আন্তর্জাতিক

কনডমে আগ্রহ কমছে মানুষের

কনডমে আগ্রহ কমছে মানুষের

নিরাপদ যৌন মিলনের প্রতি আগ্রহ নাকি কমে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক কিছু জরিপে কনডমের ব্যবহার কমে যাবার ইঙ্গিত পাওয়ার পর বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। এর কারণ জানতে অনেকের সঙ্গে কথা বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

Advertisement

হেইলি (ছদ্মনাম) নামের একজনের কথা শোনা যাক সবার আগে। কলেজ ছুটির পর এক বিকেলে তার অ্যারন নামের (এটিও ছদ্মনাম) একজনের সঙ্গে দেখা হয়। যাকে তিনি স্কুলে পড়ার সময় থেকে কিছুটা চিনতেন। অনেক দিন পর দেখা হওয়ায় তারা গল্প জুড়ে দেন।

জানা যায়, অ্যারন মাঝখানে বেশ কয়েক বছর সেনাবাহিনীতে কাটিয়ে ফিরেছেন। সন্ধ্যা থেকে ক্রমশ রাত বাড়তে শুরু করলো তাদের গল্পও একটু অন্যরকম হতে শুরু করলো। তারা একসঙ্গে বাড়ি ফিরলেন।

হেইলি বললেন, ‘অ্যারন যেহেতু অচেনা কেউ ছিল না, তাই একটা অপরিণত কিশোরী মেয়ের মতো আমিও ভাবলাম, কনডম ব্যবহারের কোন প্রয়োজন নেই।’ তাই হলো কিন্তু কয়েকদিনে মধ্যেই তিনি শরীরে ক্ল্যামাইডিয়া সংক্রমণের লক্ষণ দেখতে পেলেন।

Advertisement

তার নিজের ওপরই রাগ হতে থাকলো যে, কেনো তিনি এমন কাজ করলেন। তার রাগ আরও বেড়ে গেলো যখন তিনি আরেক বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পারলেন যে অ্যারনের নিজেরও জানা ছিল যে, তিনি ছোঁয়াচে রোগ বহন করছেন। কিন্তু তারপরও সে অরক্ষিত যৌন সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে একের পর এক মেয়েকে সংক্রমিত করে চলেছিল।

হেইলি নিজে জন্মনিয়ন্ত্রণের পিল খেতেন, এছাড়াও তার মাথায় এটা ঘুরছিল যে ‘কনডম ব্যবহারের কথা না তুললে তার পুরুষ সঙ্গী খুশি হবেন।’ কিন্তু যখন তিনি বুঝলেন, তার দেহে যে সংক্রমণ হয়েছে তা না সারলে তিনি সন্তান ধারণের ক্ষমতা হারাতে পারেন, তখন তাকে নতুন করে ভাবতে হলো।

যুক্তরাজ্যের স্কুলগুলোতে যৌনশিক্ষার ক্লাসে কনডম ব্যবহারের কথা শেখানো হয়। তবে তারপরও হেইলির মতো অনেকে নারী নিরাপদ যৌনসম্পর্কের নিয়ম কানুন মেনে চলেন না।

ইউগভ আর পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের জরিপে বলা হচ্ছে, ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সের তরুণ তরুণীদের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে যে, তাদের অর্ধেকই স্বীকার করেছেন যে তারা কনডম ব্যবহার না করেই যৌনমিলন করেন।

Advertisement

জরিপে আরও দেখা গেছে, এমন বয়সের প্রতি ১০ জন যৌন-সক্রিয় তরুণ তরুণীদের মধ্যে অন্তত একজন কখনোই কনডম ব্যবহার করেনি। অথচ ২০০৩ সালের এক জরিপে এই বয়সসীমার পুরুষদের মধ্যে ৪৩ শতাংশেরও বেশি বলেছিলেন যে, পূর্ববর্তী চার সপ্তাহের মধ্যে তারা প্রতিবারই যৌন সম্পর্কের সময় কনডম ব্যবহার করেছেন।

অথচ এক দশক পরের জরিপগুলোতে দেখা যাচ্ছে, এই সংখ্যা এখন ৩৬ শতাংশে নেমে এসেছে। একই ভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৭ ও ২০১৭ সালে করা জরিপে দেখা গেছে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্কুল ছাত্রদের মধ্যে কনডম ব্যবহারের পরিমাণ ৬২ শতাংশ থেকে কমে ৫৪ শতাংশে নেমে গেছে।

যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে ছড়ানো রোগ গণোরিয়া কিংবা ক্ল্যামাইডিয়া নিয়ে করা এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাজ্যে প্রতি চার মিনিটে একজন তরুণ এসব রোগের সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন।

সরকারি তথ্যে বলা হচ্ছে, তাদের মধ্যে ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সীরা আছেন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন। ব্রিটেনে সিফিলিস এবং ‘সুপার গণোরিয়া’ নামে একটি রোগও ছড়াচ্ছে, যা সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সারে না। এসব রোগের বিস্তার ঠেকাতে পারে কনডম, যা কোনো কোনো ওষুধের দোকানে তরুণরা বিনামূল্যেও পেতে পারে।

কনডমের ব্যবহার কমার কারণ হিসেবে অনেকে বলছেন, অন্যান্য গর্ভনিরোধক ব্যবহার বেড়ে যাওয়া একটা বড় কারণ। দেশটির সরকারি স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা বলছে, ইমপ্ল্যান্ট, ইনজেকশন আইইউডির মতো দীর্ঘস্থায়ী জন্মনিরোধ পদ্ধতির ব্যবহার বাড়ছে।

নানা রকমের কনডম এখন বাজারে পাওয়া যায়। কিন্তু তবু জনপ্রিয়তা কমছে কেন? ‘নারীদের কনডমও’ চালু হয়েছে ১৯৯২ সাল থেকে কিন্তু তা কখনো জনপ্রিয়তা পায়নি।

অনেকের মতে, এইচআইভি-এইডসের ভয় অপেক্ষাকৃত কমে যাওয়াটা একটা কারণ হতে পারে। কারণ এইচআইভি সংক্রমণ ঠেকানোর সঙ্গে কনডমের নাম অনেকদিন ধরে জড়িয়ে গেছে। স্যামুয়েলের (ছদ্মনাম) বয়স এখন ২৭ বছর, তিনি বলছেন তারা বড়দের কাছে এইডসের কথা শুনেছেন যে, এ রোগ হলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।

তবে এখন এইচআইভির কথা অনেক কম শোনা যায়, ‘প্রেপ’ নামে এমন এক ওষুধ বেরিয়েছে যাতে আগে থেকেই শরীরকে এইচআইভি থেকে সুরক্ষিত রাখা যায়, এইচআইভি-প্রতিরোধী এন্টি-রেট্রোভাইরাল ওষুধও বেরিয়েছে ।

এসবের সঙ্গে কনডম ব্যবহার কমে যাবার সম্পর্ক দেখা গেছে অস্ট্রেলিয়ায় হওয়া এক জরিপে। সেই জরিপে পুরুষ সমকামীরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এইচআইভি ছাড়া অন্য যৌন রোগগুলো অতটা ভীতি-উদ্রেককারী নয়, হয়তো অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েই সেগুলোর চিকিৎসা সম্ভব।

এমন অনেক যুগল আছেন যারা কনডম ব্যবহার পছন্দ করেন না। কনডমের কারণে তারা যথেষ্ট উত্তেজিত হতে পারেন না এমন সমস্যাও আছে। যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় সিআরইপি।

সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনথিয়া গ্রাহাম বলছিলেন, এটা সব বয়সের পুরুষের মধ্যেই দেখা যায়। অনেকেই অভিযোগ করেন এতে যৌন অনুভূতি কমে যায়। কোনো কোনো নারী মনে করেন কনডম ব্যবহার করতে বললে তাকে তার সঙ্গীকে হারাতে হতে পারে।

এছাড়া কনডম কিনতে যাওয়াটাও অনেকের জন্য একটা সমস্যা। বিশেষ করে নারীদের জন্য। আরো কিছু শারীরিক অসুবিধা বা ছিঁড়ে যাওয়ার সমস্যা তো রয়েছেই।

অনেক যুগলই কনডম ব্যবহার নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করেন। এটাও একটা কারণ। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের কথা হলো, এ ক্ষেত্রে সম্পর্কের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

যুক্তরাজ্যে এখন যেভাবে যৌন শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, তাতে করে আগামীতে অনেক পরিবর্তন আসছে। ভবিষ্যতে তরুণদের হয়তো দেখা যাবে এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বদলে গেছে।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

এসএ/এমকেএইচ