** কানাডা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতামনা আর; আফ্রিকার কন্ডিশনে কেনিয়া ছিল আমাদের চেয়ে ভালো দল।’ ** ইস! একজন বড় ভাইও যদি কাঁধে হাত রেখে কিংবা পিঠ চাপড়ে অনুপ্রাণিত করতেন, সাহস জোগাতেন!’
Advertisement
বিশ্বকাপ অভিষেক- আবির্ভাব যদি হয় চমক জাগানো, ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপপুঞ্জে তৃতীয় বারের অংশ গ্রহণ যদি ভাবা হয় সাফল্যের সোনায় মোড়ানো, আর ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথম কোয়ার্টার ফাইনাল খেলাকে যদি ধরা হয় সেরা সাফল্য, বড় অর্জন ও প্রাপ্তি- তাহলে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ কি?
সেটা কি টাইগারদের ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে আছে না? অতিবড় বাংলাদেশ সমর্থকও একবাক্যে বলবেন, ‘নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই।’ অবশ্যই ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ বাংলাদেশের ব্যর্থতার আসর হয়ে আছে। সেটাও ছেটেখাট নয়। অনেক বড় ব্যর্থতার দলিল হয়ে আছে। যে আসরে টেস্ট খেলুড়ে দল ছাড়া আইসিসিসির দুই সহযোগি সদস্য কানাডা আর কেনিয়ার সাথেও পারেনি বাংলাদেশ।
ইতিহাস জানাচ্ছে, সেই ১৯৯৯ সালে প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে স্কটল্যান্ডের মাটিতে স্কটিশদের হারানোর পাশাপাশি ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, শোয়েব আখতার, সাঈদ আনোয়ার, আফ্রিদি, সেলিম মালিক, ইনজামাম, ইজাজ, মঈন খান আর সাকলাইন মোশতাকের গড়া পাকিস্তানের পরাক্রমশালী দলকে হারিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল টাইগারর।
Advertisement
আট বছর পর ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ আর ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মাটিতেও লাল সবুজ পতাকা উড়েছে পতপত করে। টাইগারদের শৌর্য্য-বীর্য্য প্রশংসিত হয় সবার কাছে।
২০০৭ সালে হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে প্রথম ম্যাচে রাহুল দ্রাবিড়, শেবাগ, শচিন, সৌরভ, যুবরাজ, ধোনি আর জহির খানের ভারতকে হারিয়ে যাত্রা শুরু। এরপর সেরা আটে গিয়ে অন্যতম হট ফেবারিট দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে চমকে দেয়া জয়- বাংলাদেশের বিশ্বকাপ যাত্রাকে করে রেখেছে সোনালী সাফল্যে মোড়ানো।
চার বছর আগে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের মাটিতে আইসিসির সহযোগি সদস্য আফগানিস্তানকে সহজে হারানো ছাড়াও ক্রিকেটের জনক অন্যতম সেরা শক্তি ইংল্যান্ডকে হারিয়ে রীতিমত আলোড়ন সৃষ্টি করে বাংলাদেশ।
সেই দলটাই যখন ২০০৩ সালে আইসিসির দুই সহযোগি দেশ কানাডা আর কেনিয়ার কাছে হারে এবং একটি জয়েরও দেখা পায় না, সেটা বড় সড় ব্যর্থতা অবশ্যই। এ কারণেই বলা হয়, ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ টাইগারদের ব্যর্থতায় ভরা বিশ্বকাপ।
Advertisement
এমন নয়, প্রিয় জাতীয় দলের ব্যর্থতায় ক্রিকেট ভক্ত, সমর্থকদেরই শুধু মন খারাপ হয়েছিল, গোটা জাতি হতাশায় মুষড়ে পড়েছিল। কারণ, বাংলাদেশ ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে কানাডার কাছে হেরেছিল ঠিক কোরবানীর ঈদের আগের দিন। রাত পোহালে ঈদ, আর প্রিয় জাতীয় দল বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে হেরেছে আনকোরা কানাডার কাছে।
