বাংলাদেশের বাজেট সাধারণের জন্য নয়, আমলাতান্ত্রিক অংকের যোগ-বিয়োগ মাত্র। এ খাতে এত বাড়ানো হবে, এ খাতে এত কমানো হবে- এটাই এখন বাজেটের মূল আলোচনার বিষয়। এতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বা তাদের প্রত্যাশার বিষয়টি গুরুত্ব পায় না।
Advertisement
আরও পড়ুন >> চাপ ও চমকের বাজেট ঘোষণা কাল
বলছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। আসন্ন বাজেট প্রসঙ্গ নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে জাগো নিউজকে তিনি আরও বলেন, বাজেট আজও গণমানুষের হতে পারেনি। এটা নিয়ে অনেক কিছুই বলা হয়, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না।
এবারের বাজেটের আকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটি উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে ১৭ কোটি মানুষ বসবাস করছে, সেখানে ৪-৫ লাখ কোটি টাকার বাজেট মোটেই বিশাল বলে মনে করি না। বাংলাদেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যয়ের সঙ্গতি ধরে কথা বললে বাজেটের আকার আরও বড় হতে পারে বলে মনে করি।
Advertisement
বাজেট বাস্তবায়নে প্রশ্ন তুলে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বাজেট নিয়ে অনেক কথা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, বাজেট আলোচনায় কথা বলছে কারা? সরকারের নীতিনির্ধারকরা, আমলা বা আমাদের মতো আলোচক-সমালোচকরা। বলা যায়, প্রতি বছর নির্ধারিত ব্যক্তিরাই বাজেট নিয়ে আলোচনা করছেন। সরকার আলোচনা করছে এফবিসিসিআই বা বিজিএমইএ’র মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এসব সংগঠন গ্রামের একজন মুদি ব্যবসায়ীর প্রতিনিধিত্ব করেন না। এফবিসিসিআই হাজার হাজার কোটি টাকার বিষয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে। কিন্তু গ্রামের একজন সাধারণ মানুষের কাছে ১০০ টাকাই অনেক বড় কিছু। বাজেটে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বা তাদের প্রত্যাশার বিষয়টি একেবারেই গুরুত্ব পায় না। বাজেট আলোচনায় অনেক কিছুই বলা হয়, কিন্তু বাস্তবায়নে নানা ত্রুটি রয়ে যায়।
‘বাজেট সাধারণের জন্য শুভঙ্করের ফাঁকি’ উল্লেখ করে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারের বাজেট প্রতিটি মানুষের জীবনে প্রভাব রাখে। কারও জীবনে ইতিবাচক আবার কারও জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ কারণে আমাদের মতো দেশে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে বাজেট প্রণয়ন দরকার। কিন্তু তা হয় না। বাজেট মূলত সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব।
আরও পড়ুন >> বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় থাকছে যত ভাতা
বাজেটের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব, বেসরকারি উন্নয়ন এবং দরিদ্র মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনই হলো বাজেটের মূল লক্ষ্য। কিন্তু আমাদের দেশে প্রথম দুটি হয়, তৃতীয়টি আর হয় না। সরকারের বাজেট আলোচনায় বড় বড় রাস্তা, ফ্লাইওভার নির্মাণের মতো বিষয় গুরুত্ব পায়। সেই ফ্লাইওভারে সাধারণ মানুষ কী সুবিধা পাচ্ছে, তারা সেই রাস্তায় আদৌ উঠতে পারছে কি না, তা গুরুত্ব পায় না। গরিব মানুষের সঙ্গে যা সরাসরি জড়িত সেখানে গুরুত্ব না দিলে উন্নয়ন কাঠামো দুর্বলই থেকে যায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্যে ব্যয় সাধারণ মানুষকে সরাসরি প্রভাবিত করে। শিক্ষার গুণগত মান উন্নত হচ্ছে না, সাধারণ মানুষের জীবন-সংগ্রামে শিক্ষা তেমন অবদান রাখছে না। প্রাইমারি লেভেলে স্বাস্থ্য খাত ভালো করছে। কিন্তু সেকেন্ডারি লেভেলে ভালো করছে না।
Advertisement
বাজেট আর উন্নয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে আপনি কাঠামোগত পরিবর্তন দেখছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে, হাসপাতালের ভবন নির্মাণ হচ্ছে। এসব উন্নয়নের একটি মাত্র সূচক। কিন্তু একটি সূচক দিয়ে আপনি সব মূল্যায়ন করতে পারেন না। শিক্ষার মান নিয়ে এখন সবাই প্রশ্ন তুলছেন। বাজেটে শিক্ষার ব্যয় যদি বেড়েই থাকে তাহলে মানের এ অবস্থা কেন? খোঁজ নিয়ে দেখুন, কয়টি উপজেলা হাসপাতালে ভালো ডাক্তার আছেন? ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে, কমিউনিটি হাসপাতাল আছে। কিন্তু কোনো সেবা নেই, ওষুধ নেই। একইভাবে শিক্ষার মান নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন। পাসের হার বাড়ছে, কিন্তু মান ভয়াবহভাবে কমছে। প্রায়োগিক শিক্ষার ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা নেই। সুতরাং বাজেটে যোগ-বিয়োগের পরিবর্তনকেই আপনি সত্যিকার উন্নয়ন বলতে পারেন না।
বাজেট কার্যকরের পরামর্শস্বরূপ এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বাজেটের জন্য কার্যকর আলোচনা দরকার এবং সে আলোচনায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। লোক দেখানো আলোচনা কোনো কার্যকর পরিবর্তন আনতে পারে না। বাজেটের আগে আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়। আমি মনে করি, জানুয়ারি থেকেই বাজেট নিয়ে কথা বলা উচিত। আলোচনা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। এফবিসিসিআই, এনসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ’র মতো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের চাপে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। এসব প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে সাধারণত গণমানুষের কথা সামান্যই থাকে।
‘খাতা-কলমে বাজেট না দেখিয়ে প্রায়োগিক অর্থে বাজেট মূল্যায়ন করা দরকার। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা বাড়ানোর জন্য আগে থেকেই ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে। আপনি জুন থেকে আলোচনা করে জুন মাসেই ঘোষণা করবেন, তাতে সব বিষয় আলোকপাত হয় না।’
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটি অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম বাজেট।
আরও পড়ুন >> রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা পাবেন প্রবাসীরা
‘সমৃদ্ধির সোপানে বাংলাদেশ, সময় এখন আমাদের’ শিরোনামে পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব চূড়ান্তও করা হয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের মধ্যে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কার মধ্যেই আগামী বাজেটে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করতে যাচ্ছে সরকার। নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য ও সেবাকে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে অব্যাহতি দিয়ে সাত বছর আগে পাস করা আলোচিত আইনটি কার্যকর হতে যাচ্ছে বাজেট ঘোষণার দিন থেকেই।
তবে আসছে বাজেটে থাকছে প্রথমবারের মতো কিছু জনকল্যাণমুখী উদ্যোগ।
এএসএস/এমএআর/এমএস