দেখলাম পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ঈদের জামাতে গিয়ে হাজির হয়েছেন কলকাতায়- মুসলমানদেরকে নির্ভয় থাকতে বলতে। ঈদের জামাতে সাধারণত ভিন্ন ধর্মের লোকেরা এভাবে যায় না। আবার মহিলা কোনও সরকার প্রধান এভাবে ঈদ জামাতে গিয়ে বক্তৃতা করেছেন সেটাও আমি দেখিনি। এমন কোনও ঘটনাও ঘটেনি যে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডার মতো জুমার নামাজে হাজির হয়ে সমবেদনায় শরিক হবেন তিনি। কিন্তু মমতারতো সব কিছুতে বাড়াবাড়ি।
Advertisement
মমতার মুসলিম প্রীতিটাও বাড়াবাড়ি রকমের। বিরোধীরা এই বাড়াবাড়ির সমালোচনা করাতে তিনি আবার ‘যে গরু দুধ দেয় তার লাথি খাওয়া জায়েজ’ জাতীয় একটা বাণী দিয়েছেন। তার মানে মমতার মুসলিম প্রীতি মূলত পশ্চিম বাংলার অনগ্রসর মুসলমানদেরকে এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য নয়, ভোটের রাজনীতি। সংখ্যালঘুরা ২৭ শতাংশ হলেও এখনও সেখানকার সমাজে অনেক পিছিয়ে পড়া একটা জনগোষ্ঠী। মমতা তাদেরকে খুব একটা এগিয়ে দিয়েছেন সেটা পরিসংখ্যান বলে না। হয়তো এটা ঠিক গত পাঁচ বছর নানা কারণে গোটা ভারতবর্ষে মুসলমানদের মনোবল যেভাবে ভেঙে গেছে, পশ্চিমবাংলায় ততটা নয়।
প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার সব নাগরিককে এই বিশ্বাস জাগানো- জাত ধর্ম নির্বিশেষে সব কিছুতে তার সমান অধিকার। সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরুদের নিয়ে রাজনীতি করা সরকারের কাজ না। এক পক্ষকে অতি তোষণ, চাকরি বাকরিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার রাজনীতি চালু থাকলে ক্ষমতার পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রীতি তাদের পুরো কমিউনিটির জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে অতি তোষণ যদি সংখ্যালঘুদের দেখানো হয়, সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুদের প্রতি বেশি মাত্রায় বিদ্বেষী হয়ে উঠে। পশ্চিমবাংলায় মমতার কারণে এখন তাই হয়েছে।
বিজেপিকে পশ্চিম বাংলায় পথ দেখিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তিনি অটল বিহারী বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভায় যোগদান করেছিলেন এবং রেলমন্ত্রী ছিলেন। এবারের নির্বাচনে বিজেপিকে অলিখিত সমর্থন দিয়েছে সিপিএম। ঢালাওভাবে সিপিএম কর্মীরা বিজেপি প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় নেতারাও তা স্বীকার করেছেন। মমতার তৃণমূলকে প্রতিরোধ করার জন্য সিপিএম-এর অনুরূপ সিদ্ধান্ত চরম আত্মঘাতি।
Advertisement
১৯৬৪ সালে অল-ইন্ডিয়া কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সিপিএম এর জন্ম, জন্ম থেকেই তারা অকাজে লিপ্ত। মানুষের কল্যাণের জন্য মানুষ হত্যা নাকি তাদের রাজনৈতিক দর্শনে জায়েজ। পশ্চিম বাংলায় একটানা ৭ বার বামফ্রন্ট ক্ষমতায় ছিল কিন্তু রাজ্যের তেমন কোনও উন্নতি করেনি, সংখ্যালঘু মুসলমানদেরকে মূলস্রোতে আনতে পারেনি। এখন সব পাপের সম্মিলিত ফলাফল তাদেরকে অস্তিত্বের সংকটে ফেলেছে। দলে দলে বামফ্রন্টের কর্মীরা বিজেপিতে যোগদান করছে। মুকুল রায়ের প্রচেষ্টায় তৃণমূলের কর্মীরাও বিজেপিতে যাচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ আর মুকুল রায় তৃণমূলের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে ফেলার চেষ্টা করছেন এবং তারা সফল হবেন বলেও মনে হচ্ছে।
