খেলাধুলা

‘পাকিস্তানের বিপক্ষে ছিলাম টপ স্কোরার, এটাই অন্যরকম ভালো লাগার’

রোম নগরী যেমন একদিনে তৈরি হয়নি, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের ক্রিকেটও রাতারাতি বা একদিনে আজকের অবস্থানে আসেনি। এক সময় বিশ্বকাপ খেলা ছিল শুধুই কল্পনা। বাংলাদেশ তখন কেনিয়া, আরব আমিরাত, নেদারল্যান্ডস, স্কটল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডের সাথে লড়াই করেছে। সে লড়াই আইসিসি ট্রফির গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বকাপ খেলার। সে লড়াই ক্রিকেটের সর্ববৃহৎ মঞ্চে ওঠার।

Advertisement

এবং সে লড়াই একদিনের নয়, সেই ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৯৭- গুণে গুণে ১৮ বছর। এ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অনেক ক্রিকেটার, কোচ, সংগঠক ও পৃষ্ঠপোষক সম্পৃক্ত। তাদের সবার কঠোর পরিশ্রমের ফসল আজকের এই অবস্থান।

সেই ১৯৭৯ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন বুকে নিয়ে শফিকুল হক হীরার নেতৃত্বে আইসিসি ট্রফি খেলতে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন রকিবুল হাসান, ইউসুফ বাবু, সৈয়দ আশরাফুল হক, রফিকুল আলম, দৌলতুজ্জামান, দিপু রায় চৌধুরীরা। তারপর ১৯৮২, ১৯৮৬, ১৯৯০ আর ১৯৯৪ সালে পরপর স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় ডোবা।

অবশেষে ১৯৯৭ সালে স্বপ্ন পূরন। বিশ্বকাপ খেলার টিকিট নিশ্চিত করার পাশাপাশি আইসিসি ট্রফি বিজয়ের কৃতিত্ব দেখালো টাইগাররা। ওই চ্যালেঞ্জিং মিশনে হাতে গোনা যে কজন ক্রিকেটারের অবদান অবিস্মরণীয়, তাদের মধ্যে অন্যতম ‘আকরাম খান।’

Advertisement

তিনিই বাংলাদেশের ক্রিকেটের সফল সেনাপতি। তার নেতৃত্বেই আইসিসির সহযোগি সদস্যের গন্ডি পেরিয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপের টিকিট পেয়েছিল বাংলাদেশ। যে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে বাংলাদেশ সেরা চারের টিকিট নিশ্চিত করেছিল, সেই বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচে লড়াই-সংগ্রাম করে ডাচদের হাতের মুঠো থেকে বাংলাদেশের জয়ের কেতন উড়িয়েছিলেন আকরাম খান।

বলা যায়, আকরামের সেই এক ইনিংস বেদিতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট। ১৯৯৭ সালের ১৩ এপ্রিল মালয়েশিয়ার কিলাত ক্লাব মাঠে আইসিসি ট্রফি হাতে আকরাম খানের হাসি ভরা মুখ, উচ্ছাস-উল্লাস দীর্ঘ দিন ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন।

সেই বিজ্ঞাপনের মডেল আর বাংলাদেশের আইসিসি ট্রফি বিজয়ের বড় মিশনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া আকরাম খান তাই বাংলাদেশের ক্রিকেট অনুরাগি, ভক্ত-সমর্থক তথা দেশবাসির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। থাকবেন বহুদিন।

কিন্তু ১৯৯৯ সালে প্রথম বিশ্বকাপে অবশ্য আকরাম অধিনায়ক ছিলেন না। তাতে কি! অধিনায়ক তো একজনই থাকেন। প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল; কিন্তু এখন যেমন ‘পঞ্চ পান্ডব’, তখন ছিল তিন পান্ডব- আমিনুল ইসলাম বুলবুল, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু আর আকরাম খান।

Advertisement

দলের অন্যতম নির্ভরতা। ব্যাটিং স্তম্ভ। প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া আকরাম খান জাগো নিউজের সাথে একান্ত আলাপে অনেক কথাই বলেছেন। তার চৌম্বক অংশ নিচে তুলে ধরা হলো।

