একে তো ঈদের আনন্দ, দ্বিতীয়ত-ঈদ উপলক্ষে বছরে দু-একবার পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে দেখার-মেশার সুযোগ হয়। তাই বিশেষ কোনো সমস্যা না থাকলে সবাই ছোটে আপনজনের কাছে। তারপরও কিছু মানুষ থেকে যায়, যারা আপনজনের কাছে ঈদেও ছুটে যেতে পারেন না।
Advertisement
বুধবার (৫ জুন) রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এবারের ঈদুল ফিতরেও অনেক কর্মজীবী, শ্রমজীবী মানুষ তাদের আপনজনদের কাছে যেতে পারেননি। আপনজন বিচ্ছিন্ন এই মানুষগুলোকে ঈদের দিনও নিজের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। দরিদ্রতা, কর্মজীবন, যোগাযোগ ব্যবস্থার করুণ বাস্তবতা তাদের কাজ থেকে মুক্তি দেয়নি।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কেউ কেউ কাজের ব্যস্ততায় ঈদের নামাজ পর্যন্ত আদায় করতে পারেননি। কারও কারও ভাগ্যে জোটেনি ঈদের বিশেষ কোনো খাবার, এমনকি সেমাইও। কেউ কেউ নিজে নিতে পারেননি নতুন কোনো কাপড়-চোপড়; বাড়িতে থাকা আদরের ছেলেমেয়ে, মা, স্ত্রীকেও দিতে পারেননি। আবার কারও কারও ইচ্ছা ও অর্থ থাকা সত্ত্বেও ছুটি না পাওয়ায় বাড়ি যাওয়া সম্ভব হয়নি।
পরিবার-পরিজনকে দূরে রেখে ঈদের দিন কেমন কাটল রাজধানীতে থাকা এসব মানুষের, তা জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো –
Advertisement
ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। এর মধ্যেই রাস্তার ধারে দুপুরে রাজধানীর বাড্ডা লিংক রোডের ছোট্ট এক খুপরিতে করে পান-বিড়ি বিক্রি করছিলেন নজরুল ইসলাম। বাড্ডার আদর্শনগরে থাকা নজরুল বলেন, ‘দ্যাশে যাই নাই। অভাবে আছি। দেহেন না, কী পরে (নিজেদের কাপড়ের দিকে তাকিয়ে) আছি।’
ফরিদপুরের মখুখালী উপজেলার বাগাট গ্রামে নজরুলের পরিবার-পরিজন থাকে। তার দুই ছেলে ও চার মেয়ে। তাদের মধ্যে বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ঈদে বাড়িতে কোনো টাকা-পয়সা পাঠাইতে পারি নাই। বাড়িতে খুব খারাপ অবস্থা। বাড়িতে সবাই ঈদ কীভাবে করতাছে, জানি না।’ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পান ছাড়া নিজেও কিছু খাননি বলেও জানান নজরুল।
নিরাপত্তা প্রহরীর খাবারে নেই ঈদের ছোঁয়া
Advertisement
ডিজিএসপিএল সিকিউরিটি সার্ভিসে চার বছর ধরে চাকরি করেন আব্দুর রব। ঈদে তার ছুটি মেলেনি। তিনি জানান, সকাল ৮টায় কাজে এসেছেন। কাজে থাকায় ঈদের নামাজ আদায় করতে পারেননি তিনি। তার খাবারেও নেই ঈদের কোনো ছোঁয়া।
নিরাপত্তা প্রহরীর দায়িত্বে থাকা আব্দুর রব বলেন, ‘সকাল ৮টায় বাসা থেকে বেরোয়ছি। যাব রাত ৮টায়। আজ সকালে ভাত খাইছি। দুপুরের জন্য খাবার নিয়ে আসছি।’ যেখানে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন এবং যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, কেউ ঈদের দিনের তার জন্য বিশেষ কোনো খাবারের আয়োজন করেননি বলেও জানান রব।
