দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষই অসংক্রামক রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ অসংক্রামক রোগের ঝুঁকিতে নেই।
Advertisement
‘বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকিসমূহের জরিপ-২০১৮’ থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
বুধবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকির ব্যাপ্তি নিরূপণে স্টেপস জরিপের (ওয়াইজ অ্যাপ্রোচ টু কমিউনিকেবল ডিজিজ রিস্ক ফ্যাক্টর সার্ভিলেন্স) ফলাফল জাতীয়ভাবে প্রকাশ করা হয়।
এ সময় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে জরিপের প্রধান গবেষক অধ্যাপক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন।
Advertisement
জরিপে উঠে আসা অসংক্রামক রোগের সামগ্রিক ঝুঁকিগুলোর মধ্যে রযেছে- প্রতিদিন ধূমপান, দৈনিক ৫ প্রমাণ মাপের (নির্দিষ্ট কৌটা পরিমাণ) কম ফল ও সবজি গ্রহণ, অপর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম, অতিরিক্ত ওজন, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চমাত্রার রক্তের চর্বি।
১৮ থেকে ৬৯ বছর বয়সীদের মধ্যে এই ছয় ধরনের মধ্যে কোনো ধরনের ঝুঁকি নেই এমন মানুষের শতকরা হার মাত্র ৩ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষের ১ দশমিক ৯ ও নারীর হার ৪ শতাংশ।
উপরের ঝুঁকিগুলোর মধ্যে একটি বা দুটি ঝুঁকি রয়েছে এমন হার ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ (পুরুষ ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ ও নারী ৭৩ দশমিক ১ শতাংশ) ও দুই বা ততোধিক ঝুঁকি রয়েছে ৪০ দশমিক ১ শতাংশ (পুরুষ ৩৯ দশমিক ৪ শতাংশ ও নারী ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ) মানুষের।
জরিপে আরও উঠে এসেছে, উপরের ছয়টির মধ্যে তিনটি বা এর বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ (পুরুষ ২৯ দশমিক ৬ শতাংশ ও নারী ২২ দশমিক ৮ শতাংশ) মানুষ।
Advertisement
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, স্টেপস সার্ভে হচ্ছে একটি দেশে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকির ব্যাপী পর্যবেক্ষণের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রণীত মানসম্মত একটি পদ্ধতি, যা তিনটি ধাপে সম্পন্ন করা হয়। ধাপ তিনটি হচ্ছে ধাপ-১: প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে জীবনাচরণগত ঝুঁকিসমূহ নির্ণয়। ধাপ-২: শারীরিক পরিমাপ করার মাধ্যমে শরীরবৃত্তীয় ঝুঁকিসমূহ নির্ণয়। ধাপ-৩: জৈব রাসায়নিক পরিমাপের মাধ্যমে জৈব রাসায়নিক ঝুঁকিসমূহ নির্ণয়।
‘স্টেপস সার্ভে-২০১৮’ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ (এনসিডিসি) বিভাগের আর্থিক সহায়তায় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) কারিগরি সহায়তায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনের (নিপসম) মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
গবেষণা পদ্ধতি তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, জরিপটি ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের সব বিভাগের থানাসমূহে বসবাসকারী ১৮ থেকে ৬৯ বছর বয়সী প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে পরিচালিত হয়।