আসুন কেমন ছিল আকরাম খানের প্রথম বিশ্বকাপ যাত্রা সেটা জেনে নিই-

আকরাম খান : প্রথম কথা হলো সেটা ছিল আমাদের প্রথম বিশ্বকাপ। স্বপ্নের-কল্পনার বিশ্বকাপ। অনেক আবেগ, শিহরণ, রোমাঞ্চ আর পুলক জাগানো। সে আসর খেলার জন্য আমরা এবং আমাদের বড়রা দীর্ঘ দুই যুগ পরিশ্রম করেছেন। অবশেষে ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে আইসিসি ট্রফি বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বকাপ খেলার পূর্বশর্ত পূরণ হয়েছিল। আমরা ওয়ার্ল্ডকাপের টিকিট কনফার্ম করেছিলাম। আর ১৯৯৯ সালে সেই স্বপ্ন পূরণ ঘটে মাঠে। আমরা প্রথমবার সারা দেশ ও জাতির দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন পূরণ করি বিশ্বকাপের মাঠে বল ও ব্যাট হাতে নেমে।

যেহেতু আমি নিজে ওই আইসিসি ট্রফি বিজয়ের অধিনায়ক ছিলাম, তাই আমি খুব ভাল জানি কত পরিশ্রম, কত দিনের সাধনার ফসল ছিল বিশ্বকাপ খেলা। কাজেই যখনই ৯৯’র বিশ্বকাপ খেলার প্রসঙ্গ আসে, তখন আমার একার শুধু নয়, আমাদের সবার মনে একটা শিহরণ জাগে। শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। অন্যরকম আবেগ কাজ করে। আমিও আবেগতাড়িৎ হয়ে যাই।

এখনো সব স্মৃতি জ্বলজ্বল করছে। সেই বিশ্বকাপের আগে দেশের মাটিতে দীর্ঘ অনুশীলন ক্যাম্প। তারও এক বছর আগে যুক্তরাজ্যে প্রস্তুতি সফরে যাই আমরা। আর ঠিক মূল আসরের প্রায় ১৫-২০ দিন আগে গিয়ে ইংলিশ কন্ডিশনের সাথে ধাতস্ত হওয়া এবং কয়েকটি ভাল মানের ইংলিশ কাউন্টি দলের সাথে ওয়ার্মআপ ম্যাচ খেলেছিলাম আমরা। সব মিলিয়ে প্রস্তুতি ভালই হয়েছিল।

আমাদের ক্রিকেটের তখনকার যা আর্থ- সামাজিক অবস্থা, সে অনুযায়ী বলবো সামগ্রিক প্রস্তুতি ভালই হয়েছিল। এখন যেমন অনেক কিছুই আছে আমাদের। অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা, ট্রেনিং ফ্যাসিলিটিজ, আর্থিক সঙ্গতি, বিদেশি কোচিং স্টাফ, ট্রেনার, ফিজিও আর ভিডিও-কম্পিউটার অ্যানালিস্ট কত কিছু। হরেক রকম সুযোগ সুবিধাসহ অনেক আর্থিক সুযোগ সুবিধাও মিলছে এখন। কিন্তু তখন আমাদের অনেক কিছুই ছিল না। এখনকার সাথে কোন তুলনাই চলে না।

তবে সীমিত সুযোগ সুবিধার মধ্যেও আমাদের বিশ্বকাপ প্রস্তুতিতে তখনকার বোর্ডের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। আমার মনে হয় দেশে ও বিদেশে বিশ্বকাপ প্রস্তুতিটা তখনকার অবস্থা ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ভালই ছিল। সাথে ছিলেন গর্ডন গ্রিনিজের মত বিশ্বমানের এক তারকা ক্রিকেটার। যার নিজের বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা ছিল এবং যিনি নিজে দীর্ঘদিন ইংলিশ কাউন্টি খেলেছেন।

