খেলাধুলা

ম্যাককালাম, আপনি ভালোই করেছেন!

খেলার জগতে ‘সুইচ অন-সুইচ অফ’ বলে একটি কথা আছে। মাঠে যখন খেলা চলে কিংবা একটি টুর্নামেন্ট শুরুর ঘণ্টা বেজে যায়, খেলোয়াড়দের কাছে তখন খেলাটাই আসল। সুইচটা তখন অন করতে হয় শুধু খেলার দিকেই। মনোযোগ নাড়িয়ে দেয় এমন বিরক্তিকর, বিতর্কিত যে কোনো বিষয় থেকে সুইচটাকে অফ করে রাখতে হয়।

Advertisement

আমার মনে হয় না বাংলাদেশ দল বিশ্বকাপে নিজেদের সূচনা ম্যাচে নামার আগে ব্রেন্ডন ম্যাককালাম কী বললেন না বললেন সেটি নিয়ে খুব বিচলিত ছিল। এমন হতে পারে ম্যাককালামের কথাটা মাশরাফিদের কানেই যায়নি!

ম্যাককালাম বলেছেন, এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ জিততে পারে একটি মাত্র ম্যাচ, সেটিও হয়তো ইতিহাসের দুর্বলতম শ্রীলঙ্কান দলের বিপক্ষে। সাবেক নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক ইংল্যান্ডের কন্ডিশন বিবেচনায় ১০টি দলের শক্তি–দুর্বলতা বিশ্লেষণ করেছেন, সেই বিশ্লেষণ থেকেই দলগুলো সম্পর্কে করেছেন ভবিষদ্বাণী।

তা তিনি করতেই পারেন। এই গ্রহের যে কোনো মানুষই ভবিষদ্বাণী করতে পারেন, এটি ব্যক্তির অধিকার। আর খেলাটা যখন ক্রিকেট এবং ক্রিকেটের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা, ম্যাককালামের মতো কেউ তো গলা চড়িয়ে কথা বলতেই পারেন।

Advertisement

মাত্রই আগের বিশ্বকাপে ‘চিরকালের সেমিফাইনালিস্ট’ নিউজিল্যান্ডকে প্রথমবারের মতো নিয়ে গেছেন ফাইনালে। সেখানে শিরোপা জয়ের স্বপ্নটা যদিও ভেঙে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। তাতে কী? আধুনিক ক্রিকেটের ইতিহাসে ম্যাককালাম নিজের নামটিকে যে ঔজ্জ্বল্য দিয়েছেন, সেটি তাতে ম্লান হয় না একটুও।

১০১টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন, ওয়ানডে ও আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ২৬০ ও ৭১। আক্রমণাত্মক ক্রিকেটের নতুন সংজ্ঞাই তিনি দিয়েছেন। ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ম্যাচটিতে দ্রুততম টেস্ট সেঞ্চুরি করেছেন (৫৪ বলে ১০০, বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, ২০১৬)। আইডল ভিভ রিচার্ডসের মতো তারও দর্শন ছিল, ব্যাটের কাজ বলকে প্রহার করা।

আইপিএল নামের যে মোহনীয় ক্রিকেট আজ আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে, সেই আইপিএলের প্রথম ম্যাচেই করেছিলেন ১৫৮ রান। ১২০ বলের ম্যাচে দেড় শতাধিক রানের ইনিংস। ভেবে দেখুন! সুতরাং এই ম্যাককালাম যখন কিছু বলেন, গুরুত্ব তো সেটিকে দিতেই হয়।

