মতামত

প্লিজ মরো না, বাবা

ভূমধ্যসাগরের ঢেউ আয়লানের আকুতি মুছে দেওয়ার  মতো যথেষ্ট নয়। তাই তার আঘাতে লাল শার্ট আরো লাল হয় কেবল। কুর্দি পরিবারের তিন বছরের ছেলেটা ভেসে ভেসে ক্লান্ত। তাই ঢেউয়ে সে দোলে না। ভেসে যায় না সাগরের বুকে। আবার ঠিক ডাঙায় পড়ে থাকে না মরা মাছের মতো। কেবল উপুর হয়ে শুয়ে থাকে, আদুরে ডাকের অপেক্ষায়। যেন কেউ এসে তুলে নেবে কোলে। যদিও তার এই ঘুম, চিরদিনের। তার চলে যাওয়া, শুধু গৃহযুদ্ধে অশান্ত দেশ ছেড়ে নয়, নিশ্চিত নিরাপদ ইউরোপ ছেড়ে নয়, মানুষের লোভ ও বর্বরতাকে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে, অনেক দূরে। যদিও পৃথিবী ছাড়ার আগে তার শেষ কথা, বাবা প্লিজ মরো না। বাবা মরে নি, বেঁচে আছে, তবে তা মরার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। যাদের তিন বছরের শিশু আছে ঘরে, তাদের জন্য এই ছবি একটু বেশিই হৃদয়বিদারক। প্রকৃতির এই অদ্ভুত নিয়ম। পৃথিবীর সব শিশুরাই বাবাদের কাছে নিজের শিশুর মতো। আবার  অনাগত পৃথিবীতে নিজের সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকে ভেতরে ভেতরে মুষড়ে আছেন। কত কিছুই না হতে পারে আগামীর পৃথিবীতে। আমাদের মাথার ওপর প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তার মতো ঝুলে আছে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। তাপমাত্রার গ্রহণযোগ্য যে মান ঠিক করছে বিশ্ব তাতে আমাদের দেশে কত মানুষ হারাবে বাস্তু? কতজন চৌদ্দপুরুষের ভিটা ছেড়ে এসে দাঁড়াবে শহুরে মানুষের সদর দরজায়। সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু অস্বস্তি আছে বাবাদের মনে। সন্তানকে কী রাখা যাবে দুধেভাতে? আগামীর দুনিয়াতে। ফলে, আয়লান ভূমধ্যসাগরে মরে গেলেও, অনেক দূরে বাংলাদেশে বসে সে ছবি দেখে ঘুম হয়নি অনেকের । ইউরোপের ঘুম ক্ষাণিকটা ভেঙেছে তবে তা অনেক দেরিতে। গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা কিংবা অনিশ্চয়তা থেকে বাঁচতে সিরিয়া থেকে আয়লান কুর্দির পরিবার আশ্রয় নেয় তুরস্কে। বুধবার নৌকায় চেপে তুরস্ক থেকে গ্রিস যাওয়ার চেষ্টা করে তারা। এসময় ঘটে দুর্ঘটনা। নৌকা ডুবে যায়। বাবার হাত ফসকে সাগরের ঢেউয়ে তলিয়ে যায় দু্ই ছেলে। তিন বছরের আয়লান, পাঁচ বছরের গালিব। সঙ্গী হয় তাদের মা। শিশু আয়লানের মরদেহের ছবি মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বে। আশ্রয়হীনদের মরীয়া ও বিপন্নতার প্রতীকে পরণিত হয় ছবিটি। শরণার্থীদের পক্ষে দ্রুত তৈরি হয় জনমত। ইউরোপের মানুষরা ফান্ড তৈরি করে, এমনকী নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসি আর আয়লানের ছবি ছাপা হওয়ার পর মাত্র দুই দিনে একলাখ ডলার সহায়তা পেয়েছে। সিরিয়া ও ইরাকের শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি। তারা সাড়া পেয়েছে অনেক। এদিকে, ইউরোপের নেতারা এতোদিন অভিবাসন প্রত্যাশীদের বিষয়ে নির্লিপ্ত ছিলেন। এবার নড়েচড়ে বসেছেন। জাতিসংঘ হয়েছে তৎপর। অন্তত দুই লাখ অভিবাসীকে আশ্রয় দিতে ইউরোপকে অনুরোধ করেছে জাতিসংঘ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, সৃষ্টি হয় জাতিসংঘ। যুদ্ধের ভয়াবহতা  ও প্রাণহানি তখনকার বিশ্বনেতাদের ঐক্যবদ্ধ করে এমন একটি সংস্থা গড়ার জন্য। এতোবছর পরেও যুদ্ধমুক্ত বিশ্ব গড়া যায়নি। এই  সমালোচনা থেকে বিশ্ব নেতারা বাদ যাবেন বলে মনে হয় না। সিরিয়াতে যুদ্ধ চলছে মুসলিম চরমপন্থী `ইসলামিক স্টেট’বা আই এস এর সঙ্গে সরকারি বাহিনীর। আয়লান কুর্দির পরিবার বাঁচতে চেয়েছে তাদের হাত থেকে। এই পরিবারের মতো  জীবন বাঁচাতে সিরিয়া, ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান থেকেও হাজার হাজার পরিবার দেশান্তরি হচ্ছে। তারা মুসলিম পরিবার। গন্তব্য ইউরোপের কোনো একটা দেশ। রাজনৈতিক আশ্রয়ের সব চেয়ে বেশি আবেদন পড়েছে জার্মানিতে। স্থিতিশীল দৃঢ় অর্থনীতির দেশ হওয়ায় সেখানে সবাই যেতে চাইবেন তা স্বাভাবিক। জার্মানি অবশ্য আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে এরইমধ্যে। রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার স্বার্থে অনেক মুসলিম পরিবারের ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে।অবৈধভাবে যারা একদেশ ছেড়ে অন্যদেশে যায়, স্মৃতি ছাড়া সঙ্গে তেমন কিছু নিতে পারে না। পেছনে পড়ে থাকে ফসলি জমি। নিকানো উঠোন। ঘুমাবার আয়োজন। খাবার ঘর। রান্নার সরঞ্জাম। সামনে ভবিষ্যৎ ঠিক পরিষ্কার নয়। জীবিকার ঠিক নেই। ঘুমানোর ঘর পাবে কি না নিশ্চিত নয়। এ জীবন ঠিক মানুষের নয়। মানুষ থেকে আরেকটু নিচে, এই জীবনের নাম মানবেতর। অথচ, শুধু বেঁচে থাকতে, সন্তানের মুখের হাসি দেখতে, পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়াতে মানুষের কতো আয়োজন। আইনের চোখ ফাঁকি দেওয়া, বিরুদ্ধ প্রকৃতির সঙ্গে লড়ে যাওয়া। এসব কিছুর ঊর্ধ্বে আয়লান। জীবিতদের জন্য একটাই বার্তা হতে পারে, তার তরফে। এখনো পৃথিবীর সব অংশ শিশুদের বাসযোগ্যও হয়নি। বিশ্বনেতারা, সমৃদ্ধি ও সুখের পৃথিবী গড়ার পাশাপাশি এবার শান্তির পৃথিবী গড়ার  উদ্যোগ নিতে পারেন। তাহলেই আয়লানের মৃত্যুর পর বিশ্বে গড়া জনমতের প্রতি এ এক গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন হতে পারে। লেখক : সিনিয়র নিউজ এডিটর, দীপ্ত টিভি এইচআর/পিআর

Advertisement