ধর্ম

ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ে যা ঘটেছিল ২০ রমজান

হুদায়বিয়ার সন্ধিকে আল্লাহ তাআলা প্রকাশ্য বিজয় ঘোষণা দিয়েছিলেন। আল্লাহর সেই প্রকাশ্য বিজয় ৮ম হিজরির ২০ রমজান সফলতার মুখ দেখে। মক্কার মুক্ত বাতাসে প্রশান্তির সুঘ্রাণ লাভ করেন বিশ্বনবি। কৃতজ্ঞতায় সেজদায় লুটিয়ে পড়েন প্রিয় কাবা চত্ত্বরে।

Advertisement

২০ রমজান শুধু মক্কা বিজয়ই হয়নি বরং প্রিয় নবি স্বমহিমায় নিজ জন্মভূমিতে ফিরে এসেছিলেন। বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১০ হাজার সাহাবি নিয়ে ১০ রমজান মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।

১০ হাজার সাহাবির বিশাল মুসলিম বাহিনী বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সফল নেতৃত্বে বিনা রক্তপাতে ঐতিহাসিক মক্কা বিজয় করনে। এ বিজয়ের ফলে ইসলামের ইতিহাসে ২০ রমজান ঐতিহাসিক অমরত্ব লাভ করে।

এ পবিত্র নগরীতে অবস্থিত বায়তুল্লাহ বা তাওহিদের কেন্দ্রভূমি ‘কাবাঘর’। যা সর্ব প্রথম হজরত আদম আলাইহিস সালাম নির্মাণ করেছিলেন। অতঃপর বর্তমান কাবঘর আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম নির্মাণ করেছিলেন।

Advertisement

কাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে মক্কা বিজয়ের ১০ বছর আগে আল্লাহর নির্দেশে এ পবিত্র ভূখণ্ড ছেড়ে রাতের অন্ধকার মক্কা ছেড়ে মদিনায় গমন করেছিলেন প্রিয় নবি।

তাওহিদের কেন্দ্রভূমি পবিত্র কাবাকে মূর্তি পূজা, অশ্লীলতা ও শিরকের স্থান থেকে মুক্ত করতে বিশ্বনবি রমজান মাসকেই উপযুক্ত সময় মনে করেন। সে লক্ষ্যেই ১০ রমজান মদিনা থেকে ১০ হাজার সাহাবি নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হন। ২০ রমজান মক্কায় পৌছে বিনা রক্তপাতে বিজয় করেন পবিত্র ভূমি মক্কা। ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের সময় যেসব ঘটনা ঘটে। তার কিছু তুলে ধরা হলো-

আরও পড়ুন > নামাজে দ্রুত রুকু-সেজদা ও এদিক-ওদিক তাকানো যাবে কি?

আবু সুফিয়ানের গ্রেফতার ও ইসলাম গ্রহণমুসলিম বাহিনী মক্কার কাছাকাছি আসলে মক্কার নেতা আবু সুফিয়ান তাদের অবস্থান জানতে গোপনে সেখানে উপস্থিত হলে মুসলিম বাহিনীর হাতে ধরে পড়ে যান।

Advertisement

মক্কা বিজয়ের আগের ইসলাম ও মুসলমানদের অনেক ক্ষতি করেছিল আবু সুফিয়ান। বিশ্বনবিকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অন্যতম পরিকল্পনাকারীও ছিল আবু সুফিয়ান। সে হিসেবে তাকে দেখামাত্রই হত্যা করার কথা ছিল। কিন্তু মুসলিম বাহিনী তা না করে আবু সুফিয়ানকে বিশ্বনবির কাছে হস্তান্তর করেন।

বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু সুফিয়ানকে করুণা করেন। তিনি বললেন, হে আবু সুফিয়ান! যাও, আজ তোমাকে কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না। আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করে দিন। তিনি সমস্ত ক্ষমা প্রদর্শনকারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ ক্ষমা প্রদর্শনকারী।

বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ আচরণ দেখে মুগ্ধ হয়ে যান আবু সুফিয়ান। তার মধ্যে এক সুন্দর চিন্তার সৃষ্টি হলো। তিনি বুঝতে পারলেন, বিশ্বনবি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের জন্য মক্কায় আসেননি। তার এ আগমনে দখলদারিত্বের কোনো ইঙ্গিতও নেই। দুনিয়ার রাজা-বাদশাহদের মতো কোনো প্রতিশোধ স্পৃহা ও অহংকারবোধের চিহ্নও নেই।

