পৃথিবীর শুরুতে জুতা মানুষের পায়ে স্থান করে নিতে না পারলেও সভ্যতার আগমনের সঙ্গে বদলে গেছে দৃশ্যপট। সময়ের স্রোতে জুতা কেবল পা ধুলোমুক্ত রাখার জন্যই ব্যবহৃত হয়নি। প্রয়োজন পূরণের সীমা ছাড়িয়ে জুতা বা স্যান্ডেল হয়ে উঠেছে আধুনিক মানুষের ফ্যাশনের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ।
Advertisement
কিন্তু যদি বলা হয় জুতা বা স্যান্ডেল পরে গ্রামে হাঁটা যাবে না, স্বভাবতই থমকে যাবেন। জুতা না পরে বাড়ির বাইরে বের হওয়া যায় নাকি? এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাবে আপনার মাথায়।
তবে যুগ যুগ ধরে এমনটি হয়ে আসছে ভারতের তামিল নাড়ু রাজ্যের একটি গ্রামে। যেখানকার মানুষ জুতা বা স্যান্ডেল পরে গ্রামে প্রবেশ করেন না। গ্রামের প্রবেশদ্বার থেকে জুতা হাতে নেন তারা। আবার জুতা হাতে নিয়ে গ্রামের সীমানার বাইরে গিয়ে তারা এটি পায়ে দেন। অদ্ভুত রীতিনীতি মনে হলেও প্রতিদিন তা করেন এখানকার মানুষ।
রাজধানী চেন্নাই থেকে ৪৫০ কিলোমিটার দূরে তামিল নাড়ু রাজ্যের ছোট্ট গ্রাম আন্দামান। ধানক্ষেত ঘেরা গ্রামটিতে ১৩০ পরিবারের বাস। এখানকার অধিকাংশ মানুষ কৃষিজীবী।
Advertisement
আন্দামান গ্রামের প্রবেশদ্বারেই আছে প্রকাণ্ড একটি নিম গাছ। গাছটির নিচে থাকা ভূগর্ভস্থ জলাধার থেকেই ধানক্ষেতগুলোতে চাষের পানি আসে। এখানকার রাস্তাগুলো পাথর দিয়ে আবৃত। বহু বছরের পুরোনো এ নিম গাছ থেকেই শুরু হয় গ্রামের মানুষদের জুতা খুলে হাতে নেয়া।
অনেক বয়স্ক ও খুব অসুস্থতা ছাড়া আন্দামান গ্রামের প্রতিটি মানুষ এ নিয়ম মেনে চলেন। এমনকি প্রচণ্ড গরমে মাটি যখন প্রচণ্ড উত্তপ্ত থাকে তখনও তাদের পায়ে জুতা থাকে না। গ্রামের সীমানা পার না হওয়া পর্যন্ত সবাই জুতো হাতে নিয়ে হাঁটেন। এমনকি ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও স্কুলে যাওয়ার পথে এ নিয়ম মেনে চলে। খালি পায়ের এ অবস্থাতেই চলে গ্রামের কাজকর্ম।
গ্রামটিতে জুতা না পরার শুরুটাও ছিল একটা বিস্ময়কর ঘটনা। ৬২ বছর বয়সী লক্ষণ ভিরাবাদরা চার দশক আগে এই গ্রামে দৈনিক মজুরির শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। বর্তমানে তিনি দুবাইতে একটি নিমার্ণ কোম্পানির মালিক। এই কোম্পানিতে জনবল নিয়োগ দেয়ার জন্যে তিনি মাঝে মাঝে গ্রামে আসেন। যদিও তার গ্রামের আসার মূল উদ্দেশ্য সেটা না। শেকড়ের টানেই তিনি গ্রামে ছুটে আসেন।
লক্ষণ ভিরাবাদরা বলেন, প্রায় সত্তর বছর আগের কথা। গ্রামের প্রবেশদ্বারে ওই নিম গাছটির নিচে গ্রামের সবাই মিলে কাদামাটি দিয়ে ভগবান মুথায়ালাম্মার একটি মূর্তি তৈরি করে। পুরোহিতরা যেমন ভগবানের মূর্তি গয়না দিয়ে সাজায় এবং এর চারপাশে ঘুরে মানুষ পূজা করেন, ঠিক এভাবেই একটি যুবক জুতা পরে ভগবানের মূর্তির চারপাশে হেঁটেছিল।
Advertisement
তিনি বলেন, যুবকটি অবজ্ঞা করে এভাবে হেঁটেছিল কি না সেটা আজও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে হাঁটতে হাঁটতে যুবকটি পিছলে মাঝখানে পড়ে যায়। ওইদিন সন্ধ্যায়ই সে রহস্যময়ভাবে জরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। যা সেরে উঠতে কয়েক মাস লেগে গিয়েছিল। সেই থেকে অজানা ভয় এবং বিশ্বাসে গ্রামের মানুষ আর কোনো দিন জুতা পরে না। এটা এখন জীবনের স্বাভাবিক একটি অংশ হয়ে গেছে।
৭০ বছর বয়সী আন্দামানের বাসিন্দা মুখান আরুমুগাম জানান, বয়স্ক বা খুব বেশি অসুস্থ ছাড়া গ্রামের কেউ জুতা পরেন না।
গ্রামটির মধ্যে দিয়ে হাঁটলেই দেখা যায় স্যান্ডেল বা জুতা না পরার দৃশ্য। শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা জুতা হাতে নিয়ে স্কুলে যায়। এখানে সবাই এভাবেই চলাফেরা করে। একটি পার্স বা ব্যাগের মতো তারা হাতে করে জুতা বহন করে।
খালি পায়ে থাকার বিষয়ে ১০ বছর বয়সী নিথি বলেন, আমার মা বলেছে, আমাদের গ্রামকে মুথায়ালাম্মা নামের একজন শক্তিশালী দেবী রক্ষা করছে। তাই তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আমরা গ্রামে কখনো জুতা পরি না। আমি চাইলে জুতা পরতেই পারি। কিন্তু এটা এমন দাঁড়ায় যে, সবাই যাকে ভালোবাসছে আমি তাকে অপমান করছি।
৫৩ বছর বয়সী চিত্রশিল্পী কারুপ্পিয়া পান্ডে স্ত্রী পিছিম্মার সঙ্গে ধানের জমিতে কাজ করছিলেন। তিনি বলেন, আমরা চতুর্থ প্রজন্ম হিসেবে গ্রামের এ রীতি পালন করে আসছি।
পিছিম্মা বলেন, যখন কেউ গ্রামে বেড়াতে আসেন, আমরা তাকে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু এটি তিনি করতে না চাইলে জোর করা হয় না।
তবে একটা সময় ছিল যখন জুতা না পরা নিয়ে বাড়াবাড়ি ছিল। এখন এটি সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগত পছন্দ যা এখানে বসবাসকারী সকলে পালন করে। আমি কখনো আমার চার সন্তানের ওপর এ নিয়ম চাপিয়ে দেইনি। আশপাশের শহরগুলোতে কাজ করা মানুষগুলো এই গ্রামে বেড়াতে আসলে এটা সবাই তারা অনুসরণ করে চলে।
সূত্র : বিবিসি।
এএইচ/এমএস