এলিজা বিনতে এলাহী একজন বিশ্বমানের পর্যটক। ১৯৭৬ সালের ০৬ এপ্রিল ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মরহুম এস এম এলাহী নেওয়াজ, মা সাবেক সংসদ সদস্য রহিমা খন্দকার। এলিজা পড়াশোনা করেছেন শহীদ বীর উত্তম লে. গার্লস কলেজ, লালমাটিয়া মহিলা মহাবিদ্যালয়, ইডেন মহিলা কলেজ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এবং নেদারল্যান্ডসের দি হেগ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেসে। শিক্ষকতার পাশাপাশি পর্যটক হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। সম্প্রতি দেশ-বিদেশ ভ্রমণের গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহিদ হাসান—
Advertisement
আপনার শৈশব ও কৈশোর কেমন কেটেছে?এলিজা বিনতে এলাহী: আমার শৈশব-কৈশোর ঢাকায় কেটেছে। বলতে গেলে খেলাধুলা, পড়াশোনা ও পরিবারের সাথে ঘোরাঘুরি করেই কেটেছে। ফলে পড়াশোনা বা কোন কিছুতে কখনোই কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল না।
ক্যারিয়ার যাত্রা ও জীবনের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানতে চাই—এলিজা বিনতে এলাহী: আসলে আমার মা দীর্ঘ ৩৮ বছর শিক্ষকতা করেছেন। তাই ছোটবেলা থেকেই শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছে ছিল। শিক্ষকতা শুরু করেছি ২০০৭ সালে। কাজ করার ক্ষেত্রে পারিবারিক কোন বাধা নিষেধ ছিল না। কর্মক্ষেত্রে সাধারণ ছোটখাটো অসুবিধা ছাড়া তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা নেই।
> আরও পড়ুন- নেপাল ঘুরে এলেন নানজীবা খান
Advertisement
ক্যারিয়ারের পাশাপাশি আপনার বিশ্বব্যাপী ভ্রমণের গল্প শুনতে চাই—এলিজা বিনতে এলাহী: ভ্রমণ শুরু করেছি ১৯৯৯ সাল থেকে। তখন এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলো ভ্রমণ শুরু করি, যা এখনো অব্যাহত আছে। এ যাবত মোট ৪৬টি দেশের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর ভ্রমণ সমাপ্ত করেছি। ঘুরতে গিয়ে নিজ দেশের স্থাপনাগুলো ঘুরে দেখার তাগিদ থেকে ২০১৬ সালে হেরিটেজ ট্যুর শুরু করি। দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো সংরক্ষণ করে হেরিটেজ ট্যুরিজমের আওতায় এনে জনসচেতনতা বাড়ানো এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি। ঢাকার বলধা গার্ডেন দিয়ে এ যাত্রা শুরু হয়। ৪৯টি জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা প্রাথমিকভাবে ভ্রমণ ও তথ্য সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন করেছি। এ প্রজেক্টের নাম ‘কুয়েস্ট... এ হেরিটেজ জার্নি অব বাংলাদেশ’। যা আমার অর্থায়নে করা। তবে ভ্রমণ করতে গিয়ে ছোট ছোট প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। যেমন- প্রত্নতত্ত্ব পর্যটন যেহেতু একটি বহুল প্রচলিত শব্দ নয়, তাই এটি বোঝাতে বেশ কষ্ট হয়েছে। প্রথমে ট্রাভেলের সাথে এর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে স্থানীয় লোকজন, বন্ধুমহল, পরিবারের সবাই সন্দেহ প্রকাশ করছিল। তবে ধীরে ধীরে সহযোগিতাও প্রচুর পেয়েছি।
দেশ-বিদেশে ভ্রমণের প্রতি আগ্রহটা কখন কিভাবে শুরু হলো? এলিজা বিনতে এলাহী: দেশে ঘুরে বেড়াই ছোটবেলা থেকেই। প্রথমে পরিবারের সাথে শুরু হয় ভ্রমণ। কারণ পরিবারের সবাই ভ্রমণপ্রিয়। তাছাড়া আমি কখনোই গতানুগতিক জীবন যাপন করতে চাইনি। আমার কাছে জীবন উপভোগের বিষয়। আমি উপভোগ করি ভ্রমণের মাধ্যমে। বিদেশে প্রথম যাই ১৯৯৯ সালে। ২০০৮ সাল পর্যন্ত খুবই অনিয়মিতভাবে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের শহরগুলো ও নেপালে গেছি। তারপর আসলে ২০০৯ সালে ভারতের হিমাচল প্রদেশ দিয়ে শুরু হয় ভ্রমণের যাত্রা। সে সময় ২২ দিন কাটিয়েছি পুরো হিমাচল প্রদেশ দেখার জন্য। আগেই বলেছি, বাংলাদেশে ভ্রমণ শুরু করি ২০১৬ সালে।
