ফিচার

জাতিসংঘে কাজ করার স্বপ্ন পূরণ হলো যেভাবে

সানজিদা বারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে স্নাতকসহ স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। এখন জাতিসংঘের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় (আইএলও) কর্মরত আছেন। সানজিদার সঙ্গে তার শিক্ষা, জাতিসংঘ, আইএলও এবং কর্মজীবনের নানা দিক নিয়ে কথা হয়। জাগো নিউজকে তিনি জানিয়েছেন তার অর্জন, স্বপ্ন ও সম্ভাবনার কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহিদ হাসান—

Advertisement

আপনার শৈশব-কৈশোর নিয়ে কিছু বলুন—সানজিদা বারী: আমার শৈশব অন্য দশটি মেয়ের থেকে বরাবরই ভিন্ন ছিল। অন্যরা যখন ক্লাস, কোচিং আর নতুন হিন্দি সিরিয়াল নিয়ে ব্যস্ত থাকতো; তখন আমি তিন গোয়েন্দা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর শরৎ চন্দ্র নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। পড়ার বইয়ের বাইরে প্রচুর বই পড়ার অভ্যাস তখনো ছিলো, এখনো আছে। পাঠ্য বইয়ের বাইরে বই পড়ার জন্য প্রথমে পরিবার সাপোর্ট না দিলেও এখন আর কিছু বলে না। বরং উৎসাহ দেয়!

আপনার স্কুল-কলেজ তথা পড়াশোনা সম্পর্কে জানতে চাই—সানজিদা বারী: আমার জন্ম নারায়ণগঞ্জে। এমনকী বেড়ে ওঠাও এই শহরে। নারায়ণগঞ্জ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হই মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করেছি।

> আরও পড়ুন- মালয়েশিয়া প্রবাসী অগস্টিনের সফলতা

Advertisement

পড়াশোনার ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?সানজিদা বারী: পড়াশোনার ক্ষেত্রে আমার কখনো কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল না। আমি পড়াশোনাটা সব সময়ই উপভোগ করতাম এবং এখনো করি। ভালো ফলাফল বা কোন কিছু পাওয়ার উদ্দেশ্যে কখনো পড়াশোনা করিনি। এমনকী এখনো করি না। জানার জন্য পড়ি এবং মনে হয় প্রচুর পড়ি! আমার মা সব সময়ই বলেন, আমি নাকি বইয়ের মহাসমুদ্রে বসবাস করি। কারণ আমার কক্ষে এবং আমার আশেপাশে আর কিছু পাওয়া যায় না, শুধু বই ছাড়া!

জাতিসংঘে কাজ করার স্বপ্ন দেখেছিলেন কবে থেকে?সানজিদা বারী: মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছা সব সময়ই ছিল। আমার মনে হয়েছে, মানুষের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের চেয়ে ভালো কোন প্লাটফর্ম হতে পারে না। আমার মনে হয়, মানুষের উচিত দেশ, কাল, পাত্রভেদে সব মানুষের প্রতি সহমর্মিতা, ভালোবাসা এবং মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। যেই ভালোবাসা কাঁটাতারের সীমান্তে ভাগ হয়ে যায়। মানুষের সাথে মানুষের ভেদাভেদ তৈরি করে, সেই ধারণার সাথে আমি একমত নই। জাতিসংঘে কাজ করার মানে হলো পৃথিবীর জন্য কাজ করা এবং বিশ্ব নাগরিক হয়ে ওঠার একটা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা।

আপনার জাতিসংঘ যাত্রার গল্প শুনতে চাই—সানজিদা বারী: আমার ক্যারিয়ার যাত্রার গল্পটা শুরু করতে হবে কলেজ থেকে। কলেজে পড়ার সময়ে সর্ব প্রথম সাহিত্য, লেখালেখি এবং জীবন সম্বন্ধে ভাবতে শুরু করি। কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তি হই। সেখান থেকে ব্যাচেলর অব সোশ্যাল সায়েন্স এবং মার্স্টাস অব সোশ্যাল সায়েন্স সম্পন্ন করি। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ছিল বৈচিত্রময়। আইএলওতে কাজ করার আগে বিভিন্ন এনজিও, বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করেছি। ইউনাইটেড ন্যাশন্স ভলান্টিয়ার্সের যোগাযোগ বিভাগে কাজ করেছি। এছাড়াও অনেক সেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করেছি। আমি বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এবং এখানে দীর্ঘদিন ধরে মানুষের বিশেষ করে তরুণদের পাঠাভ্যাস নিয়ে কাজ করেছি। মাঝে কিছু সময় অভিনয়ও করেছি। আমার অভিনীত প্রিয়-অপ্রিয় আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কারপ্রাপ্ত।

