দেশজুড়ে

আপনারা আমাকে বাঁচান, এ কথা এখনও কানে বাজে...

‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আমি আর সহ্য করতে পারছি না, আমার চিকিৎসা হতে অনেক টাকা পয়সা লাগবে, এত টাকা আবার বাবা কনে পাবে, আমার বাবা গরিব লোক, আমি বাঁচতে চাই। আপনারা আমাকে বাঁচান।’

Advertisement

অগ্নিদগ্ধ হওয়ার দীর্ঘ ৬ মাস পরে সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে এমন আকুতি করেছিল যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার নায়ড়া গ্রামের শিশু মারিয়া।

এই মারিয়াকে বাঁচানো গেল না (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন এবং তার চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসা দেশ-বিদেশের হাজারো মানুষকে কাঁদিয়ে চলে গেল না ফেরার দেশে। কিন্তু তার সেই কথাগুলো এখনও কানে বাজছে…!

গতকাল বুধবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের দ্বিতীয় তলায় এইচডিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

Advertisement

ঝিকরগাছার শংকরপুর ইউনিয়নের নায়ড়া গ্রামের ভাটার ট্রলি চালক হত দরিদ্র রুবেল হোসেনের শিশু কন্যা মারিয়া (৭)। সে স্থানীয় নায়ড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী ছিল।

গত বছরের ডিসেম্বরে আগুন পোহাতে গিয়ে আগুনে পুড়ে পুরো শরীর ঝলসে যায় মারিয়ার। অসহায় ট্রলি চালক বাবা আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসীর সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে সে সময় মেয়ের চিকিৎসা সেবা দিয়েছিলেন। মেয়ের চিকিৎসার জন্য যশোরের একটি ক্লিনিকে ভর্তি করান। কিন্তু অবস্থার তেমন পরিবর্তন না হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে ১৫ দিনে খরচ হয় প্রায় দু’লাখ টাকা। অসহায় পরিবারের জন্য এই ব্যয়বহুল খরচ যোগাতে না পেরে সেখান থেকে বাড়িতে ফেরত নিয়ে আসেন মারিয়ার দরিদ্র বাবা রুবেল।

অবশেষে এ ঘটনাটি সীমান্ত প্রেস ক্লাব সাংবাদিকদের নজরে আসে। পরে গত ২৪ এপ্রিল রাতেই সীমান্ত প্রেসক্লাবের তত্ত্বাবধানে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে মারিয়াকে পুনরায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। ফেসবুক, প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় মারিয়ার খবর প্রকাশ হলে তা মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়। চিকিৎসার জন্য হাত বাড়ান দেশ-বিদেশের বিত্তবানসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষ। মারিয়ার চিকিৎসার জন্য উঠে আসে ৬ লাখ টাকারও বেশি। পুরোদমে চিকিৎসা চলতে থাকে মারিয়ার। প্রাথমিক পর্যায়ে শিশু মারিয়া কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেও অবশেষে মৃত্যুর কাছে হার মানতেই হলো তার।

বুধবার সকাল ৭টা বাজে। হঠাৎ মারিয়ার বাবার ফোনে রিং আসে ঢাকা থেকে। ফোনটি রিসিভ করতেই ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসে আধো আধো কাঁদো, কাঁদো কণ্ঠে মারিয়া আর নেই। কথাটা বিশ্বাসযোগ্য না হলেও চরম সত্যটাকে মানিয়ে নিয়েই অঝরে কেঁদে উঠে মা বাবা। সঙ্গে সঙ্গে এই হৃদয়বিদারক কান্নার রোল পড়ে যায় মারিয়ার বাড়িতে। মুহূর্তের মধ্যে আকাশ-বাতাশ ভারী হয়ে যায়, শোকে ছায়া নেমে আসে পুরো নায়ড়া গ্রামে।

Advertisement

মারিয়ার মৃত্যুর খবর সাংবাদিক মহলসহ গোটা এলাকায় ছড়িয়ে যেতে সময় লাগলো না। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনের পাশাপাশি শোকে কাতর হয়ে পড়ে মারিয়ার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করা সাংবাদিক মহল।

আজ তুমি নেই..! ভাবতেই অনেক কষ্ট হচ্ছে..! চলে গেলে না ফেরার দেশে..! তোর জন্য অনেক কষ্ট হচ্ছে! কিছুই করতে পারলাম না তোর জন্য! ওপারে ভালো থাকিস! আমাদের ক্ষমা করে দিস। এমন শত শত স্ট্যাটাসে ফেসবুকের পাতায় নিজেদের কষ্টের কথা প্রকাশ করছেন সাংবাদিক সমাজসহ কাছের মানুষেরা।

বুধবার বিবেল সাড়ে ৫টার সময় ঢাকা থেকে মারিয়ার গ্রামের বাড়ি ঝিকরগাছার নায়ড়া গ্রামের উদ্দেশে রওয়ানা দেয় মারিয়ার নিথর দেহ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি। রাতেই জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয় স্থানীয় গোরস্তানে।

মো. জামাল হোসেন/জেডএ/জেআইএম