মতামত

ব্যাংকিং খাতে স্বশাসন, সুশাসন

গত বছর ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে আগে বেসরকারি অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ- সিপিডি, ব্যাংকিং খাত নিয়ে এক নাগরিক সংলাপের আয়োজন করে। সিপিডি জানায় গত ১০ বছরে ব্যাংকিং খাতে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকার কেলেঙ্কারি হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ব্যাংক মালিকরা নিয়ন্ত্রণ করছেন।

Advertisement

এই বক্তব্যের শেষ লাইনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দেশের আর্থিক থাতের অভিভাবক, তাকে যদি ব্যাংকের মালিক বনে যাওয়া একটা শ্রেণি নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে এই খাতে সুশাসন বলে কিছু থাকেনা।

ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম-দুর্নীতি নতুন নয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করেও নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারছে না। কিন্তু ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের সময় আমাদের প্রত্যাশা ছিল আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে এবার সুশাসনে অনেক বেশি নজর দিবে। হয়তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তরফে সেই চেষ্টা আছেও। কিন্তু দেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসন আর আসবেইনা, এমন একটি অবস্থা দাঁড়িয়েছে। অর্থমন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেন মূলধারার ব্যাংকিং-কে এড়িয়ে গিয়ে শুধু বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তা শ্রেণির সহায়ক হতে তৎপর রয়েছে।

মালিকরা বসে সিআরআর কমানো, ঋণ খেলাপিদের একের পর এক সুবিধা দেওয়া, মালিকদের পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘস্থায়ী করাসহ সমস্ত আয়োজন বিশ্ব ব্যাংকিং-এর দরবারে বাংলাদেশের ব্যাংকিং প্রথাকে নিশ্চয়ই আলাদা মর্যাদা দিবে। সাম্প্রতিক সময়ের একটি সিদ্ধান্তও ব্যাংকের অর্থের যে আসল মালিক- অর্থাৎ সাধারণ সঞ্চয়ী- তাদের পক্ষে দেখা যায়নি।

Advertisement

খারাপকে শাসন করতে হয়, শাস্তি দিতে হয়, ভালকে পুরস্কৃত করতে হয়। এটাই দুনিয়ার নিয়ম, এটাই সুশাসন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অর্থমন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক খাতের সুশাসের নতুন নিয়ম আবিষ্কার করেছেন। তারা ভালদের বদলে খারাপদের প্রতি বিশেষ ভালবাসা দেখাচ্ছেন। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা যেখানে ঠিকমত ঋণ পরিশোধ করে, অনেক লড়াই সংগ্রাম করেও যে সুবিধা পায়নি, সেই সুবিধাই ঋণখেলাপিদের উপহার দিতে চাইল মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক।

সম্প্রতি ঋণখেলাপিদের গণসুবিধা দিয়ে যে বিশেষ নীতিমালা জারি করা হয়েছে, তাতে ঋণখেলাপিদের ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নেমে গেছে। পাশাপাশি ঋণ পরিশোধে ১২ মাসের গ্রেস পিরিয়ডসহ টানা ১০ বছর সময় পাচ্ছে তারা। যাঁরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করছেন না, তারা বকেয়া ঋণের ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়েই ঋণ নিয়মিত করতে পারবেন। এতে সুদ হার হবে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। আর এক বছরের ঋণ পরিশোধে বিরতিসহ ১০ বছরের মধ্যে বাকি টাকা শোধ করতে পারবেন। আবার ব্যাংক থেকে নতুন করে ঋণও নিতে পারবেন।

নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেও এক অঙ্কের সুদের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ভালো গ্রহীতারা। দেখে শুনে মনে হচ্ছে, যারা ব্যাংক ঋণ সময়মতো শোধ করেন তারা অপরাধ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তারা, যারা রাজনৈতিকভাবে এই সরকারের সমর্থক, তারাও বলছেন, দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত হলে লুটপাটের সুযোগ তৈরি হবে। একটা নীতি নৈতিকতাহীন ব্যাংকিং প্রথা যদি এইভাবে গড়ে উঠতে থাকে, তাহলে যারা খেলাপি তাহলে সমাজে এবং ব্যবসা বাণিজ্যের জগতে একটা ধারণা তৈরি হবে খেলাপি হওয়াই ভালো।

আসলে পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছেন কয়েকজন ব্যাংক মালিক ও শীর্ষ খেলাপি। এই শীর্ষ খেলাপিদের কেউ কেউ এখন রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণী জায়গায় থেকে নিজেদের মত একটা আর্থিক সংস্কৃতি তৈরিতে সক্রিয় আছেন। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। নিয়মিত করার পর ব্যাংক মালিকরা এই প্রভিশন উঠিয়ে নিয়ে যাবেন। প্রভিশনের টাকা নতুন করে আবারও ঋণ দেবেন। তাতে ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হবে। খেলাপিরাতো সুবিধা নিবেই, ব্যাংকের কয়েকজন মালিক অস্বাভাবিক সুবিধা নিতে শুরু করবেন। ফলে ঝুঁকিতে পড়বেন আমানতকারীরা ও ব্যাংকগুলো।

Advertisement

ঋণখেলাপিদের সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা জারি করেছে তার কার্যক্রমের ওপর ২৪ জুন পর্যন্ত স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। শেষ পর্যন্ত যদি এই নীতিমালা কার্যকর করে নিতে পারে শীর্ষ ঋণখেলাপিরা তাহলে যারা ভালো ঋণগ্রহীতা তারা বিনা অপরাধে, ভাল কাজ করে শাস্তি পাবেন। তারা হয়তো কপাল চাপড়াবেন যে, এতদিন নিয়মিত পরিশোধ করে এসে তারা আসলে কি ভুলটাই না করেছেন। তারা ভাবতে শুরু করবেন, ঋণ নিয়মিত পরিশোধ না করলে এই বিশেষ সুবিধা তারাও পেতেন। এই সার্কুলার বাস্তবায়িত হলে ভালো গ্রহীতাদের ২/৩ বছরে তাদের ঋণ পরিশোধ করতে হবে আর খেলাপিরা পরিশোধে ১০ বছর সময় পাবেন।

এই উদ্যোগ নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মোস্তফা কামালের অনভিজ্ঞতার ফল কি না, জানা নাই। তবে এ ধরনের অনভিজ্ঞতা বা অস্বচ্ছতা কোন কৈফিয়ত হবেনা। আগের অর্থমন্ত্রীর সময়ে ব্যাংক খাতে সুশাসনের ঘাটতি, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও ঋণ ফেরত না দেয়ার সংস্কৃতির কারণে বেশ কিছু বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি ও অঘটনের নজির আছে। সোনালী ব্যাংকের হল মার্ক, বেসিক ব্যাংক লোপাট হওয়া, ফারমার্স ব্যাংককে দেউলিয়া করে ফেলা এদেশের ব্যাংকি ইতিহাসে আর্থিক খাত লুটপাটের টেক্সটবুক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে আজীবন।

প্রত্যাশা থাকবে যে নতুন অর্থমন্ত্রী সচেতন থাকবেন তার সময়টিতে যেন এমনটা না ঘটে। তার আমলে যেন এই খাতে সুশাসনের বদলে মালিকদের স্বশাসন না চলে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা না গেলে শাসন ব্যবস্থার আর কোন স্তরেই সুশাসন নিশ্চিত করা যাবেনা।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/জেআইএম