জাতীয়

ইউলুপে চলছে রিকশা-ভ্যান

রাজধানীর রামপুরা-বাড্ডা সড়কে যারা নিয়মিত চলাচল করেন, তাদের কাছে প্রতিদিনের ভোগান্তির কারণ ছিল তীব্র যানজট। দীর্ঘ সময় আটকে থাকতে হতো এই পথ দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনগুলোকে। হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের বাড্ডা প্রান্তের ইউ আকৃতির গাড়ি পারাপার সেতু (ইউলুপ) চালু হওয়ার পর থেকে, এই সড়কের যানজট অনেকটাই কমে গেছে।

Advertisement

গত বছরের ২৮ জুলাই বিড়ম্বনা-ভোগান্তির অবসান ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউলুপটি উদ্বোধন করেন। এরপর থেকে রামপুরা-মেরুল বাড্ডার দিক থেকে আসা গাড়ি, সিএনজি, প্রাইভেটকারগুলো ইউলুপ দিয়ে ঘুরে ওদিকের সড়কে নামা শুরু করে।

বাড্ডার এই ইউলুপটি নির্মাণের ফলে যানবাহনগুলো প্রগতি সরণি হয়ে ইউলুপ দিয়ে বাঁক নিয়ে বনশ্রী, আফতাবনগর, রামপুরা বা মালিবাগ অভিমুখে সহজেই যাতায়াত করছে। কিন্তু সেই ইউলুপ দিয়ে অন্যান্য যানবাহনের সঙ্গে রিকশা-ভ্যান চলাচল করবে বিষয়টি একটু অন্যরকমই বটে।

হ্যাঁ, এই ইউলুপ দিয়ে বর্তমানে রিকশা-ভ্যানও নিয়মিত চলাচল করছে। তবে তারা যে ইচ্ছা করে এটি ব্যবহার করছে তা নয়। অনেকটা বাধ্যে হয়েই তাদের রিকশা-ভ্যান নিয়ে ফ্লাইওভারের মতো এই ইউলুপটি পার হতে হচ্ছে।

Advertisement

আরও পড়ুন> এ ভোগান্তির শেষ কবে?

মঙ্গলবার ইউলুপটির সামনে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখা গেল, অন্যান্য যানবাহনের মতো রিকশা-ভ্যানও চলাচল করছে। বেশিরভাগ চালক রিকশা বা ভ্যান ইউলুপ অতিক্রম করে কেন ওপারে পার হচ্ছে- এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, রামপুরা থেকে উত্তর বাড্ডা ফুটওভার ব্রিজের পর কোথাও রিকশা-ভ্যান বা অন্য কোনো যানবাহন পারাপারের ব্যবস্থা নেই। যে কারণে বাধ্য হয়ে অন্য সব যানবাহনের মতো এসব রিকশা-ভ্যানও ইউলুপ দিয়ে পার হচ্ছে।

ইউলুপ দিয়ে নিজের রিকশা ঠেলে ওপারে পার হচ্ছিলেন রিকশাচালক রমিজ মিয়া। তিনি বলেন, ‘আমি বনশ্রী এলাকায় রিকশা চালাই। যাত্রী নিয়ে বনশ্রী থেকে রামপুরা বাজার গেছি। আবার সেখান থেকে অন্য আরেক যাত্রী নিয়ে মেরুল বাড্ডায় এসেছি। এখন আবার বনশ্রী চলে যাব। কিন্তু বনশ্রী যেতে হলে আমাকে সেই উত্তর বাড্ডা পার হয়ে যেখানে রাস্তা কাটা আছে, সেদিক দিয়ে আসতে হবে। যে কারণে কষ্ট করে রিকশা নিয়ে ইউলুপ দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছি।’