সে কারণে মুক্ত হওয়া সত্ত্বেও আবু সুফিয়ান মক্কা ফিরে না গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে বিশ্বনবির এ কাফেলায় অংশগ্রহণ করেন।

আরও পড়ুন > পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের রাকাআত সংখ্যা

মক্কায় প্রবেশের আগে বিশ্বনবির নির্দেশ ও নসিহতরাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় প্রবেশের আগে হজরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে এ নির্দেশ দিলেন যে, তুমি পেছন থেকে মক্কায় প্রবেশ কর। আর মক্কার কোনো অধিবাসীকে হত্যা করবে না। তবে কেউ যদি তোমার ওপর অস্ত্র ওঠায়; তবে তুমি শুধুমাত্র আত্মরাক্ষার জন্য অস্ত্র ধারণ করবে।

এ নির্দেশ দিয়ে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সামনের দিক থেকে পবিত্র নগরী মক্কায় প্রবেশ করেন। তিনি পবিত্র নগরী মক্কায় প্রবেশকালে কোনো প্রতিরোধের স্বীকার হননি এবং কোনো হতাহতের ঘটনাও ঘটেনি।

খালিদ ইবনে ওয়ালিদের কৈফিয়ত গ্রহণহজরত খালিদ বিন ওয়ালিদের সৈন্যবাহিনীর ওপর কতিপয় কুরাইশ গোত্রের লোক তীর বর্ষণ করে; যার ফলে তিনজন মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন। হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ প্রতিহত করতে গেলে তাতে ১৩ জন লোক নিহত হয় আর অন্যরা পালিয়ে যায়।

৩ মুসলমানের শাহাদাত এবং ১৩ জন মক্কার লোকের নিহত হওয়ার ঘটনার জন্য বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে কৈফিয়ত চান। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ ঘটনার প্রকৃত বর্ণনা দিলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, ‘আল্লাহর ফয়সালা এ রকমই ছিল’।

বিশ্বনবির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণারক্তপাতহীন বিজয়ে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কাবাসীদের প্রতি কোনোরূপ প্রতিশোধ গ্রহণ না করে মুসলমানদের নিরাপত্তার স্বার্থে ও শৃঙ্খলার জন্য শর্তসাপেক্ষে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। বিশ্বনবির ঐতিহাসিক সে ঘোষণাটি ছিল এমন->> যারা নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করবে এবং দরজা বন্ধ রাখবে, তারা নিরাপদ।>> মক্কার নেতা আবু সুফিয়ানের ঘরে যারা অবস্থান করবে, তারাও নিরাপদ।>> পবিত্র কাবাঘরে যারা আশ্রয় গ্রহণ করবে, তারাও নিরাপদ।

আরও পড়ুন > কেবলা জানা না থাকলে নামাজ পড়বেন যেভাবে

মক্কা প্রবেশকালে বিশ্বনবির সাজ-সজ্জাসাদা ও কালো রঙের পতাকা ধারণ করে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র ভূমি মক্কায় প্রবেশ করেন। মাথায় পরেন লৌহ নির্মিত শিরাস্ত্রণ এবং তার ওপর কালো পাগড়ি।

মক্কায় প্রবেশ কালে তিনি ‘সুরা ফাতেহা’ তেলাওয়াত করতে থাকেন। তাঁর এ আগমনে মহান আল্লাহর প্রতি অগাধ আস্থা ও বিনয়-নম্রতা প্রকাশ পেয়েছিল। তার বিনয় ও নম্রতা এতটাই বেশি ছিল, যে সাওয়ারিতে তিনি আরোহন করেছিলেন, সে উটের ওপর ঝুঁকে পড়ার ফলে তার পবিত্র চেহারা উটের কুঁজ স্পর্শ করছিল।

মক্কায় প্রবেশকালে বিশ্বনবির সঙ্গীহিজরতের সময় ঘনিষ্ট সহচর হজরত আবু বকর থাকলেও প্রিয় জন্মভূমি পবিত্র মক্কায় প্রবেশকালে বিশ্বনবির বাহনে তার সঙ্গী ছিলেন শিশু হজরত উসামা রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি হজরত জায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ছেলে।

পবিত্র কাবাঘরে প্রবেশপবিত্র নগরী মক্কায় প্রবেশ করে সর্ব প্রথম তাওহিদের মর্যাদা রক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি পবিত্র কাবা ঘরে প্রবেশ করে সর্বপ্রথম মূর্তিগুলোকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলার নির্দেশ দেন। সে সময় কাবাঘরে ৩৬০টি মূর্তি রক্ষিত ছিল। কাবাঘরের দেয়ালে ছিল অংকিতচিত্র। এ সবই তিনি প্রথমে নিশ্চিহ্ন করে দেন।

