খেলাধুলা

নান্নুর মুখে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম জয়ের গল্প

তার বাদ পড়া আর দলভুক্তি- দুটিই আলোচিত। আলোড়িত। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে মিনহাজুল আবেদিন নান্নু ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ দলে জায়গা না পাওয়ায়। ক্রিকেট অঙ্গনে তো বটেই, গোটা দেশেই রীতিমত তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। মিডিয়ার রাজ্যের লেখা-লেখি আর চারিদিকে হই চই পড়ে গিয়েছিল। বিসিবি ছাপিয়ে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, এমনকি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়েও বিষয়টি নিয়ে সাড়া পড়েছিল।

Advertisement

সবার মুখে ঘুরে-ফিরে একটি প্রশ্নই উচ্চরিত হয়েছে, ‘দেশের অন্যতম সেরা, মেধাবি ব্যাটসম্যান এবং মিডল অর্ডারের নির্ভরতার প্রতীক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু কেন নেই দলে?’

দুটি সম্পূরক প্রশ্নও শোনা গেছে-১. মিডল অর্ডারে তার চেয়ে ভালো অপশন নেই। তাই তাকে বাদ দিয়ে দল সাজানো কেন?২. অত উঁচু মানের পারফরমার কি করে বিশ্বকাপ স্কোয়াডের বাইরে থাকে? তবে কি নান্নু কোন ষড়যন্ত্রের শিকার?

বলার অপেক্ষা রাখে না, সেই আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ৯০ দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর ব্যাট আলো ছড়িয়েছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি সন্দেহাতীতভাবেই ছিলেন সফলতম ব্যাটসম্যান। ক্লাব ক্রিকেটে রেকর্ড সংখ্যক ম্যাচ জেতানো ইনিংসের রচয়িতা নান্নু জাতীয় লিগ ও চ্যাম্পিয়নশিপেও অন্যতম সেরা ও সফল পারফরমার।

Advertisement

আর সবচেয়ে বড় কথা, যে ক’জন হাতে গোনা মেধাবী ও প্রতিভাবান ক্রিকেটারের উজ্জ্বল ও কার্যকর পারফরমেন্সে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জিতে বিশ্বকাপের টিকেট নিশ্চিত করেছিল, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু ছিলেন সেই তালিকার একদম ওপরের দিকের একজন।

ক্রিকেট বিশ্লেষক, বোদ্ধা, বিশেষজ্ঞ- সবাই তাকে অনেক উঁচুতে স্থান দিয়ে থাকেন। নান্নু দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সব সময়ের অন্যতম প্রতিভাবান ও মেধাবি ব্যাটসম্যান হিসেবে সমাদৃত।

আর তার চেয়ে বড় কথা, বয়স ৩৩ হলেও তখনো তার ম্যাচ ফিটনেস আর ফর্ম ঠিক ছিল। ৯৯’র বিশ্বকাপের সময়ও নান্নুই ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা উইলোবাজ। তাই তার বাদ পড়া স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি কেউ।

তাকে দলে নিতে তাই রীতিমত একটা সামাজিক আন্দোলনের মত তৈরি হয়। আর বিশ্বকাপের আগে ঘরের মাঠে নান্নুকে ছাড়া তিন জাতি মেরিল কাপের ব্যর্থতাও নান্নুর অভাববোধ আরও বেশি করে ফুটে ওঠে।

Advertisement

বলার অপেক্ষা রাখে না, জিম্বাবুয়ে আর কেনিয়ার বিপক্ষে দেশের মাটিতে বিশ্বকাপের ঠিক দুই মাস আগে ত্রিদেশীয় সিরিজেও চরম ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। ফাইনাল খেলা বহুদুরে কোন ম্যাচও জেতেনি। আর পাঁচ ও ছয় নম্বরে নান্নুর অভাববোধটা খুব বেশি করে অনুভূত হয়। তখন থেকেই আসলে তাকে দলে ফেরানোর দাবি সরব হয়। মিডিয়াসহ সবাই নান্নুকে দলে নিতে সোচ্চার হন।

