১৯৯৯ সালে প্রথম বিশ্বকাপে যাওয়ার আগের দিনের ঘটনা। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ক্রিকেট বোর্ড থেকে বিদায়ের আয়োজন। অনাড়ম্ভর আয়োজনই, তবে চমকের মাত্রা বাড়িয়ে মিনহাজুল আবেদীন উপস্থিত। ওদিকে এর আগে ঘোষিত ১৫ জনও আছেন। ১৫ জনের জায়গায় ১৬ জন যাচ্ছেন, কিভাবে সম্ভব?
Advertisement
আমরা গুটিকয় সাংবাদিক এর হিলে করার চেষ্টা করছি এবং আমূল ব্যর্থ হচ্ছি। দেখা গেল কেউ কিছু জানেন না অথবা জানলেও বলছেন না। এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের এই চেষ্টাতেই বিরক্ত, ‘আপনারা শুধু শুধু পেছনে লেগে থাকেন? আজকের দিনে না লাগলে হয় না!’
‘এখানে পেছনে লাগার কী আছে? আপনারা ১৫-১৬ হিসাবটা মিলিয়ে দিলেই তো হয়।’ বলল আমাদের পক্ষের কেউ একজন। ‘আরে ১৬ জনের ব্যবস্থা যদি আমরা করে ফেলতে পারি তাহলে কি কোনো সমস্যা হয়? এতে তো দেশের লাভ। আপনাদের দেখা যাচ্ছে দেশপ্রেম নেই।’
আজকের মতো দেশপ্রেমটা তখন এত গুরুতর ব্যাপার হয়ে ওঠেনি। তবু তখনো এই জিনিসের ফেরি হতো। কেউ কেউ মিইয়ে গেল। বাকি সব দল খেলবে ১৫ জন নিয়ে, এখন আমাদের কর্তারা যদি ১৬ জনের বন্দোবস্ত করে ফেলতে পারেন তাহলে তো মন্দ হয় না। সৈয়দ আশরাফুলের সঙ্গে আইসিসির যোগাযোগের গল্প নানা রং ছড়িয়ে এত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে কারো কারো মনে দ্বিধা তৈরি হতো, হয়তো কোনো লাইনে আমাদের ১৬ জন হয়ে যাবে।
Advertisement
আমরা আর খুব কথা বাড়ালাম না। তখন ইন্টারনেটও নেই যে একটা টিপ দিয়ে সব জেনে গিয়ে কর্তাদের বলব, আপনারা আমাদের মোয়া খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন, এই যে দেখেন..., আসল ব্যাপারটা হলো এ রকম।
দল চলে গেল। উঠল জার্ভিস নামের একটা হোটেলে। নিজস্ব খরচে। কিছু কাউন্টি দলের সঙ্গে আগেভাগে খেলে ইংলিশ কন্ডিশনের সঙ্গে পরিচয় তৈরির চেষ্টা। সেবার মজার ঘটনা ঘটল আরেকটা। বাংলাদেশ থেকে ভিসা প্রত্যাশী সাংবাদিকদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিতদের অনেককেই ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানাল ব্রিটিশ হাইকমিশন। কারণ হিসাবে বলা হলো, এসব পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ হয় না, যখন সিলেটের কয়েকজন আবেদনকারীর ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি নেই।
‘সিলেটিদের লন্ডন কানেকশন’ নিয়ে হাসি-তামাশা আমাদের মধ্যে প্রচারিত ছিল, সেটাই সত্য হয়ে গেল। এর সত্যতা আরো জানা গেল ওখানে গিয়ে। ট্যাক্সি ড্রাইভারসহ অন্য অনেকে জানতে চায়, এখানে যে দলটি খেলতে এসেছে সেটা সিলেটের দল না বাংলাদেশের দল?