আরও পড়ুন> বাড়িতে ঢুকে গৃহকর্তার প্রাণ নিল ট্রাক

Advertisement

আরেক রিকশাচালক এরশাদ আলীও বললেন একই কথা। তিনি বলেন, যাদের রিকশা-ভ্যান নিয়ে ওপারে পার হতে হয়, তাদের সবাই এখন ইউলুপ দিয়েই পার হয়। একদিকে রামপুরা অন্যদিকে উত্তর বাড্ডা পার হয়ে সড়কে কাটা আছে। এর মাঝখানে কোথাও কাটা নেই। তাই প্রতিদিন এভাবেই পার হতে হয় আমাদের। যদিও রিকশা-ভ্যান নিয়ে এভাবে পার হতে আমাদের কষ্ট হয়, কিন্তু কিছুই করার নেই। কারণ, ওপারে যেতে হলে এই কষ্ট সহ্য না করলে উত্তর বাড্ডা হয়ে ঘুরে আসতে হবে।

পথচারী পারাপারেও বিড়ম্বনা

রামপুরা ব্রিজ থেকে উত্তর বাড্ডা পর্যন্ত মাত্র দুটি ফুটওভার ব্রিজ। অথচ এই পথে প্রতিদিন অসংখ্য পথচারী পারাপার হয়। কিন্তু দীর্ঘ এই পথে মাত্র দুটি ফুটওভার ব্রিজ এবং রাস্তায় পর্যাপ্ত জেব্রা ক্রসিং না থাকা, সেই সঙ্গে পথচারীদের যত্রতত্র সড়ক পারাপার বন্ধে সড়কটির বেশিরভাগ অংশে আইল্যান্ডে বসানো ফেন্সিং বা লোহার গ্রিলের কারণে পথচারী পারাপারেও বিড়ম্বনা সৃষ্টি হয়েছে পুরো বাড্ডা সড়কে।

সিরাজুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, মেরুল বাড্ডার পরে আমার দোকান আর রাস্তার ওই পাশে বাসা। দোকান ও বাসায় আসা-যাওয়ার সময় আমাদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। এখানে রামপুরা ব্রিজ থেকে উত্তরা বাড্ডা পার হওয়া পর্যন্ত মাত্র দুটি ফুটওভার ব্রিজ। এর মধ্যে সড়কে নেই পর্যাপ্ত জেব্রা ক্রসিং। এছাড়া পথচারীদের যত্রতত্র সড়ক পারাপার বন্ধে সড়কটির বেশিরভাগ অংশে আইল্যান্ডে বসানো ফেন্সিং বা লোহার গ্রিল। তাহলে আমরা কীভাবে পার হবো? প্রতিদিন স্কুলগামী শিক্ষার্থীসহ অসংখ্য মানুষ এই বিড়ম্বনায় পড়ে।

আরও পড়ুন> ঈদের শপিং করতে ঢাকায় এসে লাশ হলো আব্দুল্লাহ

হাবিবুর রহমান নামের আরেক পথচারী জানান, আমরা সড়কের নিয়ম-শৃঙ্খলা মানতে ফুটওভার ব্রিজ ও জেব্রা ক্রসিংয়ের নিয়ম মানতে রাজি আছি। কিন্তু এসব সুবিধা সৃষ্টি না করে সিটি কর্পোরেশন যত্রতত্র সড়ক পারাপার বন্ধে সড়কটির বেশিরভাগ অংশে আইল্যান্ড বসানো লোহার গ্রিল দিয়ে রাস্তা পারাপার বন্ধের চেষ্টা করছে। আমরা তাহলে কীভাবে পার হবো?