এক সময় নান্নুকে বিশ্বকাপ দলে ফেরানোর দাবি ক্রিকেট অনুরাগিদের গণ দাবিতে রূপান্তরিত হয়। তখনকার ক্রিকেট বোর্ডের দুই ডাকসাইটে যুগ্ম সম্পাদক দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল, মাহমুদুল হক মানুর (প্রয়াত) নেতৃত্বে নান্নুকে দলে ফেরাতে ক্রিকেট বোর্ডের অভ্যন্তরে রীতিমত অভ্যুথ্যান ঘটে।

শুধু তাদের কথা বলা কেন, খোদ তখনকার বিসিবি প্রধান সাবের হোসেন চৌধুরীও পরে নান্নুকে দলে নেয়ার দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেন। তার অনুমতি নিয়েই বোর্ডের নির্বাহী পরিষদের বিশেষ সভা ডেকে নান্নুকে দলে নেয়া হয়। বাংলাদেশতো নয়ই, ক্রিকেট ইতিহাসের এক নজিরবিহীন ঘটনার মধ্য দিয়ে দলভুক্ত হন নান্নু।

নির্বাচকদের দলে তিনি ছিলেন না। নির্বাচকরা তাকে বিবেচনায় আনেননি। তাকে বাইরে রেখেই চূড়ান্ত করেছিলেন বিশ্বকাপ স্কোয়াড। কি আশ্চর্য্য! বাংলাদেশ প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে, অথচ ১৫ জনের দলে নেই দেশ সেরা উইলোবাজ!

চারিদিকের ক্ষোভ ও সমালোচনা আর নান্নুকে দলের ফেরানোর দাবির উত্তাল ঢেউ এসে লাগে বোর্ডেও। সে সময়ের বোর্ডের একটা বড় অংশ নির্বাচকদের বাদ দিয়ে তাদের পাশ কাটিয়ে বোর্ডের বিশেষ সভা ডেকে নান্নুকে দলে ফেরান। ক্রিকেট বোর্ড তথা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের দোতলার অফিস কক্ষ বাদ দিয়ে নান্নুকে দলে ফেরানোর সে ঐতিহাসিক বোর্ড সভা হয় বিকেএসপিতে। বোর্ডের সেই বিশেষ সভাতেই নান্নুকে দলে নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এই তো সেদিন জাগো নিউজের সাথে আলাপে নান্নুর দলে আসার গল্প শোনালেন তখনকার অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল। তিনি জানান, যেদিন নান্নু ভাইকে দলে ফেরানো হয়, ঠিক তার ২৪ ঘন্টা আগে বিসিবির সে সময়ের সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী তাকে ফোনে জিজ্ঞেস করেন, ‘বুলবুল আমরাতো নির্বাচকদের সিদ্ধান্ত পাল্টে নান্নুকে দলে নেয়ার চিন্তা-ভাবনা করছি, তুমি কি বলো?’

বুলবুল জবাব দেন, ‘কোন অসুবিধা নেই। নান্নু ভাইয়ের মেধা-যোগ্যতা ও সামর্থ্য নিয়ে তো কোনোই প্রশ্ন নেই। তিনি অবশ্যই দলে থাকার যোগ্যতা রাখেন।’

এভাবে দলে ফেরানো হয় নান্নুকে। তবে শুধু প্রক্রিয়ার কারণেই নয়, নান্নুর দলভুক্তি আরও এক বিশেষ কারণে স্মরণীয় হয়ে আছে। এখন যেমন ২৩ মে পর্যন্ত দলে পরিবর্তন আনার অবারিত সুযোগ দেয়া হয়েছিল; কিন্তু ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে তেমন কোনো সুযোগ ছিল না।

তাই নান্নুকে দলে নিতে ভাগ্য পোড়ে জাহাঙ্গীর আলমের। তবে সেই টপ অর্ডার কাম উইকেটকিপারকে একদম বাদ দেয়া হয়নি। অফিসিয়াল প্লেয়ার্স লিস্ট থেকে নাম বাদ গেলেও জাহাঙ্গীর ১৬ নম্বর সদস্য হিসেবে দলের সাথে ইংল্যান্ডে যান এবং বিশ্বকাপের পুরো সময় দলের সাথেই ছিলেন।