একবার অনুমান করুন, ভাবুন! গোটা বাংলাদেশের কি অবস্থা তখন? এক কথায় ঈদটাই মাটি হয়েগিয়েছিল সবার। এখন বাংলাদেশ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, সেখানে এক আসরে দু’দুটি ‘নন টেস্ট প্লেয়িং দেশ’ মানে আইসিসির সহযোগি সদস্য দেশের কাছে হেরে যাওয়া হবে অনেক বড় ব্যর্থতার। লজ্জার। গ্লানিরও।
২০০৩ সালেও বাংলাদেশ ছিল টেস্ট খেলুড়ে দল। আর কেনিয়া-কানাডা এখনকার মতই তখনো আইসিসির সহযোগি সদস্য দল। তাদের কাছে হার। আর বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ম্যাচটি ছাড়া সব টেস্ট খেলুড়ে দলের কাছে পরাজয়ের বেদনা ও হতাশাই ছিল ২০০৩ সালে টিম বাংলাদেশের সঙ্গী।
সে বিশ্বকাপ যাত্রা আসলে কেমন ছিল?মাঠে কেন এমন ব্যর্থতার ঘানি টানতে হয়েছিল বাংলাদেশ দলকে? সে প্রশ্ন আজও শোনা যায় কারো কারো মুখে। ২০০৩ সালের ব্যর্থতাটা সত্যিই এক ‘ট্র্যাজেডিই’ হয়ে আছে? কিন্তু কেন ঘটেছিল সে ব্যর্থতা? কি কারণে সব ম্যাচে হারের তেতো স্বাদ পেয়েছিল খালেদ মাসুদ পাইলটের দল? তা নিয়ে ‘নানা মুনির নানা মত’।
এক পক্ষের দাবি, ২০০৩ সালে জাতীয় দল চরম ব্যর্থ হয়েছিল আসলে পাকিস্তানের লো প্রোফাইল এবং অধুনিক ক্রিকেট কোচিংয়ের অভিজ্ঞতাহীন কোচ মহসিন কামালের অযোগ্যতা, অদক্ষতা, অদুরদর্শিতা আর সামর্থ্যে কমতির কারণে।
তিনি আসলে বিশ্ব ক্রিকেট কোথায় দাঁড়িয়ে সেটাই জানতেন না। সেই সনাতন প্রথায় কোচিং করিয়েছেন। নিজে ছিলেন ফাস্ট বোলার, অথচ তিনি ব্যাটিং কোচিংও করিয়েছেন। ব্যাটসম্যানদের উদ্দেশ্যে তার একটি বক্তব্য এখনো কানে বাজে, ‘সিধা খেলো (সোজা ব্যাটে খেলো)।’
অতি সাধারণ মানের এক কোচের সনাতন ধারার কোচিং নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া, প্রস্তুতিতে ঘাটতি, অপ্রস্তুত অবস্থায় বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া। প্রতিপক্ষ দল সম্পর্কে এতটুকু ধারণা না থাকা, তাদের শক্তি-সামর্থ্য কি? কোন দলে কতজন ডান হাতি, কতজন বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান? বোলাররা কেমন? পেসার কতজন আর স্পিনারের সংখ্যা কত? তাদের কার কেমন মান ও সামর্থ্য? এসব কিছুই জানা ছিল না।
এমনকি কানাডার ফাস্ট বোলাররা যে দক্ষিণ আফ্রিকার পিচে মাথা ব্যাথার কারণ হতে পারে, সে ধারনাও ছিল না। এর বাইরেও কথা আছে...। অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলটের দূর্বল নেতৃত্ব তথা দল পরিচালনায় ত্রুটির কথাও বলা হয়।
এছাড়া দলে শৃঙ্খলায় ঘাটতি ছিল। ক্রিকেটারদের কেউ কেউ ছিলেন ছন্নছাড়া। টিম ম্যানেজমেন্ট তথা ম্যানেজার এবং কোচের ক্রিকেটারদের ওপর নিয়ন্ত্রন ছিল না। মাঠের বাইরে তাদের আচরণও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
এর বাইরে মাঠের পারফরমেন্স ছিল বাজে। চরম হতাশার। অতি সাধারণ মানের। বিশ্বকাপ মানের তো অবশ্যই না। এর আসলে কোনটা মূল কারণ, কি ছিল সেই ব্যর্থতার সাতকাহন? তা নিয়ে জাগো নিউজের সাথে অনেক খোলামেলা কথা বলেছেন ২০০৩ এর অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট।
জাগো নিউজ : কেমন ছিল সে বিশ্বকাপ? কতটা হতাশার ছিল?
