সাহিত্য

মোস্তফা কামাল : নিষ্ঠাবান লেখকের অগ্নিমশাল

আজ ৩০ মে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মোস্তফা কামালের ৫০তম জন্মদিন। আজ থেকে ১০ বছর আগে দৈনিক কালের কণ্ঠের অফিস যখন পান্থপথের বসুন্ধরা সিটির বেজমেন্টে ছিল সেসময় তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। যতদূর মনে পড়ে সাহিত্য পাতার সম্পাদক কবি শামীম রেজা এবং সহযোগী কবি জুয়েল মোস্তাফিজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে তাঁর কক্ষে প্রথম পদচারণা ও আলাপচারিতার সুযোগ হয়।

Advertisement

তখনও তাঁর কথাসাহিত্য পাঠের সুযোগ ঘটেনি; তবে তাঁর কলামের পাঠক হয়েছি। তিনি প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, কূটনীতিক প্রতিনিধি ও চিফ রিপোর্টার ছিলেন। সেই চাকরি ছেড়ে নতুন একটি পত্রিকার উঁচু পদে যোগ দিয়ে মোস্তফা কামাল সেদিন দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। এজন্য আজ তিনি এই পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক। কালের কণ্ঠ আপন ঠিকানায় চলে এলো বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করলেও এর আগে আমি কখনও রাজধানীর ওই অভিজাত এলাকায় আসিনি। কালের কণ্ঠ টেনে নিয়ে গেল সেখানে। আর সেই সূত্রে দিনের পর দিন লেখা দেওয়া কিংবা কেবল মোস্তফা কামাল ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা দেবার জন্য সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছি।

বলা চলে কলাম এবং সাহিত্য পাতায় নিয়মিত লেখার ক্ষেত্রে তাঁর অনুপ্রেরণা আমার জীবনে ফলপ্রসূ হয়েছে। আর বলতে দ্বিধা নেই একসময় সপ্তাহের পর সপ্তাহ লেখার মধ্য দিয়ে আমার পরিচিতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এর আগে একসময় আজকের কাগজ কিংবা যায় যায় দিন দৈনিকে কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক সালাম সালেহ উদদীনের উৎসাহে লিখেছি। কিন্তু বেশি সার্কুলেশনের পত্রিকায় লেখার সূচনা কামাল ভাইয়ের হাত ধরে শুরু হয়। মনে আছে কোনো একটি লেখা নিয়ে একাধিক পাঠক লিখিত অভিযোগ জানালে সেই সময় আমার পক্ষে কথা বলেছেন মোস্তফা কামাল।

মনে পড়ে আমার ছাত্রদের তাঁর কাছে নিয়ে গেলে তিনি তাদের যোগ্যতা যাচাই করে দু’জনকে সাংবাদিকতায় নিয়োজিত করেছেন। অর্থাৎ আমার ব্যাপারে তাঁর আন্তরিক আচরণে কখনও টান পড়েনি। বরং সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাঁর পরিমণ্ডলে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন আমাকে। এই যে মানুষ হিসেবে তাঁর উদারতা এবং লেখক গড়ে তোলার প্রাণান্ত চেষ্টা এটা খুব কম সাংবাদিকের মধ্যে লক্ষ করা যায়।

Advertisement

মোস্তফা কামালের আজ জন্মদিন। কিন্তু কোনো বড় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিনি দিনটি পালন করেন না। তবে তাঁর পাঠক, ভক্ত ও সহকর্মীরা তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা জ্ঞাপন করেন। এই দিনটিও তিনি ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেন। ঘুম থেকে উঠে সকালের হাঁটা শেষ করে রেডি হয়ে দশটার মধ্যে তিনি অফিসে আসেন আর সারাদিনের ব্যস্ততা শেষ করে ঘরে ফেরেন রাত দশটায়। অফিসে তাঁকে দেখেছি তিনি একাধিক মিটিং করছেন; অবসর মুহূর্তে কম্পিউটারে বসে দ্রুত টাইপ করছেন। কেউ কোনো কাজে সাহায্য চাইতে এলে তার কথা শুনছেন। আবার সন্ধ্যায় রিপোর্টারদের নিয়ে বসে মিটিং; তারপর নিউজ দেখা; তার আগে সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয় দেখে ছেড়ে দেওয়া।