পশ্চিম বাংলার উগ্র মৌলবাদীদের প্রথম থেকেই কোনও জায়গা ছিলো না। জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির বাড়ি পশ্চিম বাংলায় হলেও শ্যামা প্রাসাদ মুখার্জী ছাড়া ভিন্ন কোনও মৌলবাদী ছিলেন না। যেখানে কংগ্রেস সম্মত হয়নি সেখানে তিনি শেরে বাংলা ফজলুল হকের সঙ্গে শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা গঠন করতে দ্বিধা করেননি। শ্যামা প্রাসাদ মুখার্জী একাই একশ ছিলেন। কারণ লেখা পড়ায়, বক্তৃতায় তার খ্যাতি ছিলো ভারতব্যাপী। তিনি ছিলেন আশুতোষ মুখার্জীর ছেলে।
শ্যামা প্রাসাদ হিন্দু মহাসভার সভাপতি ছিলেন কিন্তু মহাসভার সর্ব উচ্চ কমিটি মুসলমানকে সদস্যপদ দেওয়ার তার প্রস্তাব গ্রহণ না করায় তিনি হিন্দু মহাসভা ত্যাগ করে জনসংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন সত্য কিন্তু কথা ও কাজে কোনও দ্বিচারিতা ছিলো না। যা তিনি বিশ্বাস করতেন তাই অকপটে বলতেন।
কী হিন্দু মহাসভা, কী জনসংঘ- কারোই কোনও রাজ্য কমিটি ছিলো না পশ্চিমবঙ্গে। আরএসএস-এরও কোনও তৎপরতা ছিলো না পশ্চিম বঙ্গে। আরএসএস গত ডিসেম্বর মাসে (২০১৮) দম দম বিমানবন্দরের কাছে ২১ বিঘা জমি কিনেছে। তাদের পশ্চিম বাংলার সদর দফতর স্থাপন করবে ওই জায়গায়।
Advertisement
নরেন্দ্র মোদির গত পাঁচ বছরের কর্মকাণ্ডের প্রতি লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, তিনি গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ও মূল্যবোধের পরিচর্যা করার লোক নন। একই চরিত্র মমতা ব্যানার্জিরও। তিনি কংগ্রেসের ১৭ জন বিধায়ককে তার দলে নিয়ে গেছেন। এখন একই কাণ্ড করেছেন নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ। মমতা ১৭ বিধায়ক নেওয়ার সময় বলেছিলেন তিনি কংগ্রেসকে আঞ্চলিক দল বানিয়ে ছাড়বেন। গত ২৩ শে মের পর থেকে তৃণমূলের ৪ বিধায়ক ও ৪০ কাউন্সিলর বিজেপিতে যোগদান করেছেন। তৃণমূল ত্যাগী মুকুল রায় যেভাবে উঠেপড়ে লেগেছেন সম্ভবত মমতাকে বিধানসভার নির্ধারিত তারিখের আগেই বিধানসভার নির্বাচন দেওয়ার সুপারিশ করতে হবে।
বিধায়ক ভাগানো নিয়ে যে হর্সট্রেডিং আরম্ভ হয়েছে তাতে অচিরেই পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সব প্রকারের মূল্যবোধ চূড়ান্তভাবে বিনষ্ট হবে। অথচ কংগ্রেস দীর্ঘ সময়ব্যাপী ভারত শাসন করেছে কিন্তু তারা অন্য দলের বিধায়ক ভাগানোর কোনও চেষ্টাই কখনো করেনি। ভুঁইফোড় রাজনীতিবিদদের হাতে পড়ে একটা সুন্দর ব্যবস্থা বিপন্ন হওয়ার অবস্থায় এসে দাঁড়াচ্ছে। পরের পরিশ্রম আত্মসাৎ করার অভ্যাসই হচ্ছে ভুঁইফোড় রাজনীতিবিদদের চরিত্র। দীর্ঘ দিন রাজনীতিতে জড়িত হলেই ভুঁইফোড় চরিত্রের অবসান হয় না।
