ঢাকাই চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তি তিনি। এ দেশে যখন সেলুলয়েডের ফিতায় ভাসতে শুরু করেছিল বাঙালির জীবনের নানা অনুভূতি, সেই সব গোড়াপত্তনের সময়টাতেই চলচ্চিত্রে তার আগমন। বাকিটুকু কেবলই ইতিহাস।
Advertisement
তিনি নিজেকে ঋদ্ধ করেছেন বৈচিত্র্যময় চরিত্রে। তার সেই সব চরিত্র দিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশের সিনেমা।
দেবদাসের চন্দ্রমুখী হয়ে যেমন তিনি আবেদন ছড়িয়েছেন তেমনি ‘পথহারা পাখি কেঁদে ফিরে একা/আমার জীবনে শুধু আঁধারের লেখা’ কাজী নজরুল ইসলামের এই বিখ্যাত গানে অভিনয় করে নবাব সিরাজউদ্দৌলা সিনেমায় আলেয়া চরিত্রে তিনি পেয়েছেন দর্শকের ভালোবাসা, আশ্রয়।
খান আতার এই ঐতিহাসিক সিনেমায় সিরাজউদ্দৌলা নাম ভূমিকায় অভিনয় করে মুকুটহীন নবাবের খেতাব পেয়েছিলেন আনোয়ার হোসেন। পাশাপাশি বাঈজী আলেয়া চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক খ্যাতি লাভ করেছিলেন তৎকালীন বাংলা চলচ্চিত্রের একেবারেই নবীন মুখ। তিনি সবার প্রিয় আনোয়ারা।
Advertisement
আজ এই অভিনেত্রীর জন্মদিন। ১৯৪৮ সালের ১ জুন কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা জামাল উদ্দিন ও মা ফরিদুন্নেসা। তার বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে।
ষাটের দশকে বাংলা চলচ্চিত্রে আনোয়ারার আগমন ঘটে একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবে। ১৯৬১ সালে ১৪-১৫ বছর বয়সে অভিনেতা আজিমের মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্রে আসেন। এসময় তিনি পরিচালক ফজলুল হকের ‘আজান’ চলচ্চিত্রে প্রথম নৃত্যশিল্পী হিসেবে কাজ করেন।
চলচ্চিত্রটি মুক্তি দেওয়ার সময় এর নাম পরিবর্তন করে ‘উত্তরণ’ রাখা হয়। তবে ‘উত্তরণ’ চলচ্চিত্রটি পরে মুক্তি পায়নি। আনোয়ারা অভিনীত প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘নাচঘর’। এ চলচ্চিত্রেও তিনি নৃত্যশিল্পী হিসেবে কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আবদুল জব্বার খান ছিলেন এ চলচ্চিত্রের পরিচালক। উর্দু ভাষার এ চলচ্চিত্রটি ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায়।
একই বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘প্রীত না জানে রীত’ চলচ্চিত্রেও নৃত্যশিল্পী হিসেবে ছিলেন। এরপর তিনি বেশকিছু উর্দু ও বাংলা চলচ্চিত্রে কাজ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি জহির রায়হানের ‘সঙ্গম’ চলচ্চিত্রে প্রথম সহ-অভিনেত্রী হিসেবে অভিনয় করেন।
Advertisement
১৯৬৫ সালে ‘জানাজানি’ ছবিটি মুক্তি পায়। এখানে তিনি শওকত আকবরের বিপরীতে কাজ করে আলোচনায় আসেন।
১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘বালা’ নামের চলচ্চিত্রে প্রথম নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন আনোয়ারা। তার বিপরীতে ছিলেন হায়দার শফি।
নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা চলচ্চিত্রটি ছিল আনোয়ারার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। এ চলচ্চিত্রে তিনি আলেয়া চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের অন্তরে স্থায়ী আসন গড়ে নেন। এ ছবি তাকে আলেয়া খ্যাতি এনে দেয়।
