ঈদের পরদিন বৃহস্পতিবার রাজধানী মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় ঘুরতে এসে নিখোঁজ হন বিভিন্ন বয়সী প্রায় ৪০ জন। পরে অবশ্য তারা সবাই স্বজনদের খোঁজ পেয়েছেন বলে জানিয়েছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।
Advertisement
ঈদের পরদিন সকাল ৮টা থেকে রাজধানীর বিনোদনের অন্যতম কেন্দ্র মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানায় মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। কেউ ছেলে-মেয়ে, কেউ বা বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হাজির হন এখানে।
দুপুরে হঠাৎ স্ত্রী হরিয়ে যায় ইলিয়াস আলীর। দেড় ঘণ্টা খোঁজখুঁজির পর তথ্যকেন্দ্রে গিয়ে অভিযোগ করেন তিনি। হারানোর বিষয়টি মাইকিং করে জানানোর আরও কমপক্ষে দেড় ঘণ্টা পর স্ত্রীর দেখা মেলে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঈদের দিন সকাল থেকেই ভারিবর্ষণ হওয়াই সেদিন চিড়িয়াখানায় দর্শনার্থীর চাপ ছিল না। কিন্তু ঈদের পরদিন সকাল থেকেই মানুষের চাপ বাড়তে থাকে। মানুষের ভিড়ে পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন নানা বয়সী শিশু ও নারী-পুরুষ।
Advertisement
মজার খবর হলো, এক লোক মানুষের ভিড়ে তার স্ত্রীকে না পেয়ে নিখোঁজের খবর দিতে আসেন তথ্য কেন্দ্রে। ১০-১১ মাস বয়সী এক ছেলে কোলে নিয়ে মাইক অপারেটরকে জানান, ভাই আমার বউ হারিয়ে গেছে, একটু মাইকিং করেন। মাইক অপারেটর শমেস আলী ঠাট্টার ছলে বলেন, ‘আরে বউ আবার হারায় কেমনে, সমস্যা নাই পাবেন মোবাইল করেন।’
এ সময় ইলিয়াস বলেন, ‘মোবাইল খালি হারিয়ে ফেলে, তাই আজ মোবাইলটা বাসায় রেখে আসছিল। আমরা বাচ্চা কোলে নিয়ে জিরাফ দেখছিলাম। জিরাফটা দেখার সময় হঠাৎ দেখি পাশ থেকে বউ নাই। আমি তো দেড় ঘণ্টা ধরে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, কারো মোবাইল দিয়ে তো একটা ফোনও করতে পারতো, কি যে করি।’ পরে অবশ্য তিনি স্ত্রীকে খুঁজে পেয়েছেন বলে জানান চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।
চিড়িয়াখানার তথ্য সহকারী মো. শমেস আলী জাগো নিউজকে নিশ্চিত করে বলেন, ‘কী আর বলা লোকটি অনেকক্ষণ বসে ছিলেন। আমাদের কাছে তো বললো যে দেড় ঘন্টা আগে থেকে স্ত্রীকে পাচ্ছেন না। এরপর আরও এক দেড় ঘণ্টা পর তিনি তার স্ত্রীর সন্ধান পেয়েছেন।’
এ ছাড়া চিড়িয়াখানায় বেড়াতে এসে মানিব্যাগ, মোবাইলসহ অন্যান্য জিনিসপত্রও হারিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। যদিও এসব জিনিস আর ফিরে পাওয়া যায়নি। মানিব্যাগ, ভ্যানিটি ব্যাগ, মোবাইল বা অন্যান্য সামগ্রী হারানোর পর অনেকেই এসব তথ্য জানান না বলে জানান আরেক তথ্য সহকারী রিতা রানী দাস। একই সঙ্গে চার জন তথ্য সহকারী হিসেবে কাজ করেন। তাদের মধ্যে হোসনে আরা বেগম ও আবুল কালাম রয়েছেন। তারা পর্যায়ক্রমে সারাদিন বিরতিহীনভাবে মাইকিং করতে থাকেন।
Advertisement
