জাতীয়

আত্মহত্যা নাকি হত্যা?

অস্বচ্ছল পারিবারিক অবস্থার উপর বোঝা ছিল বুদ্ধি প্রতিবন্ধী যুবতী মেয়ে। ঘরে রেখে বাইরে যাওয়া বিড়ম্বনার, যাকে আবার বাইরে নিয়ে যাওয়াও বিড়ম্বনার। আর্থিক টানাপড়েনের মধ্যে স্বামীর অকাল মৃত্যু, বিরাজমান সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যাকে তরান্বিত করেছিল। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন মা জাহানারা বেগম মুক্তা (৪৮)।

Advertisement

পুলিশ বলছে, সব অশান্তির যবনিকা টানতেই দুই সন্তানকে হত্যার পাশাপাশি নিজেও আত্মহত্যা করেন মা জাহানারা। মায়ের পরিকল্পনাতেই এ ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেশি, তবে অন্য কারণ এখনো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

গত ১২ মে রাতে রাজধানীর উত্তরখানের ময়নারটেক এলাকায় ৩৪/বি বাসার একটি ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে একটি ঘর থেকে মা জাহানারা বেগম মুক্তা (৪৮), ছেলে কাজী মহিব হাসান রশ্মি (২৮) ও মেয়ে আফিয়া সুলতানা মিমের (২০) গলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

ঘটনাস্থল থেকে জব্দ করা হয়, একটি রক্তাক্ত বঁটি, রক্তমাখা কাপড় ও তাদের ব্যবহৃত মোবাইলফোন।

Advertisement

পুলিশ জানিয়েছে, নিহত জাহানারা বেগমের স্বামীর নাম ইকবাল হোসেন। তাদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরবের জগন্নাথপুর উত্তরপাড়া এলাকায়। ইকবাল হোসেন বিআরডিবি অফিসের ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কর্মস্থল মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় হলেও পরিবার নিয়ে বি-বাড়িয়া শহরে বসবাস করতেন। ২০১৬ সালে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান ইকবাল। এরপর পথে বসার দশা হয় পরিবারটির।

ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। দুই মাস পর জাহানারা তার দুই সন্তানকে নিয়ে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের জগন্নাথপুর উত্তরপাড়ায় চলে গিয়েছিলেন। এরপর ফের সপ্তাহখানেক আগে ভৈরবের বাসা ছেড়ে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ঢাকার উত্তরখানের ময়নারটেক এলাকার ৩৪/বি বাসার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া উঠেছিলেন।

উত্তরখান থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে মুহিব হাসানের মামা মনিরুল হক বাদী হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন।

নিহতরা হত্যাকাণ্ডের শিকার নাকি আত্মহত্যা, সে বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত নয় পুলিশ। তিনটি মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ জানিয়েছে, মা ও মেয়েকে শ্বাসরোধে এবং ছেলেকে গলাকেটে হত্যা করা হয়েছে।

Advertisement

এ ব্যাপারে উত্তরখান থানার ওসি মো. হেলাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, মা মেয়ে ও ছেলের মরদেহ উদ্ধারের বিষয়টি চাঞ্চল্য ছড়িয়েছিল। পেটে ও গলায় মরদেহের কাটা দাগে মনে হয়েছিল হত্যা। তবে তদন্তে আত্মহত্যাই স্পষ্ট হচ্ছে।

সিআইডি'র ফরেনসিক ও রাসায়নিক পরীক্ষায় আত্মহত্যার আলামত মিলেছে। যদিও রিপোর্ট এখনো হাতে পাইনি। আবার ময়নাতদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদনও এখনো মেলেনি। সব রিপোর্ট পাবার পর শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যাবে মৃত্যুর কারণ।

তবে ওসি বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা ৮০ শতাংশ সত্যতা পাচ্ছি, তিনজনের মধ্যে কেউ দুইজনকে হত্যার পরে নিজেই আত্মহত্যা করেছে।

আত্মহত্যার নেপথ্যের কী কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পারিবারিকভাবে অস্বচ্ছল ছিল পরিবার। স্বামীর মৃত্যুর পর অবসর ভাতা নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়। পারিবারিক জমির পরিমাণও খুবই কম। অন্যদিকে ছেলে কিছু করতো না। মেয়েটি ছিল বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। যুবতী মেয়েকে ঘরে রেখে বাইরে যাওয়া ছিল তাদের জন্য বিড়ম্বনার, আবার বাইরে নিয়ে যাওয়াও বিড়ম্বনার। গোসল থেকে বেরিয়ে কখনো কখনো উলঙ্গ হয়ে মা ভাইয়ের সামনে বের হতো। যা ছিল খুবই বিব্রতকর। আর্থিক টানাপড়েন, সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যার কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল।

আত্মহত্যা বলার গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে- ঘরের দরজা ভেতর থেকে লক করা ছিল। বাইরে থেকে যে কেউ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে বের হবে সেই সুযোগ নেই। আমরা ধারণা করছি, পারিবারিক হতাশাগ্রস্ততা থেকেই এমন ঘটনা ঘটতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা দুটি চিঠিতেই একই লেখা। তবে একটি চিঠি নিহত ছেলের হাতের লেখার সঙ্গে মিলেছে এবং একটি খাতা থেকেই পাতা ছিঁড়ে চিঠি দুটি লেখার প্রমাণ পাওয়া গেছে।’

ডিএমপি'র উত্তরা বিভাগের দক্ষিণখান জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার হাফিজুর রহমান রিয়েল বলেন, ওই ঘটনায় পুলিশ সবদিক বিবেচনা করে তদন্ত কার্যক্রম চালাচ্ছে। তদন্ত শেষে মৃত্যুর মূল কারণ সম্পর্কে বলা যাবে।

জেইউ/এসএইচএস/পিআর