মক্কা বিজয়ের উৎসব : কাবাঘর তাওয়াফপবিত্র কাবাঘরকে শিরকের নোংরামী ও অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করার পর তিনি উচ্চস্বরে তাকবির ধ্বনিসহ কাবা শরিফ তাওয়াফ করেন। তার এ তাওয়াফ ও তাকবির ধ্বনিই ছিল মক্কায় বিজয়ের উৎসব ও স্লোগান।

বিশ্বনবির তাওয়াফের উৎসব ও তাকবিরের স্লোগান দেখে মক্কাবাসীদের অন্তর চোখ খুলে যায়। তারা অনুভব করতে সক্ষম হয় যে, এতবড় বিজয় উৎসবেও তারা কোনো শান-শওকতের পথ গ্রহণ না করে অত্যন্ত বিনয়াবনত মস্তকে আল্লাহ প্রশংসা ও কাবা ঘর তাওয়াফ করে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বই ঘোষণা করছে। এ বিজয় প্রকৃত পক্ষেই তাওহিদের বিজয়।

আরও পড়ুন > নামাজ পড়বেন যেভাবে

অতঃপর বিশ্বনবির ভাষণঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের পর বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ভাষণের শুরুতেই তিনি তাওহিদের ঘোষণা দিয়ে বলেন->> ‘এক আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তার কোনো শরিক নেই। তিনি তাঁর সব ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছেন। তিনি তাঁর বান্দাদের সাহায্য করেছেন এবং সমস্ত শত্রুবাহিনীকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।’

>> জেনে রাখুন! গর্ব ও অহংকার, আগের সব হত্যা ও রক্তপণ এবং সব রক্তমূল্য আমার পায়ের নিচে। শুধুমাত্র পবিত্র কাবাঘরের তত্ত্বাবধান এবং হাজিদের পানি সরবরাহ এর ব্যতিক্রম।

>> হে কুরাইশ সম্প্রদায়! অন্ধকার যুগের সব আভিজাত্য ও বংশ-মর্যদার ওপর গর্ব-অহংকার প্রকাশকে আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন। সব মানুষ এক আদমের সন্তান আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে। অতঃপর বিশ্বনবি সুরা হুজরাতের ১৩নং আয়াত তেলাওয়াত করেন। আর তাহলো-‘হে লোক সকল! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের নানা গোত্র ও জাতিতে বিভক্ত করে দিয়েছি, যেন তোমরা একে অপরকে চিনতে পার। কিন্তু আল্লাহর নিকট সম্মানিত হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে অধিকতর আল্লাহকে ভয় করে। আল্লাহ মহাবিজ্ঞ ও সর্বজ্ঞ। (সুরা হুজরাত : ১৩)

আরও পড়ুন > সারারাত নামাজের সাওয়াব লাভের সহজ উপায়

যে ভাষণে শত্রুর হৃদয় জয়মক্কা বিজয় মুসলিম উম্মাহর জন্য অনেক বড় শিক্ষা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরাইশদের উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেখানে মক্কার সব গোত্রের বড় বড় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। যারা ইসলাম ও মুসলমানদেরকে মক্কা নগরীর নিজ নিজ বাড়ি-ঘর থেকে বিতাড়িত করেছিলেন।

তাদেরকে উদ্দেশ্য করে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনারা বলুন! আজ আমি আপনাদের সঙ্গে কিরূপ আচরণ করব?

তখন তারা উত্তর দিয়েছিল, ‘আপনি আমাদের সম্মানিত ভাই এবং সম্মানিত ভাইয়ের ছেলে।

এ কথা শুনে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করলেন, ‘আজ আর আপনাদের ব্যাপারে কোনো অভিযোগ নেই। আপনার সবাই মুক্ত। বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ ভাষণে মক্কার চরম শত্রুরাও তার ভাষণে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ভালোবাসার আবেগে আপ্লুত হয়েছিলেন।

এভাবেই ঘোষিত হয়েছিল পবিত্র নগরীরি ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়। যা বিশ্ব মানবতার জন্য এক মহান শিক্ষা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ে বিশ্বনবির গৃহীত সিদ্ধান্ত ও নসিহতগুলো বাস্তবজীবনে পালনের তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/এমএস