সারাদেশে ৪৯৬টি প্রাইমারী স্যাম্পিং ইউনিটের (পিএসইউ) ৯ হাজার জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উত্তর দাতাদের দৈবচয়ন পদ্ধতিতে নির্বাচন করা হয়। উত্তরদাতাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং জরিপের অংশগ্রহণ প্রত্যাখ্যানের সম্ভাবনা উপর ভিত্তি করে চূড়ান্তভাবে ধাপ-১ এ ৮ হাজার ১৮৫ জন, ধাপ-২ এ ৭ হাজার ২০৪ জন উত্তরদাতা অংশগ্রহণ করেন। ধাপ-৩ তে ৭ হাজার ৫৬ জনের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ এবং ৭ হাজার ২৮ জনের কাছ থেকে প্রস্রাবের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ৬ হাজার ৯০১ একজনের রক্ত ও প্রস্রাব উভয় নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পদ্ধতি ও উপাত্তের গুণগত মান এবং গবেষণা সংক্রান্ত বিষয়গুলো প্রতিটি স্তরে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশে অসংক্রামক রোগ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। এসব রোগের চিকিৎসার জন্য যে চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োজন সেই ব্যবস্থাও আমাদের পুরোপুরি নেই। আমরা সেই বিষয়েও মনোযোগ দিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘অসংক্রামক রোগের মধ্যে রয়েছে ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, কিডনি ফেইলিওর, হাইপারটেনশনসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ। প্রাথমিক স্তরেই যদি আমরা যদি এসব রোগের দিকে লক্ষ্য করি, জীবন ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করি, বেছে চলি- তাহলে আমরা এই রোগ প্রতিরোধ করতে পারি।’
‘এসব রোগের প্রধান কারণ হল খাদ্যাভ্যাস। আমরা লবণ, চিনি, তেল বেশি খাই। আমি দেশবাসীকে এই তিনটি জিনিস খাওয়া নিয়ন্ত্রণে আসার আহ্বান করব।’
মন্ত্রী বলেন, ‘অসংক্রামক রোগ কেন হচ্ছে এ বিষয়ে একটি জরিপ করা হয়েছে। ৯ হাজার মানুষের উপর এই জরিপ কাজটি করা হয়েছে। তাদের রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা করা হয়েছে। জরিপে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আমদের নীতি ও পরিকল্পনাগুলো করতে পারব।’
৭০ শতাংশ মানুষ রক্তের সুগার পরীক্ষা করেন না
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘জরিপ অনুযায়ী আমাদের দেশের লোকেরা ৭০ শতাংশ লোকই কখনও রক্ত পরীক্ষা করেনি, সুগার দেখার করার জন্য। আমি করি একটা বয়স হলে গেলে প্রত্যেকেরই সুগার টেস্ট করা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়া ৯০ শতাংশ মানুষ কখন রক্তের কোলস্টেরল পরীক্ষা করেনি। ৯০ শতাংশ তো প্রায় সব লোকই। বাকিরা তো শিশু, তাদের তো কোলস্টেরল পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না।
‘সুগার ও কোলস্টেরল পরীক্ষা না করলে অনেকগুলো ঘাতক রোগের জন্ম হতে পারে। হার্ট ব্লক হয়ে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে, স্ট্রোক হতে পারে। ডায়াবেটিস হতে পারে। ডায়াবেটিস হলে কিডনি ফেইলিওর হতে পারে। বাংলাদেশে এখন হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও কিডনি ফেইলিওর অনেক হচ্ছে।’
জরিপের তথ্য তুলে ধরে জাহিদ মালেক আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ এখন ফল খুব কম খাচ্ছে। সোজাসুজি যদি বলি যেখানে ৫টি ফল খাওয়া দরকার। আমরা খাচ্ছি একটি বা অর্ধেক ফল। আমরা আশা করি দেশবাসী বেশি করে ফল খাবেন ও সুস্থ থাকবেন। আমরা নিয়মিত ব্যায়াম করব।’
২৫ শতাংশ মানুষের উচ্চ রক্তচাপ
মন্ত্রী বলেন, ‘জরিপ অনুযায়ী আমাদের দেশে ২৫ দশমিক ২ শতাংশ মানুষের ব্লাড প্রেসার রয়েছে। যাদের ব্লাড প্রেসার আছে, তারা অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন, নিয়মিত ওষুধ সেবন করবেন।’
‘আমাদের দেশে ২৫ শতাংশ মানুষ মুটিয়ে গেছে। স্থূলকায় শরীরের ক্ষেত্রে মহিলারাই বেশি।’
ফলমূল, শাকসবজি খেলে, ব্যায়াম করলে মানুষ ভালো থাকবে জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রতি বছর ৮ লাখ মানুষ স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করে। এরমধ্যে ৭ শতাংশ মানুষ অসংক্রামক ব্যাধিতে মারা যায়।’
আরএমএম/জেএইচ/এমএস/জেআইএম