পাইলট : খুবই হতাশার। দুঃখের। যন্ত্রনা আর কষ্টের। ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না, আসলে কতটা না পাবার বেদনায় ক্লিষ্ট ছিলাম। এখনো পোড়ায় সে না পারার যন্ত্রনা।
জাগো নিউজ : সবচেয়ে হতাশা আর কষ্টের দিন কি ছিল?
পাইলট : অবশ্যই কানডার কাছে হার। কারণ, আমরা তখন টেস্ট খেলুড়ে দল, আর কানাডা আইসিসির সহযোগি সদস্য। সে দেশে ক্রিকেট তত জনপ্রিয় নয়। প্রচার-প্রসারও তেমন নেই। সেই দলকেও হারাতে পারিনি আমরা। সেটা অনেক বেশি ব্যর্থতার। দুঃখের। যন্ত্রনার।
জাগো নিউজ : আপনারা তো আগের বিশ্বকাপে পাকিস্তানের মত দলকে হারানো আর স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জেতা দল, সেই দল কি করে কানাডার মত প্রায় অনভিজ্ঞ ও আনকোরা দলের কাছে হারে? অধিনায়ক হিসেবে আপনার কাছে হারের মূল কারণ কি বলে মনে হয়?
পাইলট : অবশ্যই মূল কারন, মাঠে ভাল খেলতে না পারা। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না আমরা সেবার মোটেই ভাল খেলিনি। আমার মনে হয়, পুরো দলই বাজে খেলেছে। সামর্থ্যের সেরাটা বহুদুরে, ধারে-কাছেও যেতে পারিনি আমরা। সেটাই আসলে কানডাসহ সবার কাছে হারের প্রধান কারণ।
জাগো নিউজ : যে দেশে বছরের বড় সময় প্রচন্ড ঠান্ডা থাকে। বরফ পড়ে। সেভাবে খোলা আকাশের নিচে ন্যাচারাল টার্ফেও খেলা সম্ভব হয় না। সাকুল্যে বছরে মাস তিনেক ক্রিকেট হয়। তাও উইক-এন্ডে। সবাই কাজের অবসরে সাপ্তাহিক ছুটিতে খেলে। বলা যায় ‘অ্যামেচার’ এক দল ছিল কানাডা। মূলতঃ ভারত, পাকিস্তান ও অন্য দেশের অভিবাসীদের দিয়ে সাজানো এক দল। সেই দলের কাছে অত খারাপ পারফরমেন্স হওয়ার কারণ কি?
পাইলট : আমি এজন্য বিশেষ কাউকে দায়ী করতে রাজি নই। অধিনায়ক হিসেবে সে ব্যর্থতার একটা বড় দায় আমার। আর আগেই বললাম আমরা মাঠে ভাল খেলিনি। সামর্থ্য অনুযায়ী পারফর্ম করতে পারিনি। এর বাইরে আমার কাছে মনে হয়, আমাদের প্রস্তুতিটাও ভাল হয়নি।
অবশ্য এজন্য কাউকে দায়ী করার আগে ভাবতে হবে আমাদের ক্রিকেট অবকাঠামো তখন কেমন ছিল? এখন যেমন সম্ভাব্য সেরা ক্রিকেট অবকাঠামো বিদ্যমান। সবরকম সুযোগ সুবিধা আছে আমাদের। হেড কোচ, ব্যাটিং-বোলিং আর ফিল্ডিং কোচ, ট্রেনার, ফিজিও, কম্পিউটার আর ভিডিও অ্যানালিস্ট সার্বক্ষণিক সঙ্গী। এমনকি মাঝে-মধ্যে মনোবীদও কাজ করেন।
আমাদের সময় এত কিছু ছিল না। কানাডা কেমন দল? তাদের শক্তি ব্যাটিং না বোলিং? ব্যাটিংয়ে ক’জন ডানহাতি, ক’জন বাঁ-হাতি? তাদের ব্যাটিং শৈলি, টেকনিক আর অ্যাপ্রোচ কেমন? গাণিতিক না আক্রমণাত্মক? বোলারদের কে কেমন? পেস বোলারদের মান কি আর স্পিনাররাই বা কেমন?