চলচ্চিত্রটি লাহোর, করাচি, কোয়েটা, মুলতান, পেশোয়ারে মুক্তির পরে তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানেও আনোয়ারার নামধাম ছড়িয়ে পড়ে। এর পরে বহুবার নবাব সিরাজউদ্দৌর মঞ্চায়ন হয়েছে। আলেয়া চরিত্রে তিনি ছিলেন নির্ধারিত।
আনোয়ারার চলচ্চিত্র জীবনের আরও ৩টি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হচ্ছে ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ১৯৮২ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দেবদাস’ ও ১৯৮৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শুভদা’।
গোলাপী এখন ট্রেনে চলচ্চিত্র দিয়ে ১৯৭৮ সালে সেরা পার্শ্বচরিত্রে অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন আনোয়ারা। এ চলচ্চিত্রে তিনি ‘ময়না বু’ চরিত্রে অভিনয় করেন।
চাষী নজরুল ইসলামের ‘দেবদাস’ চলচ্চিত্রে তিনি চন্দ্রমুখী চরিত্রে অভিনয় করেন। একই পরিচালকের ‘শুভদা’ চলচ্চিত্রে তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। এ চলচ্চিত্রটি ১৯৮৭ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অনুষ্ঠানে সেরা চলচ্চিত্রসহ ১১টি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। আনোয়ারা এ চলচ্চিত্রে সেরা অভিনেত্রী হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৭২ এর পরে তিনি ভাবী, চাচি, শাশুড়ি ও মায়ের চরিত্রেই বেশি উপস্থিত হয়েছেন। এই চরিত্রগুলোতেই তিনি বেশি সফল হয়েছেন বলে মনে করেন। প্রায় পঞ্চাশ বছরের অভিনয়জীবনে সাড়ে ছয়শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এই কিংবদন্তী।
সিনেমা ছাড়াও অসংখ্য মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছেন ও বেশকিছু টেলিভিশন নাটকেও কাজ করেছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে একবার সেরা অভিনেত্রীসহ মোট আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি।
ব্যক্তি জীবনে ১৯৭২ সালে মুহিতুল ইসলাম মুহিতের সাথে আনোয়ারার বিয়ে হয়। তাদের একমাত্র সন্তানের নাম মুক্তি। তিনিও একজন অভিনেত্রী। তার একমাত্র নাতনী কারিমা ইসলাম দরদী।
সারাটা জীবন অভিনয়ের পেছনেই সময় দিয়েছেন। এর প্রভাব পড়তো নিজের সংসারে। সে নিয়ে একটি গণমাধ্যমে সাক্ষাতকারে আনোয়ারা বলেন, ‘প্রথম প্রথম তো আমার স্বামী খেপে অস্থির হয়ে যেতেন। তাঁকে বুঝিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বলতাম, ‘হাতের ছবিগুলো শেষ করে নতুন ছবি নেব না। এগুলো শেষ না করলে পরিচালক বিপদে পড়বেন।’ মেনে নিতেন তখন।
মাঝে মাঝে নিজের বিপদ ডেকে আনতাম দুষ্টুমি করতে গিয়ে। একবার শুটিং থেকে ফিরে বললাম, ‘জানো, আজ যে আমার স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করেছে সবাই বলছে- আমাদের নাকি দারুণ মানিয়েছে।’ যাহ! আর যায় কোথায়? দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলেন। একটাই কথা আর অভিনয় করা যাবে না। আমি বললাম, ‘স্ত্রী-ভাবির চরিত্র বাদ দাও, মায়ের চরিত্রগুলো অন্তত করি, নয়তো নানি-দাদি হই।’
তা-ও করা যাবে না বলে চিত্কার করে উঠলেন। যাহোক, শেষ পর্যন্ত তাঁকে স্পটে নিয়ে যাওয়ার শর্তে ধীরে ধীরে নরম হলেন। এরপর যখন দেখতেন স্পটে কেউ আমাকে সন্তানের মতো, কেউ বোনের মতো করে দেখেন, তখন একটু স্বাভাবিক হলেন। আবার পুরোদমে অভিনয় শুরু।’
বর্তমানে অভিনয় থেকে দূরেই রয়েছেন এই অভিনেত্রী। নিজের ও স্বামীর অসুস্থতার কারণে যেমন, তেমনি ভালো চলচ্চিত্রের অভাবের অভিমানও আছে।
এলএ/এমকেএইচ