‘ঈদেও আমরা এক লগে হইতে পারলাম না’
বৃদ্ধা মা, ১১ বছর বয়সী ছেলে আর গাজীপুরে থাকা স্ত্রীকে রেখে ঈদের দিন ঝুম বৃষ্টির মাঝেই মাথায় পলিথিন বেঁধে রিকশা চালাচ্ছিলেন মো. শফিকুল ইসলাম। তার পরনের শার্ট তখনও ভেজা। হালকা বৃষ্টিও ছিল। দুপুর ২টার দিকে শফিকুল বলেন, ‘সকালে খালি একটু সেমাই খাইছি। মহাজন (রিকশার মালিক) দিছে। তারপরে চা-পান খাইছি। আর কিছু খাই নাই।’
কুড়িগ্রামের রাজারহাট থানায় গ্রামের বাড়িতে অন্যের জমিতে শফিকুলের বৃদ্ধা মা আর ছেলে থাকে। গাজীপুরে থাকেন তার স্ত্রী। তিনি থাকেন রাজধানীর নতুন বাজার এলাকায়। শফিকুল বলেন, ‘ঈদেও আমরা সবাই এক লগে হইতে পারলাম না। দেহি, কাল গাজীপুর যামু। ওইহানে স্ত্রী থাহে।’
ঈদের দিন রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় এ রকম অসংখ্য রিকশাচালককে দেখা যায়। যারা পরিবার ছিন্ন হয়ে বৃষ্টিতে ভিজে এভাবেই রিকশা চালাচ্ছেন।
ছোট্ট ছেলে-মেয়েকে রেখে একা ঈদ গাড়িচালক বাবার
স্মার্ট উইনারের চালক সুমন ফকির। ছোট এক ছেলে, এক মেয়ে, তার স্ত্রী ও বাবা-মা বরিশালের গৌর নদীর গ্রামের বাড়িতে ঈদ করছে। আর তিনি একাই আছেন ঢাকায়। ঈদের এমন দিনে ভোর ৬টায় তিনি বেরিয়েছেন গাড়ি নিয়ে। সকালে জুটেছিল একটু সেমাই আর রুটি। আজিমপুরে ঈদের নামাজ আদায় করলেও দুপুর আড়াইটার সময় যখন তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন পর্যন্ত সকালেই খাবারেই ছিলেন তিনি।
সুমন ফকির বলেন, ‘পরিবারের সবাইকে রেখে ঈদের দিন কাটাইতেছি। খারাপ লাগব না?’
‘টাকা-পয়সার সমস্যা দেখেই তো যাই নাই। কাল না গেলেও পরশু যামু’, যোগ করেন এই গাড়িচালক।
ডাব বিক্রি করে কাটল ঈদের দিন
বুধবার সকালবেলা ডাবগুলো আড়ত থেকে কিনে সাড়ে ৮টার দিকে কারওয়ান বাজারের পেট্রোবাংলার ওখানে বসতেই শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি। বিকেল ৫টার দিকে যখন ডাববিক্রেতা মো. আশরাফ আলীর সঙ্গে কথা হয়, তখন পর্যন্ত তার অর্ধেক ডাব বিক্রি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টি না হলে সকালেই ডাবগুলা শেষ হয়ে যেত।’
বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় থাকা পরিবারের সঙ্গে আশরাফ আলীও ঈদ করতে পারেননি। পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল, টাকা-পয়সারও তেমন একটা সমস্যা ছিল না তার। তারপরও বাড়িতে যাওয়া সম্ভব হয়নি। এর কারণ ব্যাখ্যা করে বৃদ্ধ আশরাফ বলেন, ‘যাইবার চাইছিলাম। গাড়ির সমস্যা, ভাড়া চায় বেশি, আবার শুনছিলাম, যানজটও আছে। বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত গেছিলাম, এই অবস্থা দেইখা যাইবার পারলাম না। আমার লগে যে ছিল, হেরে পাঠাইয়া দিছি। বলছি তুই যা, আমি এইভাবে যাইবার পারমু না।’