এমন নজিরবিহীন ও ঘটনাবহুল দলভুক্তিই শেষ কথা নয়। যাকে নিয়ে এত ঘটনা, রটনা আর হইচই- সেই অনেক ঘটনার জন্ম দিয়ে দলে জায়গা পাওয়া মিনহাজুল আবেদিন নান্নু ঠিক জায়গামত নিজের মেধা ও প্রজ্ঞার সাক্ষর রেখেছেন। তার দলে ফেরাকে চীর স্মরণীয় করে রেখেছেন চট্টগ্রামের এ অসাধারণ মেধাবী ব্যাটসম্যান।

শুধু দলেই ফেরেননি, সেই নান্নুই পরবর্তীতে বিশ্বকাপে টিম বাংলাদেশের ‘ত্রাণকর্তা’ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। যে একটিমাত্র ম্যাচ জয়ের স্বপ্ন বুকে নিয়ে ইংল্যান্ড গিয়েছিল টিম বাংলাদেশ, সেই স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে এডিনবরার গ্র্যাঞ্জ ক্রিকেট ক্লাব মাঠে জিততে নেমে ধুঁকছিল বাংলাদেশ। শুধু ধুঁকছিল বললে অনেক কম বলা হবে। বলা যায়, হারের রাস্তায় চলে গিয়েছিল। মাত্র ২৬ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে খাদের কিনারায় পড়ে গিয়েছিল টাইগাররা। সেখান থেকে দলকে টেনে তুলে শেষ অবধি ১৮৫ রানের লড়াকু পুঁজি গড়ে দেন নান্নু।

তার ব্যাট থেকে আসে ৬৮ রানের অপরাজিত ইনিংস। শেষ পর্যন্ত ওই ইনিংসটিই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ জেতানো ইনিংস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আজ অবধি সোনার হরফে লেখা হয়ে আছে। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম জয়ের রূপকার, স্থপতি আর নায়কের আসনটি সেই নান্নুর। প্রথম ম্যাচ সেরাও নান্নু।

বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে যাবার আগে বাংলাদেশ দলের প্রতিটি সদস্যের মুখে ছিল একটিই কথা, আমাদের একমাত্র টার্গেট স্কটিশদের হারানো। আর বড় দলগুলোর সাথে যতটা ভাল খেলা সম্ভব, তাই খেলা; কিন্তু সেই স্কটিশদের হারাতে মাঠে নেমে কি করুন দশাই না হয়েছিল! জেতা তো বহূদুরে, পরাজয়ের পথেই অনেকদুর চলে গিয়েছিল দল। সেখান থেকে নান্নু কি মন্ত্রে দলকে আবার টেনে তুলেছিলেন?

কেমন ছিল সেই মাঝ নদীতে হাবুডুবু খাওয়া নৌকাকে তীরে ভেড়ানোর কাহিনী? জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য সেই শক্ত হাতে হাল ধরার গল্পই শুনিয়েছেন নান্নু...

তিনি যে একজন জাত ব্যাটসম্যান, দলের বিপদে অকুতোভয় সৈনিক, যিনি শক্ত হাতে হাল ধরতে জানেন- তার প্রমাণ দিয়েছেন প্রথমেই। প্রশ্ন ছিল, মাত্র ২৬ রানে ইনিংসের অর্ধেকটা শেষ। খালেদ মাসুদ পাইলট (৩), মেহরাব হোসন অপি (৩), ফারুক আহমেদ (৭), আমিনুল ইসলাম বুলবুল (০) আর আকরামের (০) মত সব নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যানরা সাজ ঘরে।

প্রশ্ন ছিল, উইকেটে ম্যুভমেন্ট ছিল প্রচুর। বল বাতাসে ও পিচে পড়ে সুইং করছিল বেশ। যা খেলতে সবাই হিমসিম খাচ্ছিলেন। সেখানে আপনি কিভাবে অমন বীরোচি ইনিংস খেলেছিলেন? কোন মন্ত্র বলে এমন প্রতিকুলতাকে জয় করেছিলেন?

