খেলাধুলা

ভক্তদের অকুণ্ঠ সমর্থন অনুযায়ী হলো না টাইগারদের ব্যাটিং

ভক্ত ও সমর্থকদের উৎসাহ-উদ্দীপনা, সমর্থন, গগনবিদারি চিৎকার, হাততালির সঙ্গে ওভাল ও তার আশপাশের এলাকা কাঁপিয়ে, ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ ধ্বনি ঠিকই শোনা গেল আগের ম্যাচের মতো। দক্ষিণ আফ্রিকার পর আজ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও প্রিয় জাতীয় দলকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে, উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করতে ওভালে এসেছেন হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি।

Advertisement

স্থানীয় সময় বেলা দেড়টা (বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা) থেকে ওভাল স্টেডিয়ামে সবুজ-লাল জার্সি গায়ে ১৫ হাজারের বেশি বাংলাদেশ সমর্থকের গলা শোনা গেল। জাতীয় পতাকাও উড়লো পৎপৎ করে।

কিন্তু যাদের উৎসাহ জোগাতে ভক্তদের এই প্রাণপন প্রচেষ্টা, সেই টাইগাররা ঠিক আগের ম্যাচের মত ব্যাটিং করতে পারেননি। সাকিব ছাড়া আর একজন ব্যাটসম্যানও তিরিশের ঘর পার হতে পারেননি। সাকিবও ৬০’র ঘরে গিয়ে অফস্টাম্পের বাইরে একটা আলগা ধরনে ডেলিভারির পিছু তাড়া করে উইকেট বিসর্জন দিয়ে ফিরে এসেছেন। আর তাতেই সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটেছে।

Advertisement

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৩৩০ রানের পাহাড়সমান স্কোর গড়া সম্ভব হলেও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩০০+ করা কঠিন হবে, তা অনুমিতই ছিল। কিউইদের বোলিং ইউনিট দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের চেয়ে ভাল। লুঙ্গি-রাবাদারা অযথা জোরে বল করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এদিক ওদিক বল করেন। অফস্টাম্পের বাইরে প্রচুর জায়গা মেলে।

কিন্তু নিউজিল্যান্ড ফাস্ট বোলাররা তাদের চেয়ে অনেক বেশী নিয়ন্ত্রিত বোলিং করেন। আলগা ডেলিভারি কম ছোড়েন। মোদ্দা কথা, দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে কিউই বোলিংটা একটু বেশি সমৃদ্ধ, টাইগারদের জন্য একটু বেশি ‘চ্যালেঞ্জিং’।

সমালোচকের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, ঐ বোলিং চ্যালেঞ্জ সামলাতে এবং সাফল্যের সাথে অতিক্রম করার জন্য যতটা মানসিক দৃঢ়তা, বড় ইনিংস খেলার দৃঢ় সংকল্প দরকার ছিল- বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা তা দেখাতে পারেননি। তামিম (২৪), সৌম্য (২৫), মুশফিক (১৯), মাহমুদউল্লাহ (২০) আর মিঠুন (২৬) সেট হয়েও বড় ইনিংস খেলতে পারেনি।

সাত ব্যাটসম্যানের পাঁচজন বিশের ঘরে আউট হলে সেই দলের বড় সড় স্কোর গড়া খুব কঠিন, প্রায় অসম্ভব। একজন মাত্র ব্যাটসম্যান পঞ্চাশের ঘরে পা রেখেছেন, তিনি সাকিব। স্কোর লাইন হয়ত আরও দীর্ঘ হতো, যদি সাকিব শেষ পর্যন্ত খেলতে পারতেন, তাও হয়নি। সাকিব একটি শতক এবং সঙ্গে যেকোনো একজন ব্যাটসম্যান ৩০-৪০ করলেই যে রানটা ৩০০’র আশপাশে চলে যেত। ক্রিকেট খেলাটা আসলে অঙ্কের। কখনো কখনো সরল অঙ্কের মতো, নামটা সরল হলেও কাজটা ‘গড়ল’। আজ সে সরল অঙ্ক কষতে গিয়েই তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে টাইগার ব্যাটসম্যানরা। ফলে পরিণতি যা হবার তাই হয়েছে। ইনিংস শেষ হয়েছে ২৪৪ রানে।

