথম বাজেট।

দাঁড়িয়ে বাজেট বক্তৃতা শুরু করলেও পরে স্পিকারের অনুমতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী নিজ আসনে বসে বাজেট উপস্থাপন করেন। কিন্তু বিকেল ৪টার পর অসুস্থ অর্থমন্ত্রীর পক্ষে প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন সম্ভব না হওয়ায় স্পিকারের অনুমতি নিয়ে বাকি অংশ সংসদে উপস্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এমইউএইচ/এনডিএস/পিআর