নান্নুর সাহসী ও সোজাসাপ্টা উচ্চারণ, আসলে আমার সেই ইনিংসটি আলাদীনের জাদুর চেরাগের স্পর্শ মেশানো ইনিংস ছিল না। আমি আমার দীর্ঘ খেলোয়াড়ী জীবনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছি। আমার লম্বা খেলোয়াড়ী জীবনে আমি বিভিন্ন সময় অনেক প্রতিকুলতাকে অতিক্রম করেছি। অনেক চাপ সামলে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছি।

কঠিন ও ঘোর বিপদে হাল ধরতে জানতাম আমি। হয়ত বিশ্বকাপের মাঠে ছিল না; কিন্তু আমার ক্যারিয়ারে অগনিত ইনিংস ছিল চরম সংকটে, বিপদে ঘুরে দাড়ানোর ইনিংস। বলতে পারেন, চরম বিপদে ও ব্যাটিং বিপর্যয়ে হাল ধরাটা আমার একটা অন্যরকম চ্যালেঞ্জ মনে হতো। আমি বারবার সেই চ্যালেঞ্জ সাফল্যর সঙ্গে মোকাবিলা করেছি।

সত্যি বলতে কি, ওই সব ক্ষেত্রে আমি একটু অন্যরকম চিন্তা করতাম। সাধারণতঃ ব্যাটিং বিপর্যয় এড়াতে সবাই ভাবে একটা লম্বা ও বড় জুটি। একটা দীর্ঘ পার্টনারশিপ হলেই হয়ত সংকট কেটে অবস্থার উন্নতি ঘটবে। আমিও যে তেমন ভাবতাম না, তা নয়। ভাবতাম। তবে আমার ভাবনা ছিল ভিন্ন। আমি মনে করতাম, সে আমার সাথে আছে বা থাকবে- তা বড় কথা নয়।

দল বিপদে, আমি মাঝি। যা করার আমাকেই করতে হবে। দলকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে হলে আমাকেই শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে হবে। ক্রিজে পড়ে থাকতে হবে শেষ বল পর্যন্ত। সাথে সাথে লড় পুঁজিও গড়ে দিতে হবে। স্কটল্যান্ডের সাথে বিশ্বকাপের সে ম্যাচটিও ছিল তেমনি।

সেখানেও দল চাপে ছিল। আমরা শুরুতেই ব্যাকফুটে চলে যাই। স্বাগতিক স্কটিশরা ছিল সুবিধাজনক অবস্থায়। সে রকম অবস্থায় আমার যা করণীয় আমি তা করার প্রাণপন চেষ্টা করেছি। শেষ অবধি তা সফল হয়েছিল। খুব ভাল লেগেছিল। নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। বেশি ভাল লাগছিল এই ভেবে যে, আমাকে যা ভেবে নেয়া, আমি জায়গামত তার প্রমাণ দিতে পেরেছি।’

প্রশ্ন হলো, বাদ পড়ার পর আপনাকে নিয়ে যখন অনেক হইচই, চারিদিক আপনাকে ফেরানোর দাবিতে সোচ্চার- তখন কেমন হয়েছিল? নান্নুর আত্মবিশ্বাসী জবাব, ‘বিশ্বাস করুন , আমার বার বার মনে হয়েছে , আমি ফিরবো। ঠিক বিশ্বকাপ দলে অন্তর্ভুক্ত হবো। আমাকে নিবে। নিতেই হবে। এতটা বিশ্বাসী ছিলেন? হ্যাঁ, একটা বিশ্বাস আর আস্থা ছিল।’

স্কটল্যান্ডের সাথে ম্যাচটির স্মৃতিচারণ করবেন একটু? আসলে স্কটল্যান্ডের ম্যাচে আমরা অনেক চাপে পড়ে গিয়ে তারপর লড়াই সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত জিতেছি বলেই মনে হয় অনেক বেশি কথা হচ্ছে; কিন্তু যদি একটু পেছন ফিরে তাকানো যায় এবং যে পিচে খেলা হয়েছে, তার ট্র্যাক রেকর্ড, পরিসংখ্যান ঘাঁটাঘাঁটি করা হয়- তাহলে দেখবেন ওই পিচে ছিল ঘন সবুজ ঘাস। যেখানে বিশ্বকাপের বছর খানেক আগে প্রস্তুতি সফরে গিয়েও আমরা ভাল করতে পারিনি।

কারণ আমরা তো আসলে সবুজ কচি ঘাসের উইকেটে খেলতে অভ্যস্ত ছিলাম না। মরা, নিষ্প্রাণ পিচ তাও নীচু বাউন্সের, যেখানে বাতাসে সুইং আর সিম ম্যুভমেট হতো কালে ভদ্রে। এমন প্রাণহীন পিচে খেলে খেলে বাড়তি গতি আর বিষাক্ত সুইংয়ে বিপাকে পড়া আসলে অস্বাভাবিকও নয়।

আমরা বিশ্বকাপের এক বছর আগে স্কটল্যান্ডে প্রস্তুতি সফরে গিয়ে দুই ম্যাচ হেরেছিলাম। এমন পিচে রান করতে পারিনি আমরা। এক ম্যাচে সম্ভবত ৮৮’তে অলআউট হয়েছিলাম। আরেক ম্যাচেও স্কোর ছিল একশো’র আশপাশে।

এবং আগের দিন প্র্যাকটিসে গিয়ে উইকেট দেখেও আমাদের তাই মনে হয়েছে। আমি একা নই, দলের সিনিয়র খেলোয়াড়দের সবাই উইকেট সম্পর্কে পূর্ব ধারণা নিয়ে রেখেছিলাম। সবাই বুঝে গিয়েছিলাম। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলাম, এ সবুজ ঘাসের পিচে কিন্তু বল প্রচুর সুইং করবে। সাপের মত এঁকে-বেঁকে আসবে। মুখ, কান, বুক আর মাথার আশপাশ দিয়েও যাবে। এখানে ফ্রি স্ট্রোক খেলা, চটকদার মারের ফুলঝুড়ি ছোটানো খুব কঠিন।

হাই স্কোরিং গেম তো বহদুরে। এই উইকেটে ২০০ রান করাও কঠিন হবে। আমরা নিশ্চিত ছিলাম, স্কটিশরা টস জিততে পারলেই আমাদের আগে ব্যাটিংয়ে পাঠাবে। জানে আমরা এমন পিচে খেলে অভ্যস্ত নই। তবে আমরা চিন্তা করে রেখেছিলাম আমরা যদি ১৮০’র আশপাশে থাকতে পারি, তাহলে ভাল লড়াই করা যাবে। কারণ আমাদের বোলিংটাও মন্দ ছিল না। পেস বোলারদের সুইং ছিল। স্পিনারদেরও বল ঘোরানো আর সমীহ জাগানো বোলিং করার সামর্থ্য ছিল।

বলতে পারেন, টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামার পরও আমাদের গেম প্ল্যান ছিল ১৮০ প্লাস রান করা। কাজেই যখন আমরা ২৬ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ঘোর বিপাকে, তখন আমার মাথায় একটাই চিন্তা ছিল, যে করেই হোক স্কোরটাকে ১৭০ পার করে ১৮০’তে নিয়ে দাঁড় করাতে হবে। তাহলেই চান্স থাকবে। হয়ত আমরা জিতেও যেতে পারি।

আমি ঠিক সেই চিন্তার বাস্তবায়ন ঘটাতে প্রাণপন চেষ্টা করেছি। আমাকে দুর্জয় ষষ্ঠ উইকেটে যথেষ্ঠ সহায়তা করেছে। আমি আর দুর্জয় মিলে একটি প্রতিরোধ গড়ে (৬৯ রানের) একটি জুটিও গড়েছিলাম। তাতে বিপদ কেটে সামনে আগানো সম্ভব হয়েছিল। তবে আমার ভাবনা ছিল একটাই, কে কি করবে জানি না, আমাকে কিছু একটা করতেই হবে। কিছুতেই আউট হওয়া চলবে না।

লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে শেষ বল অবধি। বিশ্বাস ছিল আমি দায়িত্ব নিয়ে শেষ পর্যন্ত উইকেটে টিকতে পারলে নিশ্চয়ই আমাদের লক্ষ্য পূরণ, মানে ওই ১৮০’র কাছাকাছি যাওয়া যাবে। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছিল। আমি ৬৮ রানে (১১৬ বলে) নট আউট থাকলাম।

আমরা গিয়ে থামলাম ১৮৫’তে। এটা ৫০ ওভারের ম্যাচে হয়ত আজকাল কোন রানই না; কিন্তু ১৯৯৯ সালের ওই ম্যাচে স্কটিশদের সাথে সেটাই ছিল বেশ লড়াকু পুঁজি। আমরা সে পুঁজি নিয়ে শেষ হাসিও হেসেছিলাম। আমাদের বোলাররা সেই রানটাকে জয়ের জন্য যথেষ্ঠ বলে প্রমাণ করতে পেরেছিল।

আমাদের তিন পেসার হাসিবুল হোসেন শান্ত (২/২৬), মঞ্জুরুল ইসলাম (২/৩৩) আর খালেদ মাহমুদ সুজন (২/২৭) দারুণ বল করেছিল। দুই স্পিনার বাঁ-হাতি এনামুল হক মনি (১/২৩), অফ স্পিনার নাঈমুর রহমান দুর্জয় (১০ ওভারে ০/৪১) আর আমিও সাধ্যমত ব্যাকআপ (১/১২) করেছিলাম। সব মিলে বোলিং আর ফিল্ডিংটাও ছিল অসাধারণ। আমাদের সাঁড়াসি আক্রমণে স্বাগতিক স্কটিশরা আর কুলিয়ে উঠতে পারেনি। আমরা জিতে যাই ২২ রানে।

আমার প্রাণপন চেষ্টায় সেই কাংখিত লড়াকু পুঁজি গড়ে ওঠে, আমরা পাই বিশ্বকাপে প্রথম জয়ের মধুর স্বাদ। আমি হই ম্যাচ সেরা- এ যে কেমন সৃষ্টি সুখের আনন্দ- বলে বোঝানো যাবে না। এখনো মনে হলে শরীরের একটা অন্যরকম শিহরণ জাগে।’

অনেক ঘটনা, রটনায় বিশ্বকাপ দলে শেষ মুহূর্তে জায়গা পেয়ে দেশের প্রথম জয়ের রূপকার হওয়া ম্যাচ সেরার পুরষ্কার হাতে শেষ হাসি হাসার নজির বিশ্বকাপে আর একটিও নেই। সে বিরল কৃতিত্বের অধিকারি নান্নু। সেটাই কিন্তু শেষ নয়। সেবার দলে ফিরেও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে একাদশে জায়গা পাননি।

আর সবচেয়ে উল্লেখ করার মত তথ্য হলো, যে ম্যাচে তিনি হয়েছিলেন ম্যাচ সেরা, সে ম্যাচ শেষের আনুষ্ঠানিক মিডিয়া সেশনেও নিজের কথা শেষ করে রীতিমত রাগে-ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে কনফারেন্স হল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন নান্নু।

কারণ, ম্যাচ শেষের আনুষ্ঠানিক মিডিয়া সেশনে তখনকার কোচ গর্ডন গ্রিনিজ এক পর্যায়ে বলে বসেন, আমি আসলে দলে এই মধ্য তিরিশের ক্রিকেটারদের উপস্থিতির বিপক্ষে ছিলাম।

নান্নুর তা ভাল লাগবে কেন? তিনি তাই কথা শেষ করে কোচ ও অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে প্রেস কনফারেন্স হলে রেখেই সোজা চলে যান ড্রেসিং রুমে।

অথচ সেই মধ্য তিরিশের নান্নুই কিন্তু পরে অস্ট্রেলিয়ার সাথেও অসাধারণ ব্যাটিং করে গ্লেন ম্যাকগ্রা, ডেমিয়েন ফ্লেমিং আর শেন ওয়ার্নদের বিপক্ষে হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে আবার পাদ প্রদীপের আলোয় উঠে আসেন।

আজকের প্রেক্ষাপটে বোঝা একটু কঠিন; কিন্তু চরম সত্য হলো, ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে খানিক দৃষ্টিকটুভাবে দলভুক্ত হলেও মাঠে নান্নু প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, ‘আমি দলে থাকার যোগ্য দাবিদার ছিলাম এবং ওই বিশ্বকাপ দলে মিডল অর্ডারে আমিই ছিলাম সেরা বিকল্প।

এআরবি/আইএইচএস/এমএস