এসব কিছুই জানা ছিল না। বিশ্বকাপের আগে কানাডার একটি ছোট্ট ভিডিও ক্লিপ্সও ছিল না আমাদের কাছে। কানাডা সম্পর্কে আমাদের কোনই ধারনা ছিল না তখন।
আজকাল সব দলের ভিডিও আর কম্পিউটার অ্যানালিস্ট প্রতিপক্ষ সম্পর্কে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ ধারনা দিয়ে দেন। যার সাথে খেলা, তাদের সবার ব্যাটিং, বোলিং আর ফিল্ডিং কেমন? তার ভিডিও দেখে ধারণা জন্মায়। আমাদের তখন কিছুই ছিল না।
আমরা কানাডা সম্পর্কে একদম অন্ধ ও অজ্ঞ ছিলাম। যে কারণে লাগসই ও কার্যকর গেম প্ল্যানও করা যায়নি। আমরা অনেকটা ‘অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার’ মত কৌশল ও পরিকল্পনায় খেলতে নেমেছিলাম। যা বুমেরাং হয়। আমরা মাঠে নেমে তাদের বোলিংয়ে বেকায়দায় পড়ে যাই।
জাগো নিউজ : কিন্তু কেনিয়ার সাথে তো আর সে সমস্যা ছিল না। কেনিয়ানদের সাথে তারও এক যুগের বেশি সময় ধরে খেলার অভিজ্ঞতা ছিল। স্টিভ টিকোলো, মরিস ওদুম্বে, কেনেডি ওটিয়েনো আর টমাস ওদোয়োদের আপনারা সবাই খুভ ভালভাবে চিনতেন। জানতেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছিল। তারা জাতীয় দলের হয়ে খেলার পাশাপাশি ঢাকা লিগও খেলেছেন। মোটকথা, কেনিয়ানদের সম্পর্কে আপনাদের ধারনা অনেক বেশি পরিষ্কার ছিল। সেই দলের সাথে অনেক বেশি ম্যাচও খেলার অভিজ্ঞতা ছিল। তাদের শক্তি, সামর্থ্য আর ঘাটতি-দূর্বলতাও খুব ভালই জানা ছিল। তাহলে কেনিয়ার সাথে পারলেন না কেন?
পাইলট : তা ঠিক। আমরা কেনিয়ার সাথে প্রচুর ম্যাচ খেলেছি। আইসিসি ট্রফি জেতার আগে থেকেই কেনিয়ানরা আমাদের প্রতিপক্ষ। তাদের শক্তি ও সামর্থ্য সম্পর্কে আমাদের ধারনা অবশ্যই ছিল। সে আলোকে বলা যায়, কেনিয়া আমাদের মতোই বা খুব কাছাকাছি এক দল। আমাদের চেয়ে বেটার দল, তা বলবো না।
কিন্তু আমার মনে হয়, বাংলাদেশের মাটিতে আমরা যে কেনিয়াকে পেয়েছি, মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের সিনথেটিক রাবারের উইকেটে যে কেনিয়ার দেখা মিলেছে- তার সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটির কেনিয়ার অনেক তফাত। ওই কন্ডিশনে কেনিয়া ছিল দারুণ সুগঠিত ও ব্যালান্সড একটি দল। পরিবেশ-পরিস্থিতির বিচার বিবেচনায় দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে কেনিয়া ছিল আমাদের চেয়ে ভালো দল।
দক্ষিণ আফ্রিকার ফাস্ট ও বাউন্সি পিচ কেনিয়ানদের জন্য ছিল ‘পয়োমন্ত।’ স্টিভ টিকোলো আর মরিস ওদুম্বেসহ কেনিয়ান ক্রিকেটারদের বেশ ক’জন দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রোটিয়া ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত অংশ নিতেন। যে কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেট, আবহাওয়া তথা কন্ডিশনের সাথে তাদের পরিচয় ছিল নিবিড়। তারা অভ্যস্ত ছিলেন সেখানকার কন্ডিশনে। আর সবচেয়ে বড় কথা স্টিভ টিকোলো-মরিস ওদুম্বেসহ কেনিয়ানদের ব্যাটিং স্টাইল, অ্যাপ্রোচ আর অ্যাপ্লিকেশনটা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেট উপযোগি। বল দ্রুত ও একটু হাই বাউন্সে ব্যাটে আসলে তারা যতটা স্বচ্ছন্দে ফ্রি স্ট্রোক খেলতে পারতেন, আমরা তা পারতাম না।
