বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে সাউথ আফ্রিকার বিরুদ্ধে দাপুটে জয় পেলেও ওভালে কিউইদের সঙ্গে নতুন কোনো মহাকাব্য রচনা করতে পারেনি টাইগাররা, ভুল নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে সর্বত্র। হাতের নাগালের জয়টা যেন আবারো ফসকে গেল! বিশ্বকাপে সব ম্যাচেই জয়ের স্বপ্ন নিয়ে খেলা দেখতে বসে টাইগারপ্রেমীরা, তাই ম্যাচ হাতছাড়া হলে ক্ষোভটাও মাত্রা ছাড়ায়। ফার্গুসনের বলে তামিমের সাজঘরে ফেরার পর বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং ভরসা মুশফিক যখন একটু আশা জাগিয়ে রানের গতি বাড়াচ্ছিলেন, তখনই ভুল সিদ্ধান্তে রান আউট হলেন মুশফিক। পরবর্তীতে বাজে ফিল্ডিংয়ের কারণে উইলিয়ামসকে আউট করতে না পারা ও স্ট্যাম্পিং মিস করার কারণে মুসি পরিণত হয়েছিলেন ভিলেনে। যদিও শেষের দিকে কিউইদের উইকেট পতনের পর খানিকটা স্বপ্ন দেখাচ্ছিল বাংলাদেশ, তবুও শেষ পর্যন্ত দিনটি টাইগারদের ছিল না। খেলার মাঠে বসে দর্শকদের জন্য হতাশা ছাড়া আপাতত কিছুই উল্লাস করার অবশিষ্ট কিছু নেই। তবে আমি ওভালে টাইগারদের যে নতুন ভোর দেখেছি, সেই গল্পটাই বলতে চাই আজ।
Advertisement
আমার সামনের সিটে বসা একটি পরিবারকে দেখছিলাম, বাংলাদেশের পক্ষে কিছুক্ষণ পরপর উচ্ছাস প্রকাশ করতে। গায়ের রং দেখে এশিয়ান মনে হলেও চেহারার আদল বাঙালির নয়। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম পরিবারটির সঙ্গে যে ১১-১২ বছর বয়সী কিশোর গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছে তার গায়ে পাকিস্তানি জার্সি। জার্সিতে পাকিস্তানের জাতীয় প্রতীক চাঁদ আর তারা দেখে আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। কিশোরটির দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি পাকিস্তানি হয়ে বাংলাদেশ সাপোর্ট করছ কেন?’ তার মা জবাব দিল, ‘আযান (ছেলেটির নাম আযান) সবচেয়ে ভালো দলের খেলা দেখতে পছন্দ করে, বাংলাদেশ তার প্রিয় দল।’
কৌতূহল বাড়ল আমার, শুরু হলো আলাপচারিতা। আযানের কাছে জানতে চাইলাম, ‘পাকিস্তান আর বাংলাদেশ খেলা হলে তুমি কোন দল সাপোর্ট করবে?’ আযান খানিকটা মৃদু হেসে জবাব দিল, ‘পাকিস্তান, তবে বাংলাদেশ জিতলেও আমার মন খারাপ হবে না। কারণ বাংলাদেশ আমার প্রিয় দল।’ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললাম, ‘আযান, আমি তোমার ছবি তুলতে চাই।’ আযান আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে ছবি তুলতে পোজ দিল। বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম পাকিস্তানিদেরও মন জয় করেছে-এই গল্প আমি ওভালে না আসলে হয়তো জানতে পারতাম না। ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে আমি ব্রিটেনে বড়ো হওয়া এই পাকিস্তানি কিশোরকে ঘিরে নতুন ভোর দেখি। নিজের শেকড় পাকিস্তানকে উপেক্ষা করে বিশ্বসেরা দল হিসেবে বাংলাদেশকে ভাবছে কিশোর আযান! এই গল্প আমাদের অনুপ্রাণিত করে। এভাবেই হয়তো কিশোর আযান একদিন ১৯৭১-এর গণহত্যার সত্যটাও জানবে।
শুধু পাকিস্তানি এই পরিবারটির গল্পই নয়, ওভালের আরো গল্প আছে। রিচার্ডের সঙ্গে দেখা ওভাল পাতাল রেইল স্টেশনে। একজন শ্বেতাঙ্গের গায়ে বাংলাদেশ ক্রিটেক দলের জার্সি দেখে চোখ ফিরিয়ে দ্বিতীয়বার তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম তিনি বাঙালি নন। হাত বাড়িয়ে পরিচিত হতেই রিচার্ড তার টাইগারদের প্রেমের পেছনে নিজের প্রেমের গল্পটাই বলতে শুরু করলেন। সোয়াস ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে ঢাকার এক তরুণীর সঙ্গে প্রেম হয় রিচার্ডের। প্রেম গড়িয়ে পরিণতি ঠেকেছে সংসারে। বাংলাদেশি তরুণীর প্রেমে পড়ে রিচার্ড বাংলাদেশকেও ভালোবাসতে শুরু করেছেন। ভালোবাসার টানে বাংলাদেশি জার্সি গায়ে জড়িয়ে ওভালে যাচ্ছেন বউয়ের সঙ্গে খেলা দেখতে। রিচার্ডের কাছেও একই প্রশ্ন ছিল, ‘ইংল্যান্ড-বাংলাদেশ খেলার দিন সে ইংল্যান্ডকে সাপোর্ট করবে কিনা?’ রিচার্ড মাথা নেড়ে জানান দিলে, ‘না’। ইংল্যাল্ড আর বাংলাদেশের খেলার দিনও সে বাংলাদেশের জার্সিই গায়ে জড়াবে, টিম টাইগারদের উৎসাহ যোগাতে সে তার স্ত্রীকে নিয়ে মাঠে থাকবে।
Advertisement
রিচার্ড কিংবা আযানকে কেউ প্ররোচিত করেনি, তারা বাংলাদেশের খেলায় উজ্জ্বীবিত হয়ে নিজেদের ইচ্ছেতে বাংলাদেশ দলকে তাদের পছন্দের তালিকায় অগ্রাধিকার দিয়েছেন। বাংলাদেশের জার্সি গায়ে খেলা দেখতে এসেছিলেন অস্কার বিজয়ী ব্রিটিশ অভিনেত্রী টিলডা সুইনটন! সবুজ জার্সি গায়ে অভিনেত্রী টিলডাকে ঠিকই খুঁজে পেয়েছে স্কাই স্পোর্টসের ক্যামেরা। এই ব্রিটিশ তারকারও নিশ্চয়ই টাইগারদের ভালোবাসার পেছনে একটা ব্যাখ্যা আছে। ওভালের গ্যালারির আনাচে-কানাচে হয়তো এমন গল্প অগণিত-অজস্র। এই সংখ্যা বেড়ে হোক অযুত-নিযুত, লক্ষ-কোটি।
তানভীর আহমেদ, সাংবাদিক ও গবেষক, একাত্তর টিভির যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি
এসআর/পিআর
Advertisement