> আরও পড়ুন- চারটি আবিষ্কারেই সফল হয়েছি : ড. বেলাল

Advertisement

আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করতে চায়, তাদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কি?সানজিদা বারী: জাতিসংঘে যারা কাজ করে তাদের বলা হয় ইন্টারন্যাশনাল সিভিল সার্ভেন্ট। তাই এখানে কাজ করার প্রথম ধাপ হচ্ছে- আপনাকে শুধু নাগরিক নয়, বিশ্ব নাগরিক হয়ে উঠতে হবে। নিজের সংকীর্ণ মনোভাব বাদ দিয়ে মানবিক আচরণ করতে হবে। জাতিসংঘে কাজ করার জন্য তিনটি বিষয় খুব জরুরি- অভিজ্ঞতা, ভালো লিখতে পারা এবং তুখোড় বিশ্লেষণী দক্ষতা। এছাড়া ইংরেজিতে ভালো লিখতে এবং কথা বলার দক্ষতা অবশ্যই থাকতে হবে। জাতিসংঘে যোগ দেওয়ার আগে অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে এনজিও অথবা অন্য কোন সংস্থায় বা লেখালেখির সাথে যদি কোনোভাবে জড়িত থাকেন, তাহলে সেটা আপনার জন্য ভালো ফলাফল বয়ে আনবে। প্রচুর সহশিক্ষামূলক কাযর্ক্রমে অংশগ্রহণ থাকতে হবে। পাঠ্য বইয়ের বাইরের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, কোন একটা ঘটনাকে বিশ্লেষণ করার দক্ষতা থাকতে হবে। তার জন্য দেশ-বিদেশের চলমান রাজনীতি, অর্থনীতি সম্বন্ধে ধারণা থাকা প্রয়োজন। আর জেন্ডার সেনসেটিভ হতে হবে। একজন নারী কেন নারী হওয়ার জন্য বৈষম্যের শিকার হয়। পুরুষ কীভাবে নারীকে শোষণ করে। সে সম্বন্ধে সজাগ এবং বিশ্লেষণী দক্ষতা থাকা জরুরি। সচেতন, মানবিক এবং তুখোড় বিশ্লেষণী দক্ষতা হলো জাতিসংঘে কাজ করার প্রধানতম যোগ্যতা।

কারো কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কী?সানজিদা বারী: আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আমার মা। তিনি আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধুও। আমার সব ভালো কাজের পেছনে মা-ই আমার প্রধানতম অনুপ্ররেণা। আর বাবা আমার সব অর্জন নিয়ে বরাবরই গর্বিত। ছোটভাই আমার সব কাজের প্রধান সমালোচক। তাই বলা যায়, আমার পরিবারই আমার প্রধানতম শক্তি। এছাড়া রুমী ও লিও তলস্তয় আমার প্রিয় লেখক। তারাও অনুপ্রেরণার একটা বড় উৎস হিসেবে কাজ করে। আমার জীবনে শিক্ষকদেরও ভূমিকা আছে। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

কাজ নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?সানজিদা বারী: পিঙ্ক ফ্লয়েড আমার প্রিয় ব্যান্ড। তাদের একটা গান আছে। সেই গানের লিরিক্স হচ্ছে এরকম— A Soul in tension that's Learning to Fly Condition grounded but determined to try হ্যাঁ, আমি চেষ্টা করি। আমার নিজের এবং আমাদের সমাজের গুণগত পরির্বতন আনার চেষ্টাটা আমি করেই যাবো আজীবন। হয়তো বা সারাজীবন! এছাড়াও নিজেকে শুধু দেশের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। এখন কাজ করছি জাতিসংঘ বাংলাদেশে। ভবিষ্যতে হয়তো বা কাজ করবো অন্য দেশে শ্রমিক অথবা শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে। এছাড়াও লেখক হওয়ার ইচ্ছা আছে। যা জানছি, শিখছি অথবা অনুভব করি, তা জানাতে চাই সবাইকে। তাই অচিরেই বের হবে আমার নতুন বই!

এসইউ/পিআর