মোটকথা, কন্ডিশনটা বড় পার্থক্য গড়ে দিয়েছিল। যেখানে কেনিয়ানরা ছিল অনেক বেশি অভ্যস্ত ও সাবলীল। সেটাই আসলে দু’পক্ষের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। তাই বলছি, আমার মনে হয়, আইসিসি সহযোগি দেশ হলেও দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেট ও কন্ডিশনের সাথে ভাল পরিচয় থাকা এবং সে দেশে নিয়মিত খেলার কারণে কেনিয়ানরা ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে আমাদের চেয়ে ভালো দল ছিল। তার প্রমাণ, তারা অনেক টেস্ট খেলুড়ে দলকে পিছনে ফেলে সেবার সেমিফাইনালেও খেলেছে। কাজেই ২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে কেনিয়ার কাছে হারকে আমি খুব বড় ব্যর্থতা ভাবতে নারাজ।
জাগো নিউজ : কিন্তু সামগ্রিক পারফরমেন্সও তো ছিল যাচ্ছেতাই। অতি সাধারণ মানের। একটা টেস্ট খেলুড়ে দলের মত নয়। তা কেন হয়েছিল? সেটা কি কোচ মহসিন কামালের অযোগ্যতা-অদক্ষতা ও সামর্থ্যে ঘাটতির কারণে?
পাইলট : আমি সব সময় বলে আসছি, ২০০৩ সালের ব্যর্থতার জন্য আমি এককভাবে কাউকে দায়ী করতে চাই না। কারো একার ব্যর্থতা, অদক্ষতা, অযোগ্যতা আর অদুরদর্শিতা ও সীমিত সামর্থ্যের কারণে একটি দল ব্যর্থ হতে পারে না। আসলে ব্যর্থতা সবার।
কোচকে আমি সেভাবে দায়ী করতে চাই না। আমার মনে হয়, মানুষ হিসেবে তিনি ভালই ছিলেন। আর তিনি কতটা হাই প্রোফাইল, তার সামর্থ্য কেমন ছিল, তিনি কি পারতেন আর পারতেন না- তা নিয়ে আমি কোন সময়ই মন্তব্য করবো না। সেটা ঠিকও না। আমি আসলে ওভাবে চিন্তা করতে চাই না। কোচতো আর মাঠে খেলেননি। মাঠে খেলেছি আমরা ক্রিকেটাররা। আমরা পারিনি সেটাই সবচেয়ে বড় কথা।
কোচের হাতে তো আর জাদুর চেরাগ ছিল না, যে তার স্পর্শে সব উজ্জ্বল হয়ে যাবে। তার সামর্থ্য নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। আমার ঘুরেফিরে একটাই কথা, আমরাই পারিনি জায়গামত পারফরম করতে। কারণ কোচ ও ম্যানেজার মাঠে খেলেন না। মাঠে ক্রিকেটাররা খেলেন। কোচ ও ম্যানেজারের কাজ হলো দল চালানো। পুরো প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সুচাররূপে পরিচালনা এবং ক্রিকেটারদের উজ্জিীবিত ও উদ্দীপ্ত করা। আর ক্রিকেটারদের কাজ হলো মাঠে খেলা। জায়গামত পারফরম করা।
আর আমার মনে হয় দল খারাপ খেললে সব সময় অনেক বেশি কথা-বার্তা হয়। আমরা মাঠে ব্যর্থ হয়েছিলাম বলেই ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ নিয়ে কথা-বার্তা হয় বেশি। দল ভাল খেললে এত কথা বার্তা হতো না।
জাগো নিউজ : সেটা কেন? তবে কি দল নির্বচনে ত্রুটি ছিল?
পাইলট : আমার মনে হয় না। দেখেন দল নির্বাচন, ক্রিকেটার বাছাই নিয়ে সব সময়ই কথা হয়। হয়ত এক থেকে দুটি পজিশনে ক্রিকেটার বাছাই নিয়ে কথা উঠেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত আমরা ওই সময়ের সম্ভাব্য সেরা দল নিয়েই খেলতে গিয়েছিলাম। আমরা যে দলটি নিয়ে খেলতে গিয়েছিলাম, কেউ কি কখনো বলেছেন সেটা বাংলাদেশের তখনকার এক নম্বর না দুই নম্বর দল ছিল? তা শুনেছেন কখনো? আমার মনে হয় দল গঠন নিয়ে তেমন কোন প্রশ্ন ছিল না। টিম ঠিকই ছিল। তখন যারা ভাল পারফরমার তারাই ছিলেন টিমে।
জাগো নিউজ : তাহলে কি সমস্যা ছিল? কেন, কি কারনে ক্রিকেটাররা জায়গামত জ্বলে উঠতে পারেননি?
পাইলট : ওই দলের বহরের একটা বড় অংশ ছিল বয়সে নবীন। তাদের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ছিল কম। আর কয়েকজনের সেটাই ছিল প্রথম বিশ্বকাপ। এখন যেমন আমাদের দল বেশ পরিণত। পাঁচ থেকে ছয়জন ক্রিকেটার দেড়শোর ওপরে ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছে। তিন থেকে চারটি বিশ্বকাপ খেলছে। তখনতো আর তা ছিল না। দলের বেশ কিছু ক্রিকেটারের সেটাই ছিল প্রথম বিশ্বকাপ। আমার মনে হয় সেই সব তরুণরা বিশ্বকাপের উত্তাপ আর প্রতিদ্বন্দ্বীতার চাপটা নিতে পারেনি। একটু বেশি প্রেসার নিয়ে ফেলেছিল। তাই তাদের পারফরন্সে ভাল হয়নি। মোটকথা, আমরা দল হিসেবেও ভাল খেলিনি। ব্যক্তিগতভাবেও কারো পারফরমেন্স উজ্জ্বল ছিল না। কারো একক নৈপুণ্যে অনেক সময় দল উৎরে যায়, সেটাও হয়নি।
জাগো নিউজ : মাঠের শ্রী-হীন পারফরমেন্স আর মাঠের বাইরে দলে শৃঙ্খলায় ঘাটতির অভিযোগে দুষ্ট ছিল আপনার দল। অভিযোগ ছিল, দলের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা ছিল কম। ক্রিকেটারদের মাঠের বাইরের চলাফেরাও নাকি ছিল বলগাহীন। সে কারণে বিশ্বকাপের পর তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছিল। আপনি বিষয়টিকে কিভাবে দেখবেন?
পাইলট : আসলে আগেই বলেছি, দল খারাপ খেললে, ব্যর্থ হলে ও কাঙ্খিত সাফল্যের দেখা না পেলে অনেক কথা হয়। সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। আমারও মনে হয় ২০০৩ সালের বিশ্বকাপটাও ঠিক তেমনি। আসলে তেমন কিছুই ঘটেনি। মাঠের বাইরে অনেক কথাই আমার কানেও এসেছে। আমার মনে হয় তার প্রায় পুরোটা রটনা। বাস্তবে যা ঘটেছে, তারচেয়ে অনেক বেশি রটেছে।
জাগো নিউজ : কিন্তু মাঠেও কি দল সেভাবে উজ্জীবিত আর ভাল খেলতে দৃঢ় সংকল্পব্ধ ছিল?
পাইলট : আমার তো মনে হয় ছিল। শতভাগ ছিল। আমার মনে হয় মাঠের বাইরে একটু আধটু থাকলেও, মাঠে পুরো দল শতভাগ শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল। সবাই জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছে। আসলে কোন কোন আসর, টুর্নামেন্ট বা ম্যাচ যায়- যেখানে কেন যেন চাওয়া পূর্ণ হয় না। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে আমাদের হয়েছিল সেই দশা। আমরা কিন্তু চেষ্টা করেছি ভাল খেলতে। মাঠে ক্রিকেটারদের চেষ্টার কমতি ছিল না; কিন্তু হয়নি শেষ পর্যন্ত।
জাগো নিউজ : পুরো আসরে আপনার সবচেয়ে হতাশার দিন ছিল কোনটি?