গুরুত্ব আমরা মনে হয় একটু বেশিই দিচ্ছি। আমরা বলতে বাংলাদেশের ক্রিকেট জনতা। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশের গণশত্রু হয়ে উঠেছেন নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের নতুন অধ্যায়ের নায়ক। মৌচাকে যেন ঢিল ছুঁড়েছেন ম্যাককালাম। ক্রিকেট এ দেশের মানুষের অন্তরের কতটুকু অধিকার করেছে এটি হয়তো তিনি জানতেন না। জানতেন না সাকিব-তামিম-মুশফিকদের ব্যাটের ছন্দে এ দেশের নিঃশ্বাস পড়ে, মাশরাফি-মোস্তাফিজদের বোলিংয়ে ওঠা-নামা করে রক্তচাপ। জানতেন না ২০১৫ বিশ্বকাপের পরের সময়টা মাশরাফি-সাকিবদের কতটা বদলে দিয়েছে। ম্যাককালাম বুঝতে পারেননি শুধু নিউজিল্যান্ডের মাঠের ফল দিয়ে তামিম-মুশফিকদের ক্রিকেটটকে বিচার করাটা ঠিক নয়। হয়তো এটাও ভেবে দেখেননি একই রকমের জল-হাওয়ায় প্রায় নিখুঁত ক্রিকেট খেলে ত্রিদেশীয় সিরিজের ট্রফি জিতে বিশ্বকাপে গেছে বাংলাদেশ।

Advertisement

যে সিরিজের ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, যাদের বলা হচ্ছে এই বিশ্বকাপের কালো ঘোড়া। শুধু তো ফাইনালেই নয়, লিগ পর্বের দুটি ম্যাচেও এই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বাংলাদেশ হারিয়েছে সু-স্পষ্ট আধিপত্য দেখিয়ে।

২০১৫ বিশ্বকাপে বড় কোনো প্রত্যাশা ছিল না। বাংলাদেশ তবু কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে। সেই দলটিই যখন মাঝের চার বছরে পরিণত হয়েছে আরো, ঘরে-বাইরে খুব ভালো ক্রিকেট খেলছে, ২০১৯ বিশ্বকাপ তাদের আশার সীমাটা আরো বাড়াবে এটিই তো স্বাভাবিক।

ম্যাককালাম এটি ভেবে দেখেছেন কি না জানি না। জানি না এটিও ভেবেছেন কি না যে, ওয়ানডে র্যাংকিংয়ের সাত নম্বর জায়গাটা এমনি এমনিই বাংলাদেশের অধিকারে নেই এত লম্বা সময়ের জন্য। নেপথ্যে আছে ধারাবাহিক ভালো খেলার অবদান, খেলোয়াড়দের নিবেদন এবং কোচিং স্টাফদের দারুণ হোমওয়ার্ক।

খেলোয়াড়দের এই নিবেদন, দায়বদ্ধতা এবং হোমওয়ার্ক- এ সবেরই যোগফল, কেনিংটন ওভালে ২ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের অসাধারণ জয়।

জয়টা বেশি করে মাধুর্য ছড়াচ্ছে আরও দুটি কারণে। এক, নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ রান (৩৩০) এসেছে এই ম্যাচে। দুই, নিজেদের রণকৌশলকে কাজে লাগানো গেছে ঠিকঠাক। প্রথম চার ম্যাচের যে একপেশে ফল বিশ্বকাপকে ম্যাড়মেড়ে বিরক্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, বাংলাদেশের ছোঁয়াতেই তাতে সঞ্চারিত হয়েছে রোমাঞ্চ।

টসজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকা ভেবেছিল বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ে নামিয়ে শর্টপিচ বাউন্সার এবং সুইংয়ের সাঁড়াশি আক্রমণে চুরমার করবে। একপ্রান্তে কাগিসো রাবাদা এবং আরেক প্রান্ত থেকে লুঙ্গি এনগিদির বোলিং বলছিল সেটাই; কিন্তু তামিম-সৌম্য এই বাউন্সার এবং সুইং কী স্বচ্ছন্দেই না সামলালেন!

