আন্তর্জাতিক

ভারতে এমন শোচনীয় হার আগে দেখেনি বামরা

ভারতের সংসদীয় রাজনীতিকে আপন করে নিতে তাদের তাত্ত্বিক দ্বিধা ছিল। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রে একবার তারা পা রাখার পরে কখনও যা হয়নি, এবার তাই দেখছে ভারত! পুরো দেশের রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে প্রায় মুছে যাচ্ছে বামরা!

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গের সব সমীক্ষার ইঙ্গিত সত্য প্রমাণিত করে হাতে থাকা দুটি আসনই হারিয়েছে সিপিএম। গত বছর ত্রিপুরায় ক্ষমতা হারানোর পর সেখানে লড়াই যথেষ্ট কঠিন হয়ে পড়েছিল। সেই ধারা বজায় রেখেই উত্তর-পূর্বের ওই রাজ্যে দুটি আসনই সিপিএমের হাতছাড়া হয়েছে।

একখণ্ড দ্বীপের মতো আশার বাতি জ্বলে ছিল শুধু কেরালা প্রদেশে। পুরো ভারত যখন নরেন্দ্র মোদির প্রত্যাবর্তনের পক্ষে রায় দিচ্ছে, মালাবার উপকূলই একমাত্র সম্পূর্ণ উল্টো দিকে গিয়ে বিজেপিবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু কেরালায় মোদিবিরোধী হাওয়ার কোনো ফায়দা বামদের পালে আসেনি। গতবারের জেতা আটটি আসনের জায়গায় এবার সেখানে শাসক বাম এগিয়ে মাত্র একটি আসনে।

আরও পড়ুন : স্ত্রীকে ঘুষি মারলেন সাংসদ এই তিন রাজ্যের বাইরে বামদের দিকে সবার নজর ছিল; তার নাম বিহারের বেগুসরাই। যেখানে মোদি-বিরোধী মুখ হয়ে সিপিআইএমের প্রার্থী ছিলেন কানহাইয়া কুমার। কিন্তু বৃহস্পতিবার ভোটযন্ত্র খোলার পরে দেখা যায়, বেগুসরাই তরুণ বাম নেতার প্রতি একটুও সদয় হয়নি।

Advertisement

কেন এমন হল? জওহরলাল নেহরুর আমলেও যে বামদের সংসদে গ্রহণযোগ্যতা ছিল, তারা এভাবে অপ্রাসঙ্গিকতার অন্ধকারে তলিয়ে গেল কেন? বাম নেতারা বলছেন, তীব্র মেরুকরণের ভোটে তারা এবার পায়ের তলায় জমিই খুঁজে পাননি। সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘুর ধর্মীয় বিভাজনে এবারের ভোট ভাগ হয়েছে বলে রাজনৈতিক শিবিরেরও প্রাথমিক ধারণা।

সেই বিশ্লেষণ থেকেই বাম নেতাদের মনে হচ্ছে, মোদিকে হটিয়ে কেন্দ্রে তারা সরকার গড়তে পারবেন, এমন কোনো সম্ভাবনা না থাকায় তারা লড়াই থেকেই ছিটকে পড়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ বা কেরালা, সংখ্যালঘু মানুষের সমর্থনও তাদের দিকে আসেনি। দিল্লিতে মোদিকে ঠেকানোর আকাঙ্ক্ষা থেকে কেরালায় ক্ষমতাসীন বামের পক্ষে না গিয়ে প্রায় ৪৪% সংখ্যালঘু ভোটই বরং মেরুকরণ হয়ে কংগ্রেসের বাক্সে পড়েছে।

আরও পড়ুন : ভালো করেছ বন্ধু : মোদিকে নেতানিয়াহু

পশ্চিমবঙ্গের বামদের অবস্থা আরও শোচনীয়। নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক হিসেব বলছে, বিজেপির ভোট এবার বেড়ে হয়েছে ৩৮.৫%। আর বামদের ভোট নেমে এসেছে প্রায় ৬% এ! তিন বছর আগের লোকসভা ভোটে বামফ্রন্ট পেয়েছিল প্রায় ২৬% ভোট। বিজেপির ভোট তখন ছিল ১০.১৬%।

Advertisement

অনেকেই মনে করছেন, বামদের যে ২০% ভোট ক্ষয় হয়েছে, তার পুরোটাই যোগ হয়েছে বিজেপির লাভের খাতায়! যে কারণে ভোটের আগে থেকে সামাজিক মাধ্যমে ঘুরতে থাকা স্লোগান এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব, ‘বামের ভোট রামে’!

বিধানসভার নির্বাচনের পর গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাম ভোট কমে এসেছিল প্রায় ১৬ শতাংশে। বামদের ছাপিয়ে রাজ্যের নানা জায়গায় তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে এসেছিল বিজেপি। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটে স্থানীয় নানা সমীকরণ কাজ করে, কোনো দলের শীর্ষ নেতৃত্বেরই সেখানে চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ থাকে না। লোকসভা নির্বাচনে বামদের এমন রক্তক্ষরণ রাজনৈতিক শিবিরে প্রবল বিস্ময় তৈরি করছে।

আরও পড়ুন : ফলাফল দেখে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন কংগ্রেস নেতা

রাজ্য রাজনীতির সমীকরণে বামফ্রন্ট এবং বিজেপি, দু’পক্ষেরই অবস্থান তৃণমূলবিরোধী। লোকসভা নির্বাচনে এই দু’পক্ষের ভোট কেন মিশে গেল, তার তিন দফা কারণ উঠে আসছে রাজনৈতিক শিবিরের প্রাথমিক পর্যালোচনায়।প্রথমত, দেশটিতে নরেন্দ্র মোদির সরকারের প্রত্যাবর্তনকে ঠেকানোর চেয়েও রাজ্যে তৃণমূলের হাত থেকে ‘নিস্তার’ পাওয়াকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বাম কর্মী-সমর্থকরা।

দ্বিতীয়ত, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট শেষ মুহূর্তে ভেস্তে যাওয়ায় হতাশা তৈরি হয়েছিল বাম শিবিরের বড় অংশে। কংগ্রেসের সঙ্গে থাকলে কেন্দ্রে বিকল্প সরকার গড়ার যে বার্তা দেয়া যেত, তা সম্ভব হয়নি। এই হতাশাই বহু বাম সমর্থককে পদ্মমুখী করে তুলেছে।

তৃতীয়ত, নির্বাচনে ব্যর্থ বাম নেতৃত্বের কোনো নিয়ন্ত্রণ কর্মী-সমর্থকদের ওপরে কাজ করেনি। তারাই এবার তৃণমূলকে শিক্ষা দেবেন, বিজেপি নেতৃত্বের এই প্রচারে বরং বাম কর্মী-সমর্থকেরা বেশি ভরসা রেখেছেন! ভাঙা সংগঠন নিয়েও যতটুকু কাজ করা যায়, তার বেশির ভাগটাই তলে তলে গেরুয়া শিবিরের পক্ষে গিয়েছে।

মধ্যদুপুরে পদ্ম-বিস্ফোরণ দেখতে দেখতে সিপিএমের এক পলিটব্যুরো সদস্যের মন্তব্য: ‘এ ভোট ঝড়ের ভোট! মেরুকরণের ভোট! কোনো অঙ্ক, কোনো রসায়নে এর হিসেব নেই!’ আনন্দবাজার।

এসআইএস/পিআর