সেই সুবাদে ইংলিশ কন্ডিশন সম্পর্কে যার ধারণা ছিল সুস্পষ্ট। সব মিলিয়ে আমরা বেশ খুশি মনে খেলতে গিয়েছিলাম। আমরা প্লেয়াররা সবাই রোমাঞ্চিত ছিলাম। মাঠে ভাল খেলতে এক কথায় মুখিয়ে ছিলাম সবাই এবং সবাই নিজের সেরাটা উপহার দিতে প্রাণপন চেষ্টাও করেছে।

তারপরও আমার মনে হয় ওই বিশ্বকাপে একটা মাইনাস পয়েন্ট ছিল। যা একদমই নেই এখন। তখন বোর্ড আমাদের প্রস্তুতি কার্যক্রমটা ভাল করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও আমাদের ওপর ভাল করার চাপ ছিল প্রচুর। পরিচালকদের একটা অংশ ক্রিকেটারদের প্রচুর চাপ প্রয়োগ করতেন। একটু ‘নুন থেকে চুন খসলেই’ ব্যাস শুরু হতো নানা রকম প্রেসার। এখন যার কিছুই নেই। একজন ক্রিকেটারও বলতে পারবে না, তাদের ওপর কোন বাড়তি চাপ সৃষ্টি করা হয়। কারো বড় ধরনের ব্যর্থতার পরও বোর্ড থেকে কারও ওপর এতটুকু দোষারোপ করা হয় না। এই যে চাপমুক্ত হয়ে খেলা- সেটা প্রথমবার কম ছিল। আমার এখন মনে হয়, পরিচালকদের চাপ কম থাকলে ৯৯’তে পারফরমেন্স আরও ভাল হতো।

আমার প্রথম বিশ্বকাপের স্মৃতি আর স্মরণীয় ঘটনা দুটি। এক অবশ্যই পাকিস্তানের সাথে অবিস্মরণীয় জয়। প্রথমবার বিশ্বকাপের মত বড় মঞ্চে খেলতে নেমে সে সময়ের অন্যতম সেরা ও দুর্ধর্ষ দল পাকিস্তানকে হারানো চাট্টিখানি ব্যাপার ছিল না। অনেক অনেক বড় সাফল্য। এখন আমরা প্রায়ই বড় বড় দলকে হারাই; কিন্তু তখনকার সময় ও প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানীদের হারানো ছিল বিশ্ব জয়ের মতই।

মনে হলে আমি এখনো উদ্বেলিত হয়ে পড়ি। ঐ ম্যাচের স্মৃতিচারণ করতে গেলে সবার আগে মনে হয়, পাকিস্তানের সাথে আমরা টিম ইফোর্টে জিতেছিলাম। কম বেশি সবার অবদান ছিল। তবে ব্যাটসম্যান হিসেবে আমার একটা কৃতিত্ব ছিল, আমি দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি (৬৬ বলে ৪২) রান করেছিলাম।

প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে পাকিস্তানকে হারানোর ঐতিহাসিক ম্যাচে আমি ছিলাম টপ স্কোরার- এটা অনেক বড় পাওয়া। ওই ম্যাচের কথা যতবার উচ্চারিত হবে, আমার সবচেয়ে বেশি রান করার কথাও ততবারই উচ্চারিত হবে।

তবে এর বাইরে একটি তিক্ত ও দুঃখের স্মৃতিও আছে। সেটা মনে হলে মনটা ব্যাথায় ভরে যায়। পাকিস্তানের সাথে জয়ের শুভক্ষণে আমাদের সাথে ছিলেন না কোচ গর্ডন গ্রিনিজ। যে মানুষটি তারও প্রায় আড়াই বছর আগে থেকে আমাদের সাথে কাজ করেছেন, আমাদের এগিয়ে নিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, আসল সাফল্যের দিনে তিনিই অনুপস্থিত, প্লেয়ার হিসেবে আমাদের খুব খারাপ লেগেছে। পাকিস্তানকে হারানোর পর বিজয় উল্লাসটা তাই ফিকে হয়ে পড়েছিল। সবাই গর্ডনকে মিস করেছি।’

এআরবি/আইএইচএস/পিআর