Advertisement

কথায় বলে, ‘সপ্তাহের সব দিন রোববার নয়’, মানে সব দিন সমান নয়। এটা শুধু প্রবচন নয়, বাস্তবও। গত ২ জুন ব্যাটিংয়ে সবই হয়েছিল। কেউ সেঞ্চুরি করতে পারেননি, শুধু সাকিব আর মুশফিক ৭০ + দুটি ইনিংস উপহার দিয়েছিলেন। বাকিরা সবাই সময়ের দাবি মিটিয়ে বল পিছু রান তুলেছেন। কিন্তু আজ তার কিছুই হলো না। তাই হাফ সেঞ্চুরি সাকুল্যে একটি।

আকাশের অবস্থা আর উইকেট যেমনই থাকুক না কেন, শুরু থেকে ঝুঁকি নিয়ে তেড়েফুঁড়ে শটস খেলা যাবে না, তার বদলে রয়ে সয়ে খেলতে হবে। প্রথম ১০ ওভারে রান করার চেয়ে উইকেট আগলে রাখাই হবে প্রথম লক্ষ্য। গত কদিনে অধিনায়ক মাশরাফি আর ওপেনার সৌম্য সরকারের কথা শুনে তাই মনে হয়েছে।

আজ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তামিম-সৌম্যর শুরুতেও ছিল সে কথারই প্রতিধ্বনি। দুজনই বাহারি আর চটকদার মারের চেয়ে বলের মেধা ও গুণ বিচার করে খেলায় মনোযোগী হলেন। একদম সতর্ক-সাবধানি শুরু যাকে বলে। মনে হলো, তামিম আর সৌম্য দুজনই ওয়েল সেট, উইকেটের গতি-প্রকৃতির সাথে মানিয়ে নিয়েছেন এবং ম্যাট হেনরি, ট্রেন্ট বোল্ট ও ফার্গুসনের গড়া কিউই ফাস্ট বোলিংয়ের বিপক্ষে ধীরে ধীরে খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে হাত খুলে শটস খেলতেও আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ ছন্দপতন।

প্রথম ভুল পথে পা বাড়ালেন সৌম্য সরকার। ২৫ বলে ২৫ রান করার পর সেই পুরনো রোগ মাথা চারা দিয়ে উঠলো। আবার হঠাৎ ক্রস খেলার সাঁধ জাগলো। ভাবলেন সেট হয়ে গেছি, বলও তেমন সুইং করছে না, দেখি না ক্রস ব্যাট চালিয়ে। লাগলে ছক্কা, কিন্তু না লাগলে যে ‘অক্কা’ পেতে হবে- তা বোধকরি মাথায় আনেননি সৌম্য। পরিণতি হলো খারাপ। পরিষ্কার বোল্ড হয়ে সাজঘরে। ১০ ওভার পুরো পার করা গেল না, ৮.৩ ওভারে ভাঙে উদ্বোধনী জুটি।

অথচ এই হেনরিকেই আগের ওভারগুলোয় তিন তিনটি দৃষ্টিনন্দন বাউন্ডারি হাঁকিয়ে বাংলাদেশ সমর্থকদের মনে সাহস সঞ্চার করেছিলেন সৌম্য। এই ম্যাট হেনরির করা আগের ওভারে অফসাইডে দুদুটি দারুণ বাউন্ডারির মারে মাঠ গরম করেছিলেন তিনি। প্রথমটি পয়েন্ট আর কভারের মাঝখান দিয়ে, পরেরটি এক্সট্রা কভার দিয়ে মাটি কামড়ে।

কিন্তু তারপর একদম নাগালের মধ্যে বল পেয়ে একটু সোজা ব্যাটে না খেলে ক্রস চালিয়ে দেয়া। তারও আগে একদম ব্যাটের কাছে বল পেয়ে সোজা ব্যাটে ডান পা সামনে এনে তুলে দেন। সোজা বোলারের মাথার ওপর দিয়ে বল এক ড্রপে চলে যায় সীমানার ওপারে।

সৌম্যর ১০০.০০ স্ট্রাইকরেটের ইনিংস শেষ হবার ঠিক ২৯ বল পর ৬৩.১৫ স্ট্রাইকরেটে ২৪ রানে আউট হলেন তামিমও। কিউই ফাস্ট বোলার ফার্গুসনের বলে পুল করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারার খেসারত দিলেন। বল আকাশে উঠে চলে গেল বোল্টের হাতে। ১৫ ওভার পুরো হবার আগে (১৩.২ ওভারে ৬০) আউট দুই ওপেনার।

তবে তাতে যে ‘মহাভারত অশুদ্ধ’ হয়ে গেল তা কিন্তু নয়। কিন্তু রান গতি আগের ম্যাচের চেয়ে থাকলো অনেক কম, মানে পাঁচেরও নীচে। সেখান থেকে ইনিংসকে সামনে এগিয়ে দেয়ার কাজটি সহজ ছিল না। উইকেট অক্ষত রাখার পাশাপাশি স্কোর বোর্ড সচল করা- সে কাজটি যে জুটি সবচেয়ে দক্ষতার সাথে করতে পারেন, সেই সাকিব আর মুশফিক এগুচ্ছিলেন ভালই।