চিড়িয়াখানায় বেড়াতে এসে স্ত্রী নিখোঁজ ছাড়াও সে সময় খুলনা থেকে আসা দুই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এক মা সন্তানসহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। খুলনার ভাটিয়াঘাটা থেকে ঢাকায় বেড়াতে আসা ওই নারীর কাছেও কোনো মোবাইল ছিল না। সাভারের চন্দ্রা থেকে ৬ -৭ বছর বয়সী সায়িকা কান্না করছিল চিড়িয়াখানার ভেতরে। সে তার মা বাবার সঙ্গে এসে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এক আনসার সদস্য সায়িকাকে ধরে তথ্য কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। সায়িকার সেকি কান্না। পরে বাবা এসে কোলে তুলে নেওয়ার পর বাবাকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখে সায়িকা। মাইক অপারেটর শমেস আলী বলছিলেন, ‘আপনার স্ত্রীকে খবর দেন এবং দুইজনে মিলে মেয়েকে নিয়ে যান।’
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থেকে সাত বন্ধু মিলে ঘুরতে আসাদের মধ্যে একজনকে হারিয়ে ৬ জন তথ্য কেন্দ্রে এসেছে বন্ধুকে খুঁজতে।
জানতে চাইলে ১৫ বছর বয়সী সজিব জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা হালুয়াঘাট থেকে ঢাকায় এসেছি চিড়িয়াখানা দেখতে। আমাদের এক বন্ধুকে খুঁজে পাচ্ছি না। তার কাছে মোবাইল থাকলেও চার্জ শেষ হয়ে গেছে তাই যোগাযোগ করতে পারছি না।’
৬-৭ বছর বয়সী নাতনি নিয়ে যাত্রাবাড়ী থেকে আসা আলেয়া বেগম বলেন, ‘আমার ছোট্ট নাতিসহ পুত্রবধূকে খুঁজে পাচ্ছি না। একটু খোঁজ করা দরকার, ঘোষণা দেবেন বাবা।’ আলেয়া বেগম বলেন, ‘মোবাইল নম্বর জানা নেই, আমাদের বাড়ি গাইবান্ধায়। ঢাকায় বেড়াতে এসেছি।’
অন্যদিকে, রাজিয়া বেগম নামে এক নারী এসেছেন তার স্বামীর খোঁজে। তিনি বলেন, ‘আমরা চিড়িয়াখানার মাঝ বরাবর ছিলাম। হঠাৎ ঘুরতে গিয়ে আর স্বামীকে খুঁজে পাচ্ছি না।’
ফোন করতে বললে তিনি বলেন, ‘ফোন তো আমার হাতে। এখন একটু ঘোষণা দেন, তার (স্বামীর) কোলে ছোট্ট বাচ্চা, গরমের মধ্যে বাসায় চলে যাব।’
গাজীপুর থেকে আসা ৫ বছর বয়সী সুমাইয়া কান্না করতে করতে বেহুশ হওয়ার অবস্থা। সে তার চাচার সঙ্গে বেড়াতে এসেছে। চাচার মোবাইল নম্বর জানা নেই, তাকে মধ্য বয়সী এক লোক তথ্য কেন্দ্রে নিয়ে আসেন।
ভাই রাজন ও ভাবি মাসুদার সঙ্গে কল্পনা আক্তার (৯) বেড়াতে আসে। চিড়িয়াখানায় প্রবেশের এক ঘণ্টা পর তাকে পেছন থেকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। ভাই ও ভাবি তথ্যকেন্দ্রে এসে কান্নাকাটি শুরু করেন। পরে কর্তৃপক্ষ মাইকিং করে শিশু কল্পনাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করেন।
এ বিষয়ে তথ্য কর্মকর্তা ডা. মো. ওয়ালিউর রহমান জাগো নিউজকে জানান, ঈদের পরদিন লক্ষাধিক দর্শনার্থীর আগমন ঘটছে এ বিনোদন কেন্দ্রে। এত সংখ্যক দর্শনার্থীর মধ্যে বিভিন্ন বয়সী ৩৫ থেকে ৪০ জনের মতো হারিয়ে যান। পরে মাইকিং করে হারানোদের পাওয়া গেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘চিড়িয়াখানায় বেড়াতে এসে প্রতিদিন ছোট ছোট শিশুরা হারিয়ে যাচ্ছে। এমনকি বয়োজ্যেষ্ঠরাও বাদ যাচ্ছেন না। হারিয়ে যাওয়া সদস্যকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করি।’
ওয়ালিউর রহমান বলেন, ‘অভিভাবক ও পরিজনদের অসতর্কতা এবং উপচেপড়া ভিড়ের কারণে অনেকে হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকে আবার দিগ্বিদিক ছোটাছুটির করে। এ কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।’ ছোট ছোট শিশুদের হাতছাড়া না করা এবং আরও বেশি সতর্কতার সঙ্গে চিড়িয়াখানায় আগতদের ঘোরাফেরার পরামর্শ দেন তিনি।
এফএইচ/এনডিএস/পিআর