ভারতের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির বিপুল বিজয়! নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি এককভাবে পেয়েছে তিন শ’-র বেশি আসন। আর এনডিএ জোট মিলিতভাবে সাড়ে তিনশ-র বেশি। এই ফলাফল খুব একটা অপ্রত্যাশিত ছিল তা হয়তো না। তবে খানিকটা অকল্পনীয়। সেটা নির্বাচনোত্তর সময়ে নির্বাচন বিশ্লেষকরা মুখে বলুন বা নাই বলুন।
Advertisement
মোদির জয়। এই শব্দ দুটোর উল্টো পিঠে কারো না কারো পরাজয়ও আছে। কিন্তু পরাজয়টা কার? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে বহুভাবে।এই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। সেটা রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক, রাজনৈতিক নেতাদের কাজ। অতিসরলীকরণ করে অনেকে বলছেন; বিরোধীদের পরাজয়। গাণিতিক হিসাবে ফলাফল তাই বলে। কিন্তু বাহাত্তর বছর বয়সী গণতান্ত্রিক ভারতের গণতান্ত্রিক ইতিহাসকে পাশে সরিয়ে রেখে শুধু গাণিতিক হিসাবে উত্তরটা মেলানোর চেষ্টা ভুল। খুব বড় ভুল।
ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। সেই দেশটার নির্বাচনকে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক উৎসব। বহুত্ববাদ, ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতে এবার সেই নির্বাচনী উৎসব রীতিমত গৈরিক বিপ্লবে রুপ নিল! সেখানেই ধাক্কা খেয়েছে ধর্ম নিরপেক্ষ ভারত। বিজেপির মত ধর্মকে পুঁজি করে উঠে আসা একটা রাজনৈতিক দলের পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেলো সারা ভারত জুড়ে! যে আওয়াজ ভারতের গণতন্ত্রের জন্য খুব শ্রুতিমধুর হতে পারে না।
তবে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা তো আগের মতই আছে। জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসন। মোদি সরকারের গেলো পাঁচ বছরের শাসনের মাঝে সেটাই অনেক বেশি খুঁজে পেয়েছিলেন ভারতীয় জনগণ? যে কারণে এবার তারা আরো শক্তিশালী বিজেপি সরকারকে দেখতে চাইলেন দিল্লির গদিতে! নাকি মোদিতেই আস্থা করলেন গণতন্ত্রের অন্য চেহারা দেখতে?
Advertisement
মোদির এই জয়কে তাঁর সমালোচকরা অনেকভাবে ব্যাখ্যা করছেন। তাঁরা বলার চেষ্টা করছেন, মোদির জয়, বাহুবলে। বাক্যবলে। বিত্তবলে। এভাবে বলার পেছনে হয়তো কিছু কারণ, তাঁরা খুঁজে পাচ্ছেন। সত্যি কথা হচ্ছে; মোদি যেভাবে বাক্য চর্চা করেছেন নির্বাচনী প্রচারণায়, সেটা সাধারণ মানুষ হয়তো তাদের ভাষা মনে করেছেন। আবার মোদি বিরোধী শিবির থেকে যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, সেখানেও সেই মোদি। সেখানে নিজেদের দলের আদর্শ, ভবিষৎ পরিকল্পানর চেয়ে অনেক বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সেই ‘মোদি’ শব্দটা!
ক্ষমতায় থাকা বিজেপি অর্থ বলেও এগিয়ে ছিল বিরোধীদের চেয়ে। আর বাহুবল? সেটা নির্বাচন পরবর্তীতে সময়ে পরিষ্কার দেখা গেছে, মধ্যপ্রদেশে গো মাংস বহনকারীদর মারধর করার মধ্য দিয়ে। সব কিছু মিলিয়ে পুরো নির্বাচন জুড়েই ছিল মোদি বনাম মোদি বিরোধিতা! তাই নির্বাচনটা হয়ে গেলো মোদি কেন্দ্রিক। জয় হলো মোদির। গৌণ হয়ে গেলো বিজেপি! কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজবাদী পার্টিসহ বামফ্রন্ট।
মোদির জয়- এই দুই শব্দের উল্টো পিঠে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে আপাতত ভারতের বহুদলীয় গণতন্ত্রের বড় পরাজয়! ভারতের আছে সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চার পুরনো বিশাল ঐতিহ্য। সেই ঐহিত্যের ঘটি হয়তো ভেঙে পড়েনি। কিন্তু ফুটো দেখা দিয়েছে। সেখান থেকে ঐতিহ্যের জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে! তাই কংগ্রেস বিজেপি, কিংবা বিজেপি-সমাজবাদী পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেস- বামফ্রন্ট এই সব লড়াই হারিয়ে গেছে এবারে লোকসভা নির্বাচনে। সব লড়াই মিলেছে গিয়ে ‘ মোদি’ নামক এক মোহনায়!