পাইলট : অবশ্যই কানডার সাথে ম্যাচে হারের দিন। প্রথমতঃ দলটি ছিল কানডা, শক্তি ও সামর্থ্যে যারা ছিল আমাদের চেয়ে দূর্বল, কমজোরি ও অনভিজ্ঞ। সেই দলের কাছে হার এমনিতেই হতাশার। দুঃখের। গ্লানিরও। তারওপর খেলাটা হয়েছিল ঠিক ঈদের আগের দিন। আমাদের হারে গোটা দেশ ও জাতি হতাশায় মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল। ঈদের আনন্দ, উৎসবটাই মাটি হয়ে গিয়েছিল। এখনো মনে হলে খারাপ লাগে। কিছুটা অপরাধবোধেও ভুগি।
জাগো নিউজ : আর আপনাদের অবস্থা কেমন ছিল?
পাইলট : আমাদের মানসিক অবস্থা আর কি বলবো? কিছু হতাশা, ব্যর্থতা আর না পারার বেদনা ও কষ্ট বলে বোঝানো যায় না। কানাডার সাথে খেলার ঠিক পর দিন ছিল কোরবানীর ঈদ। তার ঠিক আগের রাতে একটা পুরো দস্তুর টেস্ট খেলুড়ে দল বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমে আমরা কানডার মত আনকোরা ও অনভিজ্ঞ দলের কাছে হেরে যই। পুরো দেশ জুড়ে ছিল ঈদের আমেজ। তা অনেকটাই মাটি হয়ে গিয়েছিল। ফোনে যার সাথেই কথা বলছিলাম, চারদিক থেকে শুধু লজ্জা আর অপমানসূচক কথাবার্তাই আসছিল। আর আমরা যেন সব হারানোর বেদনায় চুপসে গিয়েছিলাম। আমাদের আনন্দই শুধু হারিয়ে যায়নি, নিজেদের স্বাভাবিক জীবন-যাত্রাও যেন থমকে গিয়েছিল।
এখনো মনে আছে, খেলা হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম বড় শহর ডারবানে। যেখানে উপমহাদেশের প্রচুর মুসলিমের বসবাস। মসজিদ আছে। আমাদের টিম হোটেলের খুব কাছেই ছিল বড় মসজিদ; কিন্তু মনের দুঃখে কষ্টে আমাদের বেশিরভাগ ক্রিকেটার নামাজও পড়তে যায়নি। অনেক প্রবাসী বাঙ্গালি ভাই ও বোন আমাদের জন্য ঈদের সেমাই ও অন্যান্য খাবার সামগ্রী নিয়ে এসেছিলেন টিম হোটেলে; কিন্তু আমরা না খেয়ে সকাল-সকাল টিম বাসে চেপে ডারবান ছেড়ে গিয়েছিলাম। সেই দিনের যন্ত্রনার কথা ভুলিনি কখনো। ভুলবো না।
জাগো নিউজ : মাঠ ও মাঠের বাইরে আপনার দল পরিচালনা কেমন ছিল? সেখানে কোন ঘাটতি বা দূর্বলতা- সীমাবদ্ধতা ছিল কি? যার প্রভাবে দলের পারফরমেন্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল?