তিনি বলেন, মেরুল থেকে যে লোকটি রাস্তা পার হয়ে ডিআইটিতে যাবে, সে কি তাহলে রামপুরা গিয়ে ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পার হবে, নাকি মধ্য বাড্ডা ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পার হবে? আর তা না হলে তাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেখানে ফাঁকা আছে সেই দিক দিয়ে রাস্তা পার হতে হবে। তাহলে আমরা নিরাপদ সড়ক কীভাবে পাবো? এভাবে প্রতিদিন সকালে বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যেতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি সৃষ্টি হয়।

আরও পড়ুন> হাসপাতালে যাওয়ার পথে শিশুকে হারালেন মা

এই সড়ক দিয়ে চলাচলকারী রবরব বাসের চালক আজগর আলী বলেন, সড়কটিতে পর্যাপ্ত ফুটওভার ব্রিজ ও জেব্রা ক্রসিং নেই। আর সড়কের বেশিরভাগ অংশজুড়ে রয়েছে আইল্যান্ডে বসানো লোহার গ্রিল। ফলে পথচারীরা স্বাচ্ছন্দ্যে রাস্তা পারাপার হতে পারে না। যেখানে একটু ফাঁকা পায় পথচারীরা সেখান দিয়েই দৌড়ে পার হয়। ফলে হঠাৎ করেই বাস ব্রেক করতে হয়, এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাককে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত, ব্যস্ত এই রাস্তায় পর্যন্ত জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করে দেয়া, যাতে পথচারীদের দুর্ঘটনার কবলে পড়তে না হয়।

সাধারণ শিক্ষার্থীর সঙ্গে এ সড়কের বিষয়ে এক আলোচনা সভা ও ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানের উদ্বোধনকালে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছিলেন, রাজধানীর মালিবাগ আবুল হোটেলের সামনে থেকে কুড়িলের প্রগতি সরণি পর্যন্ত সড়কটিকে মডেল সড়ক হিসেবে তৈরি করা হবে। পথচারীদের যত্রতত্র সড়ক পারাপার বন্ধে পুরো সড়কটির আইল্যান্ডে বসানো হবে লোহার গ্রিল। শুধু নির্দিষ্ট জায়গাতেই যেন পথচারীরা পারাপার হতে পারেন তার জন্য থাকবে জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভার ব্রিজ এবং আন্ডারপাস। নিরাপদ সড়ক এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ হিসেবে এ সড়কটিকে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে নিয়ে মডেল সড়ক গড়ে তোলা হবে।

আরও পড়ুন> কেটে ফেলা হলো কনস্টেবল পারভেজের পা

পাশাপাশি তিনি বলেছিলেন, ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে প্রধান সড়কে (প্রগতি সরণি সড়ক) দ্রুততম সময়ে একটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ হবে। সাধারণ মানুষ যেন এই ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করে, সে লক্ষ্যে মানুষকে সচেতন করতে শিক্ষার্থীদের আহ্বানও জানান তিনি।

জানা গেছে, বর্তমানে রাজধানীতে প্রায় ৮৭টি ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতায় ৩২টি ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতায় ৪৯টি। রোড অ্যান্ড হাইওয়ের ৫টি এবং রাজউকের একটি ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে। এছাড়া নির্মাণাধীন এবং নির্মাণের পরিকল্পনায় আছে আরও কয়েকটি ফুটওভার ব্রিজ।

ডিএনসিসির সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফুটওভার ব্রিজগুলো দৃষ্টিনন্দনভাবে সাজানোর পাশাপাশি পথচারীদের তা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তারা। এছাড়া যে ফুটওভার ব্রিজ খুব বেশি ব্যবহার হয় না, সেগুলো তুলে যে স্থানগুলোতে ব্রিজ বেশি প্রয়োজন, সেখানে স্থানান্তর বা নির্মাণ করা হবে।

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, রাজধানীর কোন স্থানে মানুষ বেশি চলাচল করে, কোন স্থান দিয়ে মানুষকে বেশি পারাপার হতে হয়, এসব বিষয় বিবেচনা করে বা জরিপের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশনের উচিত পরিকল্পনামাফিক ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ বা স্থানান্তর করা। তবেই এসব ফুটওভার ব্রিজ পথচারীদের উপকারে আসবে।

এএস/এমএসএইচ/এমএস