সিঙ্গারা-পুরি খেয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ঈদ
ঈদের দু-একদিন আগেই বরবটি ও কয়েক মণ শসা কিনেছিলেন রংপুরের পীরগঞ্জের আব্দুর রশিদ। সেগুলো নিয়ে মঙ্গলবার (৪ জুন) বিকেল ৩টায় রংপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। যানজট থাকায় রাস্তায়ই মালামাল কিছু নষ্ট হয়ে যায়। বাকিগুলোর অবস্থাও খারাপ হয়ে যায়। এ দিকে বুধবার সকাল থেকে বৃষ্টি থাকায় বিক্রিও করতে পারেননি তিনি।
বুধবার বিকেলে যখন কারওয়ান বাজারের কাঁচা বাজারে বসেছিলেন, তখন আব্দুর রশিদের চোখে-মুখে রাজ্যের বিষণ্নতা ভর করেছিল। তিনি বলেন, ‘ঈদের নামাজও পড়তে পারি নাই। এখানেই ছিলাম। শুধু একটা খাবারের দোকান খোলা ছিল। সেখানে সারাদিন সিঙ্গারা-পুরি খেয়েই কাটিয়ে দিলাম। ঈদের ভালো-মন্দ খাওয়া-দাওয়া এবার হয় নাই।’
যেমন কাটছে আনসার সদস্যদের ঈদ
ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীর বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে চেপে কত মানুষই তাদের আপনজনের কাছে গেছে। নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনের সময় তারা দেখেন, দূর থেকে আসা মানুষের আপনজনের কাছে ছুটে যাওয়া। দায়িত্ব পালনে তখনও তারা স্টেশনেই ছিলেন। ঈদের দিনও বিমানবন্দর স্টেশনেই নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছিলেন আনসার সদস্য জিল্লুর রহমান ও আহাদুল ইসলাম।
তারা জানান, আনসার সদস্যদের শতকরা ২০ জন এবার ঈদ করতে ছুটি পেয়েছে। তারা ছুটি থেকে আসলে আরেক ব্যাচ ঈদ করতে যাবে। এভাবে সবাইকে ঈদের ছুটি দেয়া হবে।
ভোর ৬টায় কাজ শুরু করেছেন। সকালে তাদেরকে নাস্তা হিসেবে সেমাই আর মুরগির মাংসের ভুনা খিচুড়ি দেয়া হয়েছে। দুপুরে দেয়া হবে গরুর মাংস দিয়ে খাবার বলেও তারা জানান।
জিল্লুর রহমান বলেন, ‘পাবনার গ্রামের বাড়িতে আমার দুই মেয়ে, স্ত্রী, মা ও এক ভাই আছে। সবার জন্য টাকা-পয়সা পাঠাইছি। সবাই জামা-কাপড় কিনছে। একটু আগেও মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথা কইলাম। আর চাকরি করলে তো ডিউটি করতেই হবে।’
টাঙ্গাইলের ধনবাড়িতে বাবা-মা, ভাইবোন, সন্তান-স্ত্রী রয়েছে আহাদুল ইসলামের। তিনি বলেন, ‘সবারই তো মনের মধ্যে ইচ্ছা থাকে, পরিবার নিয়া ঈদের দিনডা পার করব। চাইলে কী আর সবার ভাগ্যে ঈদ জোটে? এটা সরকারি কাজ। জনগণের স্বার্থে ডিউটি করতাছি।’
প্রতিটি ঈদে দেশের একটা অংশ আনন্দ-উল্লাস করে ঠিকই, একটা অংশের মানুষ এভাবে ঈদ-আনন্দ থেকে বঞ্চিতও থেকে যায়।
পিডি/এসআর/এমএস