বামফ্রন্ট সব সময় পঞ্চায়েত নির্বাচনে রিগিং করেছে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস নজিরবিহীন রিগিং করেছে। ক্ষেত্রবিশেষে তৃণমূল প্রার্থী ছাড়া অন্য কোনও প্রার্থী নমিনেশন পেপার পর্যন্ত তুলতে পারেনি। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির চর্চার জন্য ভারত অনুকরণীয় দেশ ছিলো আমাদের কাছে। বামফ্রন্ট, তৃণমূল এখন পদ্ধতিটাকে কলুষিত করে ফেলেছে। মুসলিম ভোট একহাট্টা হয়ে তৃণমূলকে নাকি ভোট দিয়েছে না হয় এবার তৃনমূল ২২ আসনেও জিতে আসত কিনা সন্দেহ ছিলো।
আমার মনে হয় অমিত শাহ এবার নাগরিক পঞ্জির কাজ পশ্চিম বাংলায় শুরু করবে আর আসামের মত পশ্চিম বাংলায়ও আগামী বিধানসভার নির্বাচনের আগে ৮০/৯০ লক্ষ মুসলমান ভোটারের নাগরিকত্ব সম্পর্কে বির্তক তুলে তাদের ভোটাধিকার ঝুলিয়ে দেবে। তাতে মুসলমানদের তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার শাস্তি ভোগ করাও হবে আবার মমতার ভোট ব্যাংকও দুর্বল হয়ে যাবে।
বামফ্রন্টের অনাচার থেকে আত্মরক্ষার জন্য পশ্চিম বাংলার মানুষ মমতাকে ভোট দিয়েছিলো কিন্তু দুর্ভাগ্য যে বামফ্রন্ট যা যা করেছিলো তৃণমূলও তা তা করছে। তাতে পশ্চিম বাংলার মানুষ সামাজিক শান্তি যেমন বামফ্রন্টের সময় পায়নি তা তৃণমূলের সময়েও পাচ্ছে না। একটা লোক থানায় একটা এফআইআর করতে গেলে থানাকে বামফ্রন্টের সময় তাদের স্থানীয় মস্তানকে দেখাতে হত আর টাকা দিতে হতো, এখনও তাই করতে হয়। অর্থাৎ থানা প্রশাসনও ছিলো উভয় সময়ে দলীয় নিয়ন্ত্রণে। পূর্বের প্রতিষ্ঠিত নিয়ম তৃণমূল বদলায়নি। পশ্চিম বাংলার মানুষ বামফ্রন্টের প্রতি বিরক্ত হয়ে তৃণমূলকে ভোটে জিতালো এখন তৃণমূলের প্রতি রাগ করে বিজেপিকে ভোট দেওয়া তো বিচিত্র কিছু নয়।
আগামী বিধানসভায় সম্ভবতো তাই হবে। নরেন্দ্র মোদি অমিত শাহের টাকা আর নির্বাচনী কৌশল মোকাবেলা এখন খুবই কঠিন। অবশ্য তাতেও কোনও লাভ হবে বলে মনে হয় না। কারণ বামের চরিত্রহীন মানুষগুলো তৃণমূলে গিয়েছিলো এখন তারাই দলে দলে বিজেপির দিকে ছুটছে। যেই লাউ সেই কদু। অবশ্য এত দিনে কর্মী মস্তানেরা সাম্প্রদায়িক ছিলো না। বিজেপির কাছে এসে কর্মীগুলোর আর এক বদগুণ রপ্ত করবে। তারা গড়ে সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠবে।
পশ্চিম বাংলার অনুরূপ অবস্থায় কংগ্রেস সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা আরম্ভ করলে তারা সম্ভবত ভাল করতে পারবে। এখন কংগ্রেসের উচিৎ তাদের কর্মতৎপরতা পশ্চিম বাংলায় আরম্ভ করা। সংগঠন না থাকলে কোনও পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। ১৩৪ বছরের প্রাচীন সংগ্রেসের নেতারা নতুন কর্ম উদ্যমে মাঠে নামলে পশ্চিম বাংলার জনগণ হয়তো কংগ্রেসকে বিমুখ করবে না। তারা তো বামফ্রন্ট, তৃণমূল দেখেছে, উত্তম-অধম বাছাই করার সময় নিশ্চই তারা কংগ্রেস শাসনকে তুলনামূলকভাবে ভাল বলার সময় এসেছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।anisalamgir@gmail.com
এইচআর/জেআইএম