আমি খুব অবাক হই এই ভেবে যে অফিসের এতোগুলো কাজ করে, নিরন্তর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রদান করে তার মধ্যেও তিনি লেখার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি দ্রুত টাইপ করতে পারেন, তিনি অনেকগুলো দেশ ঘুরেছেন, তিনি ইংরেজি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। সব মিলে তাঁর যোগ্যতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। প্রতিবছর দেশের প্রথমসারির প্রকাশনা থেকে তাঁর একগুচ্ছ বই প্রকাশিত হয়। বিশাল ব্যস্ত জীবনের মধ্যে নির্বিকার চিত্তে নিজের সৃজনশীল কাজে আত্মনিয়োগ করে এগিয়ে যাওয়ার ব্রতে তিনি অনন্য।

শতাধিক গ্রন্থের জনপ্রিয় লেখক মোস্তফা কামাল ‘অগ্নিমশাল’ তুল্য। তিনি যেমন লেখার বিষয়ে নিষ্ঠাবান তেমনি অপরকে আলোকিত করে তোলার ব্যাপারে সপ্রতিভ। তাঁর ‘জননী’ উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুদিত হয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে ‘হ্যালো কর্নেল’ জঙ্গিবাদ বিরোধী সৃষ্টিকর্ম হিসেবে আলোড়ন তুলেছে। তিনি তাঁর কথাসাহিত্যের পরিসরে মুক্তিযুদ্ধকে যেমন তেমনি ইতিহাসের নানান মাইলস্টোনকে কাহিনীতে আত্মস্থীকৃত করেছেন।

বিশেষত তাঁর ‘অগ্নিকন্যা’, ‘অগ্নিপুরুষ’ ও ‘অগ্নিমানুষ’- এই ত্রয়ী উপন্যাস পাঠককে চমকে দিয়েছে। উপন্যাস তিনটির সময়কাল হচ্ছে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১; দেশভাগ থেকে স্বাধীনতা। ২৪ বছরের ইতিহাস নির্মাতাদের নিয়ে লেখা এই ট্রিলজির অন্যতম প্রধান চরিত্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশভাগের জটিল অঙ্ক, কুটিল রাজনীতির প্যাঁচ, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র আর শোষিত পূর্ববাংলার বঞ্চিত হওয়ার নেপথ্য কাহিনী এবং বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত হয়েছে এই উপন্যাসত্রয়ীতে।

Advertisement

উল্লেখ্য, আমার জানা মতে, তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচুর পাঠ সম্পন্ন করেছেন; এই মহান নেতার পুরো জীবনের প্রতিটি ক্ষণ উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন; তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক ও রাজনৈতিক জীবন নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর দেশপ্রেম, তাঁর সাহসী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং তাঁর পাহাড়সমান ব্যক্তিত্ব ও উদারতা তাঁকে দারুণভাবে স্পর্শ করেছে। তিনি এমন একজন বাঙালি, যাঁর সঙ্গে অন্য কারো তুলনা চলে না। একজন ক্ষণজন্মা মানুষ, এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তাঁকে তিনি হৃদয়ে এবং চেতনায় ধারণ করেন।

উপন্যাসত্রয়ীতে বঙ্গবন্ধুর চরিত্র জীবন্ত করে নির্মাণ করেছেন। মোস্তফা কামালের উপন্যাস-গল্পের ভাষা সহজ, সাবলীল, গতিশীল এবং জটিলতা বিবর্জিত। তাঁর যে কোনো গ্রন্থ পড়তে বসলে শেষ না করে পাঠক উঠতে পারবেন না। ঐতিহাসিক উপন্যাসে কোনো চরিত্রকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেন নি তিনি; কোনো অতিরঞ্জিত তথ্যও নেই। কাহিনী পড়তে পড়তে পাঠকরা ইতিহাস জানবেন; কাহিনীই পাঠককে ভেতরে নিয়ে যাবে- এখানেই মোস্তফা কামালের অগ্নিমশালের বিশেষত্ব।

জন্মদিনে তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

লেখক : মিল্টন বিশ্বাস, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/জেআইএম