সামলানো বলতে সামলানো, পুল-হুক, ড্রাইভ, কাট খেলে রান করে গেলেন দ্রুত গতিতে। পরের ব্যাটসম্যানদের জন্য গড়ে দিলেন দারুণ এক মঞ্চ। প্রথম ১০ ওভারের পর ওই সুইং যখন ভোঁতা, বাউন্সারও অকার্যকর, মঞ্চে আবির্ভূত হলেন সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহীম। এঁদের দু’জনের ব্যাটের দাপটেই মূলতঃ দক্ষিণ আফ্রিকার ‘প্ল্যান এ’ কিংবা ‘প্ল্যান বি’ ভন্ডুল।

তৃতীয় উইকেটে ১৪২ রানের জুটি গড়ে বিশাল একটা রানের আয়োজন সেরে রেখেছিলেন সাকিব-মুশফিক। কনিষ্ঠ সতীর্থ মোসাদ্দেকের সহযোগিতায় ‘দ্য ফিনিশার’ মাহমুদউল্লাহ সেটিকে পূর্ণতা দিয়ে দলকে তুলে দেন ৩৩০ রানের চূড়ায়।

এই দূরতিক্রম্য লক্ষ্যে পৌঁছানো কোনো দলের পক্ষেই সহজ নয়। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা সেদিকে কখনোই টগবগ করে ছুটতে দেননি প্রোটিয়াদের। হাতের রাশটা কখনো আলগা হতে দেননি। চাপটা ধরে রেখেছেন আগাগোড়াই। এ কাজে তাকে নিরলস সাহায্য করে গেছেন বাঁ-হাতি পেসার মোস্তাফিজ, ডানহাতি পেসার সাইফউদ্দিন- তাদের নিস্তব্ধও করে দিয়েছেন এঁরা দুজন ।

নতুন বল হাতে দুর্দান্ত ছিলেন অফ স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ, বাঁ-হাতি স্পিনে সাকিব যথারীতি উজ্জ্বল। এঁদের স্পিন কখনোই চড়ে বসার সুযোগ দেয়নি ফ্যাফ ডু প্লেসির দলকে। অনিবার্য পরিণতি দক্ষিণ আফ্রিকার পরাজয়।

বাংলাদেশের এই জয়কে আপনি যদি অঘটন বলেন, আমরা বলব আপনি এই সময়ের ক্রিকেটের নিবিষ্ট অনুসারী নন। আপনি চোখে পরে আছেন ব্রাহ্মণ্যবাদী আদি ক্রিকেট মানসিকতার ঠুলি। বলুন, বড় দলের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়কে অঘটন বলে যেতে থাকুন আপনি। কোনো আপত্তি নেই।

শুধু এটুকুই বলব, বাংলাদেশের হাতে এমন অঘটন তাহলে নিয়মিতই আপনি দেখবেন। দেখতে দেখতে ক্লান্ত হবেন। এই বাংলাদেশ সেই আগের বাংলাদেশ নেই। বিশেষ করে খেলাটা যখন ৫০ ওভারের ক্রিকেট। বুধবার আশা করি নিউজিল্যান্ডও অন্য এক বাংলাদেশকে দেখবে।

ধারণা করছি, বাইরের জগত থেকে সুইচটা অফই করে রেখেছেন মাশরাফিরা। তারা খবরের কাগজ পড়ছেন না। টেলিভিশনে টিভি পন্ডিতদের অম্ল-মধুর কথাও শুনছেন না। তবু এ কান ও কান হয়ে ম্যাককালামের কথাগুলো তাদের কানে না পৌঁছে পারেই না। তাতে তেতে ওঠার সম্ভাবনা না হয় বাদই দিলাম; কিন্তু সতর্ক তারা একটু হবেনই।

এদিক দিয়ে ভালোই করেছেন ম্যাককালাম। বাংলাদেশ দলকে সতর্ক করেছেন, নিজেদের সেরা ক্রিকেটটা খেলতে অনুপ্রাণিত করেছেন। আরেকটা কথা বলি, আপনার উত্তরসূরিদের মূল অস্ত্র পেস বোলিংকে রুখে দাঁড়ানোর কৌশলও শেখা হয়ে গেছে তামিম-সৌম্যদের। দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচই সেটির প্রমাণ।

দেখা যাক ৫ জুন, ঈদ উৎসবের রাতটিতে লন্ডনের দ্য ওভাল নিউজিল্যান্ড ম্যাচে বাংলাদেশকে কী দেবে বলে সাজিয়ে রেখেছে!

লেখক : বিশিষ্ট ক্রীড়া সাংবাদিক

আইএইচএস/পিআর