বিরোধীরা ভেসে গেছেন মোদিপ্লাবনে।পৃথক পৃথক ভাবে মোদিকে রুখে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা বালির বাঁধের মত ভেসে গেছে। ১৩৩ বছর বয়সী কংগ্রেস মোদি জোয়ারে উত্তর থেকে ভাসতে ভাসতে দক্ষিণে গিয়ে খানিকটা স্তিমিত হয়েছে বটে। কিন্তু তাতেও অস্বস্তি বেড়েছে। কারণ, আমেথির আসনে হেরেছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী নিজে। জিতেছেন দক্ষিণের একটা আসনে।
Advertisement
ঠাকুর মা, বাবা যে আসন ধরে রেখেছিলেন দীর্ঘদিন সেই আসনে রাহুল হারলেন, স্মৃতি ইরানির মত এক অভিনেত্রীকাম নেত্রীর কাছে! তাহলে কংগ্রেসের রাজনীতি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! রাহুল গান্ধী নির্বাচনের আগেই হয়তো টের পেয়েছিলেন তিনি আমেথিতে হারতে পারেন। তাই একটা দ্বিতীয় আসন খুঁজে নিয়েছেলিন। সংগে সংগে উত্তর প্রদেশের জনগণের বুঝতে বাকি ছিল না; কংগ্রেস সভাপতি নিজেই তাঁর জয়ের ব্যাপারে সন্দিহান। সেই বার্তা রাহুল নিজেই দিয়েছেন জনগণের কাছে।
তবে রাহুলের পরাজয়, মোদির জয় এই সমীকরণ দিয়ে ভারতীয় রাজনীতির সমীকরণ মেলাতে যাওয়া ভুল। কারণ, বিজেপি আশির দশকে দুইটি আসন থেকে চারদশকের কম সময়ে তিনশর বেশি আসন পেয়ে ক্ষমতায় পুনর্বহাল থাকলো। কংগ্রেস আবার ঘুরে দাঁড়াবে না তেমন গ্যারান্টি কে দিতে পারেন?
তবে ভারতীয় গণতন্ত্র নতুন এক বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে, তা নিয়ে কোন সংশয় নেই। তাহলে বহুত্ববাদে বিশ্বাসী ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতের গণতন্ত্র এখন নেতা নির্ভর হয়ে পড়লো! তাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের প্যারাডাইন বা আদিকল্পটি পাল্টে গেলো? নেতা সর্বস্ব, রাষ্ট্রপতি নির্ভর গণতন্ত্রের দিকেই কি এগিয়ে যাচ্ছে তারা। যেমন যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক বটে, কিন্তু নেতা নির্ভর এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত।
মোদির জয় ভারতীয় গণতান্ত্রিক চেহারার পরাজয় কী না, সেটা ভবিষৎ বলে দেবে। তবে বিজেপি কিন্তু দিনে দিনে ব্যক্তিকেন্দ্রিক গণতন্ত্র চর্চার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ভারত জুড়ে মোদির এই গৈরিক প্লাবণ, তাদের সেদিকে আরো ভাসিয়ে নিতে পারে।
গণতন্ত্র পরিবার কেন্দ্রিক হলে কী হয়, তার প্রমাণ যদি হয় এখন কংগ্রেস, তাহলে আগামীতে গণতন্ত্র কোন ব্যক্তি কেন্দ্রিক হলে, তারও একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে জনমানসে। মোদির জয়, ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতের গণতান্ত্রিক চেহারার অন্যরকম এক পরাজয় কী না সেটা সময় বলে দেবে।
লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস