খেলাধুলা

আকর্ষণের বিজ্ঞাপন উপমহাদেশ

এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের আসর বসেছে এগারবার। এর মধ্যে উপমহাদেশে ট্রফি এসেছে চার বার। শুধু এটুকু বললে পরিসংখ্যানের ব্যত্যয় না ঘটলেও, আড়ালে পড়ে যায় ক্রিকেটের বাঁক বদলের রুদ্ধশ্বাস সব ঘটনাপঞ্জি।

Advertisement

একটা সময় ক্রিকেট ছিল অনেকটা খাঁচাবদ্ধ পাখির মত। উপমহাদেশ ক্রিকেটের ছোঁয়ায় সেই খাঁচাবদ্ধ ক্রিকেট নামের পাখিটি বিচরণ করছে মুক্ত আকাশে। যে ক্রিকেট ছিল সাধারণের নাগালের বাইরে, উপমহাদেশ তার মোহিনি আকর্ষণী বলে, সেই ক্রিকেটকে পরিণত করেছে সার্বজনীন উৎসবে। আর এই জন উৎসবের সবচেয়ে বড় মঞ্চ বিশ্বকাপে, নতুনত্বের যোগান দিয়ে ক্রিকেটকে সাধারনের অতি আপন, অতি আদরের করে তুলেছে উপমহাদেশ।

বিশ্বকাপের দ্ব্যর্থবোধক বাঁক বদলের সঙ্গে মিশে আছে দুটি ঘটনা। ১৯৮৩ সালে ভারতের বিশ্বকাপ জয়, আর প্রথমবারের মত যৌথ আয়োজনে ১৯৮৭ এর বিশ্বকাপ। ১৯৮৩ সালে তৃতীয় বিশ্বকাপের আগে বিশ্ব ক্রিকেটের পটভুমি একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক।

ওই সময় ক্রিকেট মানেই ওয়েস্টইন্ডিজ। বিশ্বকাপ ফাইনাল তো অনেক দুরের ব্যাপার, ক্যারিবীয়দের হারানো যায়, এমন ভাবনাটাও ছিল দুঃসাহসের নামান্তর। ১৯৭৫ এর পর ১৯৭৯ এর বিশ্বকাপেও অপরাজিত চ্যম্পিয়ন হয়েছিল ক্যারিবিয়রা। একাদশের প্রায় প্রতিটি জায়গায় বিশ্বসেরাদের নিয়ে গড়া ছিল ক্লাইভ লয়েডের দল।

Advertisement

সব কথার এক কথা ক্রিকেটে ক্যারিবীয়দের শ্রেষ্ঠত্বকে ভবিতব্য বলেই মেনে নিয়েছিল ক্রিকেট বিশ্ব। আর যেটা কেউ ভাবতেই পারত না সেটাই করে দেখিয়েছিল কপিল দেবের ভারত।

১৯৮৩ এর বিশ্বকাপ ফাইনাল। লর্ডস প্রস্তুত। হ্যাটট্রিক শিরোপার সামনে ক্লাইভ লয়েড। এক অসম ফাইনালের আবহ! সব ঠিক ছিল কিন্তু গোলটা বাঁধিয়ে দিল কপিল দেব টনিকে উদ্দীপ্ত ভারত। ক্যারিবীয় বোলারদের দাপটে মাত্র ১৮৩ রানেই গুটিয়ে গেল ভারতীয়রা।

ক্যারিবীয়রা ব্যাটিংয়ে নামার আগে আরেকটা নিয়মরক্ষার ফাইনাল, এর বাইরে আর কিছুই ভাবেনি ক্রিকটেপ্রেমীরা; কিন্তু অন্য ধাতুতে গড়া কপিল দেব। হারার আগে হার স্বীকার করার বান্দা নন এই ২৪ বছরের যুবক। দলীয় ৫০ রানের মধ্যেই বিদায় নিলেন দুই ওপেনার গর্ডন গ্রিনিজ ও ডেসমন্ড হেইন্স। ভিভ রিচার্ডস উইকেটে থাকলে, এই ১৮৩ রান বাঘের মুখে ছাগ শিশু ছাড়া আর কিছু নয়।

কিং রিচার্ডস শুরুও করলেন রাজার মতই। ২৭ বলে সাত চারে ৩৩। ক্যারিবীয় স্কোরবোর্ডে ৫৭/২। মদনলালের করা নিজের ইনিংসের ২৮তম বলটির মুখোমুখি হলেন ভিভ। ব্যাটও চালালেন। যুতসই হলো না। বাতাসে বল। উল্টোদিকে ঘুরে ২০ গজ দৌড়ে বলকে তালুবন্দী করলেন কপিল।

Advertisement

পরিস্থিতির নিরিখে ওই সময়ের সেরা জাদুকরী মুহূর্ত। এক ক্যাচই গড়ে দিল ফাইনালের ভাগ্য। ভারত চ্যাম্পিয়ন। কপিল দেবের হাতে শিরোপা। এটি শুধুমাত্র একটি শিরোপা নয়। একমাত্রার ক্রিকেট বহুমাত্রা পাওয়া। ক্রিকেট পরিণত হল সার্বজনীন উৎসবে।

