আজ (৫জুন) বিশ্ব পরিবেশ দিবস। তাই বায়ু দূষণকে গুরুত্ব দিয়ে এবারের পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘বায়ু দূষণ’। বায়ু দূষণ নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা ‘স্টেট অফ গ্লোবাল এয়ার’। তাদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বায়ু দূষণের ভয়াবহতার বিষয়টি উঠে এসেছে। যেখানে দেখা গেছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বাসিন্দাদের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে বায়ু দূষণের মধ্যে বাস করছে। বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ।
Advertisement
বিশ্বের সবচেয়ে বায়ু দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ১৭তম হলেও দূষিত দেশের তালিকায় প্রথম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের ৫ মার্চ প্রকাশিত আইকিউএয়ার, এয়ারভিস্যুয়ালের এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। অ্যাটমস্ফেরিক পার্টিকুলেট ম্যাটার ‘পিএমটুপয়েন্টফাইভ’-এর মাত্রা সর্বোচ্চ ১০০ ধরে এ তালিকায় ৯৭ দশমিক ১ শতাংশ পেয়ে বাংলাদেশ রয়েছে দূষিত দেশের মধ্যে শীর্ষস্থানে। এরপর যথাক্রমে ৭৪ দশমিক ৩ ও ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ পেয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান ও ভারত। ঢাকার আশপাশে যে ইটভাটা গড়ে উঠেছে সেই ভাটাগুলো, নির্মাণ সামগ্রী এবং ট্রাফিক বায়ু দূষণের জন্য দায়ী।
বিশেষজ্ঞদের মতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বায়ু দূষণের জন্য মারাত্ম হুমকি হয়ে উঠেছে বা উঠবে। বাতাসে ভাসমান বস্তু কণার পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘন মিটারে মাইক্রোগ্রাম হিসেবে। সম্প্রতি পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ২.৫ মাইক্রোমিটার আকৃতির ভাসমান যার সহনীয় পরিমাণ হচ্ছে ৫০ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনফুট। উপরন্তু ঢাকার বাতাসে ক্যাডমিয়াম প্রায় ২০০ গুণ বেশি, নিকেল ও সিসার মাত্রা প্রায় দ্বিগুণ ও ক্রোমিয়াম প্রায় ৩ গুণের বেশি। পরিসংখ্যান হতে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে বাতাসে দূষণের পরিমাণ কত ভয়াবহ।
পরিবেশ অধিদফতরের এক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, ঢাকা শহরের বায়ু দূষণের জন্য ইটভাটা দায়ী ৫৮ শতাংশ, ডাস্ট ও সয়েল ডাস্ট ১৮ শতাংশ, যানবাহন ১০ শতাংশ, বায়োমাস পোড়ানো ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য উৎস ৬ শতাংশ দায়ী।
Advertisement
বায়ু দূষণের তথ্য উঠে এসেছে আরেকটি আন্তর্জাতিক গবেষণাতেও। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট (এইচইআই) এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশনের (আইএইচএমই) যৌথ উদ্যোগে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, বায়ু দূষণের কারণে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে অন্তত ১.২৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্বজুড়ে একযোগে প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৯’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
চারপাশের বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশিদের আয়ু প্রায় ১.৩ বছর কমে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এই প্রতিবেদন তৈরি করার সময় ১৯৯০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বে বায়ুর গুণগতমান বিষয়ক তথ্য নিয়ে কাজ করা হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তান পৃথিবীর দূষিত দেশের তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। এসব দেশের ১.৫ মিলিয়নের বেশি মানুষের বায়ু দূষণের কারণে মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ৩ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর জন্য সরাসরি পিএম ২.৫ উপাদান দায়ী। বাংলাদেশের জনগণ ১৯৯০ সাল থেকে পিএম ২.৫ মাত্রার মধ্যে বসবাস করছে।
বায়ু দূষণ নিয়ে কথা বলেছেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আব্দুল্লাহ আল মারুফ। তিনি জানান, বায়ু দূষণের কারণে হৃদরোগ, কাশি, নিউমোনিয়াসহ ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ, ফুসফুসের ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা ও ব্রনকাইটিস ঘনঘন বেড়ে যাওয়া, চোখে ছানি পড়া, চোখ, নাক, কান, গলার সংক্রমণ, শিশু ও গর্ভবতী নারীদের সমস্যা হতে পারে। যতগুলা দূষণ আছে তার মধ্যে বায়ু দূষণ মারাত্মকভাবে দায়ী।
Advertisement
ওই চিকিৎসক আরও জানান, বায়ু দূষণের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অন্যতম। শুধু ২০১২ সালেই সারা পৃথিবীতে ৭ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে বায়ু দূষণে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরবিশে আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল জাগো নিউজকে জানান, ঢাকা শহরে বায়ু দূষণের পরিমাণ সব চেয়ে বেশি।
তিনি বলেন, আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যে মহা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি সেখানে বড় বড় নির্মাণ কাজ এবং পাওয়ার প্লান্ট আছে বড় একটা অংশজুড়ে, এইসব কাজ করতে দিয়ে বায়ু দূষণ আরও বাড়ছে। একেত দূষণের মাত্রা অতিরিক্ত তার উপর নতুন করে চাপ বাড়ছে। যেহেতু বাতাস দূষিত হচ্ছে তাই ঘরে থাকলেও তা গ্রহণ করতে হচ্ছে।
এই পরিবেশ নেতা জানান, বায়ু দূষণ রোধ করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সবার আগে নতুন করে যেন বায়ু দূষণ না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। সেইসঙ্গে প্রচুর বনায়ন করতে হবে। ইট ভাটায় কয়লা পোড়ানো বন্ধ করতে হবে।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক পরিবেশ বিজ্ঞানী ও বায়ু বিশেষজ্ঞ ড. বিশ্বাস করবী ফারহানা জাগো নিউজকে জানান, বায়ু দূষণ যে মারাত্মক ক্ষতিকর তা আমরা অনেকেই জানি। এর ক্ষতিকর নানা দিক আছে। কিন্তু এর অন্যতম ভয়ংকর এক ক্ষতিকারক দিক হচ্ছে এসিড বৃষ্টি। এসিড বৃষ্টি হলে ফসল, মাটি, গাছপালা এমনকি জলাশয়ের মারাত্মক ক্ষতি হয়।
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, বায়ু দূষণের ফলে বাতাসে যে ক্ষুদ্র ধুলিকনা জমে তা এত সুক্ষ্ম যে বাতাসের সঙ্গে মিশে যায়। পরে প্রাণীর শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সরাসরি ফুসফুসে বাসা বাঁধে।
গ্রামের বায়ু দূষণ নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, এক সময় গ্রামের অবস্থা ভালো থাকলেও বর্তামানে তা নেই। বায়ু দূষণ থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে দূষণের উৎপত্তিস্থল বন্ধ করা এবং দূষণ রোধে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কাজে লাগানোর উপর গুরুত্ব দেন তিনি।
এফএ/পিআর