পাইলট : দেখুন! আমি সব সময়ই একটু দুষ্টু প্রকৃতির (হাসি দিয়ে)। আমি কেমন টাইপের সেটা সবাই জানেন। আমি একটু হাস্য কৌতুক বা মজা করতে পছন্দ করি। একটু খুনসুটি তাকে কেউ কেউ দুষ্টুমি বলেন, তাও করি; কিন্তু এটাও সবার জানা, আমি খেলার মাঠে শতভাগ সিরিয়াস এবং পেশাদার। মাঠের পাইলট দুষ্টু নয়, খুনসুঁটিও করে না। সেখানে আমি সিরিয়াস। ডেডিকেটেড অ্যান্ড মোটিভেটেড।
কাজেই আমার মনে হয় না, মাঠে দল পরিচালনায় কোন গাফিলতি ছিল। আমি শতভাগ সিরিয়াস ছিলাম। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমারওতো অধিনায়ক হিসেবে একটা লক্ষ্য ছিল। সেটা অধিনায়ক হিসেবে আমারও প্রথম বিশ্বকাপ, আর সবার মত আমিও সামর্থ্যের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে সাধ্যমত চেষ্টা করেছি, দলকে চাঙ্গা রাখতে। ভাল খেলায় উদ্বুদ্ধ করতে।
মাঠেও চেষ্টা করেছি অধিনায়ক হিসেবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে। ওই যে বললাম আগে, কখনো কখনো কোন কিছু মন থেকে চাইলে বা চেষ্টা করলেও হয় না। ২০০৩ বিশ্বকাপে আমাদেরও কোন চাওয়া পূর্ণ হয়নি। চেষ্টাই সফল হয়নি। তবে চেষ্টায় ঘাটতি ছিল, দল পরিচালনায় গাফিলতি ছিল- এমন কথা বলার সুযোগ নেই।
আর একটা কথা, কেন যেন মনে হয় আমি বিশ্বকাপের আগে বলে গিয়েছিলাম এটাই হবে আমার অধিনায়ক হিসেবে শেষ ট্যুর। সেটাও মনে হয় একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। কেউ কেউ বিষয়টাকে অন্যভাবে দেখেছেন। অন্যভাবে ‘রঙ’ লাগিয়েছেন।
জাগো নিউজ : দল যখন একের পর এক ম্যাচ হারছিল, আপনাদের নিচের র্যাংকিংয়ের দলও আপনাদের হারিয়ে দিচ্ছিল, তখন কোন একটা সময় কি আপনার নিজেকে একটু একা বা অসহায় মনে হয়েছে? আপনি কি কাউকে অনুভব করেছেন?
পাইলট : ঠিক একা বা অসহায় মনে হয়নি। তবে আমার মনে হয়েছে আমরা সেবার একটু আনলাকি ছিলাম। এখন বিশ্বকাপ দলে একঝাঁক হাই প্রোফাইল কোচের সাথে জাতীয় দলের কোন একজন সাবেক অধিনায়ক ম্যানেজার হিসেবে থাকছেন। সে সাথে বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদের বেশ কয়েকজন সাবেক জাতীয় ও সিনিয়র ক্রিকেটারও পরোক্ষভাবে দলের সাথে থাকেন। বোর্ড সভাপতি নিজে তদারক করেন সব কিছু।
আমি অনুভব করি ২০০৩ সালে আমরা তার কিছুই পাইনি। সত্যি বলতে কি আমরা একজন সত্যিকার ‘গাইড’ বা পরামর্শদাতা কিংবা বড় ভাই স্থানীয় কারো অভাব অনুভব করেছি খুব বেশি। বেশ ক’বার মনে হয়েছে, ইস কেউ যদি এসে একটু পিঠ চাপড়ে কিংবা ঘাড়ে হাত দিয়ে বলতেন, ‘আরে খেলায় তো জয়-পরাজয় আছেই। থাকবেই। একটি দুটি ম্যাচে হেরেছো তো কি হয়েছে? আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করো। মাঠে যতটা অনুজ্জ্বল মনে হচ্ছে, তোমরা তো আসলে তত খারাপ দল নও। তোমাদেরও সামর্থ্য আছে এর চেয়ে ঢের ভাল খেলার। একটু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করো। জান-প্রাণ দিয়ে লড়াই করো। দেখবে আবার জয়ের পথ খুঁজে পাবে।’ বিশ্বাস করুন এমন কেউ ছিল না সেবার।
জাগো নিউজ : কেন ম্যানেজার তো ছিলেন। তিনিওতো সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার।
পাইলট : হ্যাঁ, ছিলেন। তিনিও আমার বয়সে অনেক বড়। অনেক শ্রদ্ধেয়; কিন্তু আমি বলেছি সমসাময়িক বা অল্প বড় যারা আমাদেরকে মাঠে দেখেছেন, আমাদের সাথে খেলেছেন, আমাদের সম্পর্কে সু-স্পষ্ট ধারণা রাখেন- এমন কেউ থাকলে ভাল হতো। তিনি অনেক বেশি উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করতে পারতেন। বলতে পারেন, ‘ফাইন টিউন’ করতে পারতেন। সেটা ছিল মিসিং।
এআরবি/আইএইচএস/এমএস