উপমহাদেশে বিশ্বকাপ আসার প্রভাব হল সুদুরপ্রসারী। বলা যায়, ১৯৮৭ সালে একটা বিপ্লব ঘটে গেল বিশ্ব ক্রিকেটে। প্রথমবারের মত যৌথ আয়োজনে বিশ্বকাপ দেখল ক্রিকেট বিশ্ব। আর এই প্রথমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল দুই চির বৈরি দেশ ভারত-পাকিস্তান।

১৯৮৭ সালে উপমহাদেশে বিশ্বকাপ আয়োজনের আগের বাস্তবতা একটু স্মরণ করা যাক। রাজা-রাজড়ারা যেমন একটা নির্দিষ্ট সময়ে নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য ব্যাক্তিগত উদ্যোগে কিছু খেলাধুলার আয়োজন করতেন। সেরারা পুরস্কার জিততেন, পুরস্কার পেতেন, চলে যেতেন। বিশ্বকাপ ক্রিকটেও ছিল অনেকটা তেমনই। প্রথম তিন আসরের আয়োজক ইংল্যান্ড। নাম প্রুডেন্সিয়াল কাপ। ফাইনালের ভেনু লর্ডস। বিশ্বকাপের স্থায়ী ঠিকানা রানী মাতার বাড়ি।

১৯৮৭ সালের ভারত-পাকিস্তান যৌথ আয়োজনে নবজন্মলাভ করল বিশ্বকাপ তথা ক্রিকেট। শীতের ঝরা পাতার পর বসন্তে বনানী যেমনভাবে নব কিশলয়ের আগমনী বার্তা দেয়, ঠিক যেন তেমনটায় ঘটল ক্রিকেটে। বদলে গেল ক্রিকেটের পুরনো ধ্যান-ধারনা। সর্বোপরি দর্শনও। রাজার খেলা রুপান্তরিত হল প্রজার খেলায়।

ক্রিকেটের বাইরেও বৈশ্বিক কুটনীতিতে এটা একটা মাইলফলক বৈ-কি? চির বৈরী ভারত-পাকিস্তানকে এক মঞ্চে আনল ক্রিকেট। বৈশ্বিক কুটনীতির প্রেক্ষিতে এ এক বিরল ঘটনা! ক্রিকেটকে গ্লোবাল হওয়ার প্রথম পাঠটাই বোধকরি দিল উপমহাদেশ। আভিজাত্যের ইচ্ছার পুতুল থেকে ক্রিকেট হয়ে উঠল সাধারণের প্রাণের উৎসবে।

১৯৮৭ এর পর যৌথ আয়োজনে বিশ্বকাপ, হয়ে উঠল ক্রিকেটের ঘনিষ্ঠ অনুষঙ্গ। ১৯৯২ এর বিশ্বকাপ আসরের আয়োজক হল দুই প্রতিবেশী অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড। ক্রিকেটে বিশ্বায়নের শ্লোগান তখন আকাশে বাতাসে। বর্ণবাদের বিষাক্ত খোলস বদলে প্রায় তিন দশক পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরল দক্ষিণ আফ্রিকা। রংধনু রংয়ে সাজল অজি-কিউইদের এই আয়োজন। রঙিন পোশাক, নিয়ন বাতির আলোয় খেলা, যোগ হল প্রথমবারের মত।

বর্ণিল এই আয়োজনকে বিশিষ্টতা দিল উপমহাদেশ। ওই বিশ্বকাপে প্রথমবারের মত পরস্পরের মুখোমুখি হল দুই চিরপ্রতিদ্বন্দী ভারত-পাকিস্তান। সবার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে ক্রিকেটের অনিশ্চয়তার গৌরবকে নতুন মহিমা দিয়েছিল ভারত।

ক্রিকেটের যে মূল আকর্ষণ, ‘গৌরবময় অনিশ্চয়তা’, তার সঙ্গে যেন উপমহাদেশেরই গাঁটছড়া। সেটাই ১৯৯২ এর বিশ্বকাপে নতুন করে মনে করিয়ে দিল পাকিস্তান।

১৯৯২ এর বিশ্বকাপে পাকিস্তান যা করেছে, তা বোধকরি সব বিশেষণেরই বাইরে। বারবার খাদের কিনারে। এই বুঝি ছিটকে গেল? নাটক ছাড়িয়ে যাওয়া সব নাটকীয়তা। কখনো বৃষ্টির আশীর্বাদ আবার লিগ পর্বের শেষ ম্যাচে রেস থেকে ছিটকে যাওয়া অস্ট্রেলিয়ার শেষ মরণ কামড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের তীরে এসে তরি ডোবা, এতসব ঘটনার ঘনঘটার সার কথা ধ্বংসস্তুপের মধ্য ধেকে সেমিফাইনালে পৌঁছে গেল পাকিস্তান।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ৭৪ রানে অলআউট হওয়ার পরও বৃষ্টি বদান্যতায় পাকিস্তান যদি পয়েন্ট না পেত? বিদায় নিশ্চিত হওয়া অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যদি জিতত, তাহলে? আর এটাই তো পাকিস্তান? একবার ঘুরে দাঁড়ালে ‘কি হতে পারত’, পাকিস্তানের বেলায় এমন প্রশ্নটাই অবান্তর। ভাগ্যক্রমে টিকে থাকা পাকিস্তান সেমিফাইনাল ও ফাইনালে কি করেছিল, সেটাই আসলে ক্রিকেটের আকর্ষণের বড় বিজ্ঞাপন।

ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে দুর্দমনীয় হয়ে ওঠা মার্টিন ক্রোর নিউজিল্যান্ডকে পাকিস্তান যেভাবে মাটিতে নামিয়েছিল, তা এখনও শিহরণ তোলে ক্রিকেটপ্রমীদের হৃদয়-মনে। দুরহ টার্গেটের সামনে ইনজামাম-উল হকের মাত্র ৩৭ বলে ৬০ রানের ইনিংসটি, অতি বড় পাকিস্তান বিদ্বেষীও তারিফ না করে পারেন না।

আর ফাইনালে ওয়াসিম আকরাম যা করলেন তাকে কি বলা যায়? নেইল ফ্রেয়ারব্রাদার-অ্যালেন ল্যাম্ব পঞ্চম উইকেট জুটিতে ৭২ রান তুলে নিয়ে চাপ বাড়াচ্ছে পাকিস্তানের উপর। শ্লগ ওভারের স্পেশালিস্ট ওয়াসিম আকরামকে ৩৫তম ওভারেই আক্রমণে আনলেন অধিনায়ক ইমরান খান।

পরপর দু’বলে ল্যাম্ব ও ক্রিস লুইসকে সারসরি বোল্ড করলেন আকরাম। বিশ্বকাপ ফাইনালের সেরা দুই ড্রিম ডেলিভারির সঙ্গে খোদাই হয়ে গেল ওয়াসিম আকরামের নাম। ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ জেতার সেই স্বপ্ন এখনও অধরা!

এটা ঠিক যে, পিঞ্চ হিটিংয়ের শুরুটা করেছিলেন মার্ক গ্রেট ব্যাচ। শুরুতে পাওয়ার প্লে’র সময় ক্লোজ ফিল্ডিংয়ের সুবিধা কাজে লাগিয়ে বলগুলোকে উড়িয়ে খেলার কৌশলটা গ্রেট ব্যাচকে দিয়ে শুরু করেন ১৯৯২ এর বিশ্বকাপের কিউই অধিনায়ক মার্টিন ক্রো। তবে সেই অর্থে এই পিঞ্চ হিটিংকে সার্থক করতে পারেননি এই কিউই ওপেনার। পাকিস্তানের বিপক্ষে সেমিফাইনাল ম্যাচে ১৭ রানে আউট হয়েছিলেন ব্যাচ।

স্বদেশী মাটিন ক্রোর অ্যান্ড্রু জোনসের ছায়া থেকে বেরুতে পারেননি তিনি। পিঞ্চ হিটিংয়ের সার্থক রূপকার দুই লংকান ঝড় রুমেশ কালুভিথারানা ও সনাৎ জয়সুরিয়া। ১৯৯৬ এর বিশ্বকাপের সব আলো নিজের করে নিয়েছিলেন জয়সুরিয়া। পিঞ্চ হিটিংকে আবশ্যকীয় অনুসরণে পরিণত করেন এই লংকান ওপেনার। অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে শ্রীলঙ্কা। ‘প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট’ নির্বাচিত হন জয়সুরিয়া।

সব হিসাবকে মিথ্যা প্রমাণ করে কাপ জয়, ব্যাক্তিগত কারিশমা দেখিয়ে নাটকীয় জয় তুলে নেয়া শুধু এর মধ্যে আটকে থাকেনি উপমহাদেশ ক্রিকেট। এ অঞ্চলের ক্রিকেটের শক্তি অন্য জ্যায়গায়। ক্রিকেটের একচ্ছত্র রাজত্বকে মেনে না নেয়া, আধিপত্যের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জার হয়ে ওঠা। সত্তর ও আশির দশকে ক্যারিবীয় রাজত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর দুঃসাহস দেখিয়েছে উপমহাদেশ।

বিশ্বায়নের সময়ে অস্ট্রেলিয়ান আধিপত্যকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়নি উপমহাদেশ। ১৯৯৬ সালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েই শিরোপা জিতেছে শ্রীলঙ্কা। তিনবার (১৯৯৯ থেকে ২০০৩) সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফাইনালে হারলেও হাল ছাড়েনি উপমহাদেশ।

২০১১ সালের বিশ্বকাপে আবারও শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসেছে ভারত। এক কথায়, জীবনের যে অন্তর্নীহিত দর্শন, লড়াই জারি রাখা, ক্রিকেটে সেই বার্তাই বহন করে চলেছে উপমহাদেশ।

আইএইচএস/জেআইএম