সত্যি বললে, সেই বিশ্বকাপে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল সিলেটিভিত্তিক। সিলেটি নাগরিকদের দাপট সূত্রে সিলেটকে দেশ মনে করে বসত সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশ দল বিশ্বকাপে গিয়ে এবং খেলে জানাল যে, সিলেটিরা যে দেশ থেকে এসেছে সেই দেশটার নাম বাংলাদেশ।
Advertisement
ক্রিকেট দিয়ে মানচিত্র আঁকার যে কথাটা আজ জোরেশোরে উচ্চারিত হয়, সেটার শুরুই হয়েছিল বিশ্বকাপ ক্রিকেট দিয়ে। এবং আরো নির্দিষ্ট করে বললে, ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ দিয়ে।
দিন ফিরে গেলে হারানো দিনের কথা কেউ মনে রাখতে চায় না। পুরনো কাসুন্দি মনে হয়। তবু ভোলা যাবে না সেই বিশ্বকাপই ভিত্তিপ্রস্তর। না হলে এত তাড়াতাড়ি টেস্ট স্ট্যাটাস হয় না। হয় না আরো অনেক কিছুই।
২০ বছর পর আবার বিশ্বকাপ। আবার ইংল্যান্ড। সেবার তৈরি হয়েছিল ভিত। এবারের স্বপ্নে সর্বোচ্চ চূড়া।
কিন্তু ইংল্যান্ড আর বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ক্রিকেট সম্পর্ক ঠিক এখানেই গণ্ডিবদ্ধ নয়। এত বৃহত্তর ক্ষেত্রে ছড়িয়ে গেছে যে এক বিবেচনাতে দেখছি, ইংলিশ কন্ডিশন যে বদলে প্রায় উপমহাদেশের কন্ডিশন- এর পেছনের প্রভাবটা আসলে বাংলাদেশেরই।
২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই ম্যাচ জিতে বাংলাদেশ নতুন যুগে গেল, আমরা উদ্বেল ছিলাম। ম্যাচ জেতার দিনে হারাদের দিকে কেউ ফিরে তাকায় না। সংবাদ সম্মেলনে মরগ্যানকে দেশি সাংবাদিকদের হাতে হেনস্তা হতে দেখে বরং আমাদের জয়কে আরো মহিমামণ্ডিত মনে হচ্ছিল।
সেই জয় আমাদের মানসিকতা অনেক বদলে দিয়েছে। তা জয় মানসিকতা বদলায় জানতাম। কিন্তু হার? সেটাও যে এমন টনিকের কাজ করে জানা ছিল না। সেদিন ইংল্যান্ড দলে প্রায় সবাই ছিলেন। হেলস, মরগ্যান, স্টোকস, বাটলার। বাংলাদেশের সঙ্গে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের পর যেন ওদের মনে হলো, আমাদের বদলে ফেলা দরকার।
বদলাল। এই অবিশ্বাস্য বদলে বিশ্ব আসরে যে ইংল্যান্ড সাধারণত থাকে হাসি-তামাশার দল, তারাই এখন ওয়ানডে ক্রিকেটের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক দল। এর চেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাটিং ওয়ানডেতে আর কে করেছে এমন ধারাবাহিকতায়!
এদিকে ওদের ব্যাটিংয়ের বিস্ফোরক স্তরে উত্তরণ। ওদিকে আইসিসিও চায় ব্যাটিংসর্বস্ব উইকেট দিয়ে রানের মেলা বসাতে। আয়োজক আর স্বাগতিকদের চাহিদা এমনভাবে মিলে যাওয়াতেই ইংলিশ উইকেটের চরিত্র বদলে বাধা আসছে না কোনো। কিসের ইংলিশ কন্ডিশন। কিসের সিম-সুইং। সব বাদ। রানময়, নিরামিষ ব্যাটিং চরিত্রে রূপান্তরের পেছনে পরোক্ষে তো বাংলাদেশের ভূমিকাও আছে। সেই যে ইংল্যান্ডকে হারানো..., সেই যে ইংল্যান্ডের বদলে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা..., বাংলাদেশ সূত্রেই তো।
২০ বছর আগে এক বিশ্বকাপে বাংলাদেশ গিয়েছিল দুরুদুরু বুকে। গিয়ে নিজেদের ক্রিকেটের সঙ্গে দেশকেও চেনাতে হয়েছিল। সিলেটসংক্রান্ত বিভ্রান্তির বৃত্ত থেকে বের করেছিল দেশকে।
আর ২০ বছর পর মঞ্চ এমনই বদলে গেছে যে ইংল্যান্ডই যেন প্রায় বাংলাদেশ। চেহারা-চরিত্র একেবারে অন্য রকম বলে বাংলাদেশকে এখন ভাবতে হচ্ছে, আমরা কি স্পিনার একজন কম নিলাম? ২০ বছর আগে ছিল বল খেলার ভীতি। এখন সাড়ে তিন ’শ, চার ‘শ রান করার তাগিদ।
এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কেমন করবে না করবে সেই অঙ্ক হবে বিশ্বকাপ শেষে। বিশ্বকাপের আগের অঙ্কটা কিন্তু কম কৃতিত্বের নয়। ইংল্যান্ডের অহংয়ের ইংলিশ কন্ডিশন বাংলাদেশের ছোঁয়া বা চাপে টেমস নদীতে সলিলসমাধিস্থ।
আইএইচএস/জেআইএম