কারো কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কি? এলিজা বিনতে এলাহী: প্রথমে আমি নিজেই নিজেকে অনুপ্রাণিত করেছি। আর এখন অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে সারা দেশের মানুষ।
> আরও পড়ুন- ৯৯তম দেশ ভ্রমণ করলেন কাজী আসমা
Advertisement
ভ্রমণ নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?এলিজা বিনতে এলাহী: বাংলাদেশের ৬৪ জেলা ভ্রমণ শেষ করে প্রতিটি বিভাগ নিয়ে আলাদা করে প্রকাশনা, ভিডিওচিত্র প্রদর্শনী, আলোকচিত্র প্রদর্শনী করবো। আসলে এটি একটি প্রাথমিক পরিভ্রমণ। হেরিটেজ ট্যুরিজমকে একটি যথাযথ উচ্চতায় নিয়ে যেতে হলে এবং প্রতিটি জেলার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হলে এ ভ্রমণ আসলে মৃত্যুঅবধি। আর আমি বাংলাদেশকে দেখতে চাই পৃথিবীর অন্যতম হেরিটেজ ট্যুরিজমের দেশ হিসেবে। এটি কষ্টসাধ্য, তবে অসম্ভব নয়। আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের প্রমাণ করেছি। হেরিটেজ ট্যুরিজমের ক্ষেত্রেও তা হবে নিশ্চয়ই। আর ওয়ার্ল্ড ট্রাভেলের কথা বললে– পৃথিবীর ২০০ দেশই ভ্রমণ করার ইচ্ছে আছে। তবে পাকিস্তান ও ইসরাইল বাদ দিয়ে।
ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন—এলিজা বিনতে এলাহী: একটি নতুন শহরে ভ্রমণ (দেশে অথবা বিদেশে) মানেই নতুন কিছু শেখা। নতুন মানুষের সাথে পরিচয়। নতুন কিছু জানা। বাংলাদেশের ৪৩ জেলা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যা কিছু দেখেছি, জেনেছি, মানুষের সাথে মিশেছি সবকিছু যদি লিপিবদ্ধ করতে চাই, তাহলে এক জীবন অনেক কম। নিজের দেশে ভ্রমণ আমার কাছে স্রেফ ঘুরে বেড়ানো নয় বরং ভ্রমণ মানে ইতিহাস, প্রেরণা, ঐতিহ্য, শক্তি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, আত্মপরিচয় আর শেকড়ের সন্ধানে এক বিনির্মাণের যাত্রা।
২০ বছরের বিশ্ব ভ্রমণের যাত্রায় আমার নিজেকে সত্যিকার ট্রাভেলার মনে হয়েছে, যখন আমি বাংলাদেশের কোণায় কোণায় গেছি। আমার দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মানুষ আমাকে যা আনন্দ দিয়েছে পৃথিবীর বড় বড় দেশ তা দিতে পারেনি। আমি দেখেছি গর্ব করার মত বিশ্বমানের স্থাপনা আমাদেরও রয়েছে। প্রয়োজন শুধু সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রচার-প্রচারণা।
> আরও পড়ুন- ভ্রমণকাহিনিতে সেরা রাঙ্গামাটির মুমু
ভ্রমণের প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করতে আপনার পরামর্শ কী? এলিজা বিনতে এলাহী: বিশ্বে পর্যটন একটি সম্ভনাময় শিল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ট্যুরিজমের অনেক শাখা আছে। যেমন– এডুকেশন ট্যুরিজম, ব্যবসা ট্যুরিজম, অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম, হেরিটেজ ট্যুরিজম ইত্যাদি। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো, এমনকি উন্নয়নশীল দেশগুলো পর্যটনের বিভিন্ন শাখাগুলো নিয়ে কাজ করছে এবং বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। যা একটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দিচ্ছে।
পর্যটনের এ শাখাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো হেরিটেজ ট্যুরিজম। সব দেশ তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরে আকর্ষণ করছে কোটি কোটি পর্যটককে। আমাদের পাশের দেশ ভারত, নেপাল, লাওস, কম্বোডিয়ার মত দেশও তাদের দেশে হেরিটেজ ট্যুরিজমের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনছে।
বছরজুড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরতে ঘুরতে মনে হলো নিজের দেশটাও ঘুরে দেখি। বিশেষ করে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রত্নতাত্ত্বিক জায়গাগুলো ঘুরতে গিয়ে আবারও মনে হয়েছে, গর্ব করার মত নানা বৈচিত্রে ভরপুর এক সমৃদ্ধ জনপদ ‘বাংলাদেশ’। তাই অন্য দেশ পারলে আমরাও পারবো।
এসইউ/এমএস