একসময় মনে হলো আগের ম্যাচের মত আজও এই জুটিই বাংলাদেশকে নিয়ে যাবে বহুদূর। কিন্তু হঠাৎ ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট মুশফিক। বাঁহাতি স্পিনার মিচেল স্যান্টনারের বলে শর্ট কভারে ঠেলে নিজেই প্রায় অর্ধেক পিচ এগিয়ে গিয়ে আর ফিরতে পারলেন না। ওটা সিঙ্গেলস হয় না, বল গেছে ফিল্ডার সোজা। সাকিব ঠায় দাঁড়িয়ে ফিরে যেতে বললেন। কিন্তু বাঁদিকে থাকা বলকে দ্রুত ধরে কিপারের গ্লাভসে পাঠিয়ে মুশফিককে সাজঘরে ফেরত দিলেন মার্টিন গাপটিল।

বাংলাদেশের অনেক সংকট, দুর্যোগ আর প্রয়োজনে যার ব্যাট সবচেয়ে সচল, সেই মুশফিক রান আউট হলেন ৩৫ বলে ১৯ করে। ইনিংসের অর্ধেক শেষ হবার আগে (২৩.৫ ওভার) ১১০ রানে তামিম, সৌম্য আর মুশফিক আউট। খুব অল্প কথায় খারাপ না। আবার ভালোও না। সেখান থেকে পরের অংশে অনেক হাত খুলে খেলতে না পারলে আড়াইশ পাড় করা ছিল কঠিন।

সেই কঠিন কাজটি করতে প্রাণপন চেষ্টা করেছেন সাকিব। কিউই ফাস্ট বোলারদের বিপক্ষে আস্থা, আত্ববিশ্বাস নিয়ে খেলে সাকিব রীতিমত মাঠ গরম করে ফেলেছিলেন। বাংলাদেশের ভক্ত ও সমর্থকরা ‘বাংলাদেশ,বাংলাদেশ’ জয়োধ্বনিতে মাঠ গরম করার পাশাপাশি ‘সাকিব, সাকিব’ ধ্বনিও দিয়েছেন প্রচুর।

কিন্তু কিউই পেস বোলিং সামলে যেন ‘পঁচা শামুকে পা কাটলেন’ সাকিব। বোল্ট, হেনরি আর ফার্গুসনকে ইচ্ছেমত খেলে মাত্র ৫৪ বলে হাফসেঞ্চুরি পূর্ণ করা সাকিব শেষপর্যন্ত আউট হন জেন্টল মিডিয়াম পেসার কলিন ডি গ্র্যান্ডহোমের বাজে বলে। অফস্টাম্পের অন্তত এক ফুট বাইরের বলকে অযথা তাড়া করে সাকিব যখন কিপার লাথামের গ্লাভসে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরের পথে বাংলাদেশের স্কোর তখন ৪ উইকেটে ১৫১ (৩০.২ ওভার)।

শেষ ১১৮ বলে কত করবে বাংলাদেশ। বল পিছু রান তুললেও স্কোর গিয়ে ঠেকবে ২৭০’এ। এমন আশায় উন্মুখ হয়েছিলেন ভক্ত ও সমর্থকরা। ততদুর যেতে দরকার ছিল একটি বড় পার্টনারশিপের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হলো না।

হলো না একটি কারণে। মিঠুন (২৬) মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ (২০) আর মোসাদ্দেকের (১১) একজনও দায়িত্ব নিয়ে লম্বা ইনিংস খেলার চেষ্টা করলেন না। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে গত বিশ্বকাপ আর আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পরপর সেঞ্চুরি করা রিয়াদ বিশের ঘরে আউট হওয়ায় বড় স্কোর গড়ার সম্ভাবনা কমে যায় অনেকটা।

শেষ পর্যন্ত যা হলো (২৪৪) তা উইকেট, নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং আর বাংলাদেশের বোলিং শক্তির আালোকে কম। আরও গোটা তিরিশেক রান বেশি হলে তবু কথা ছিল। তারপরও এ রান নিয়ে লড়াই করা যাবে না, টাইগাররা জিততে পারবে না- এমন বলা যাবে না। খেলাটা ক্রিকেট, যার পরতে পরতে অনিশ্চয়তা। দেখা যাক কী হয়?

এআরবি/এসএএস