জাতীয় বাজেটে তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও বিনিয়োগের কোনো পরিকল্পনা থাকছে না। আবার সমন্বয়, বাস্তবায়ন, উদ্ভাবন ও তরুণদের দক্ষতা বৃদ্ধির কার্যক্রমের ঘাটতিও প্রকট। এমন প্রেক্ষাপটে মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ তরুণ জনগোষ্ঠী নিয়ে বাংলাদেশ বর্তমানে যে জনমিতিক সুবিধায় আছে তা একটা সময় বড় ধরণের অসুবিধায় পরিণত হবে।
Advertisement
একশনএইড বাংলাদেশ ‘যুব জনগোষ্ঠীর জন্য বিনিয়োগ : বাজেটে প্রতিফলন কী?’ নামে একটি গবেষণায় এমন চিত্র তুলে ধরেছে।
মঙ্গলবার (২১ মে) ঢাকার পুরান পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের কনফারেন্স রুমে আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। একশনএইড বাংলাদেশ ও ইকোনোমিক রিপোটার্স ফোরাম যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
প্রতিবেদনটি নিয়ে আলোচনাকালে বিশেষজ্ঞরা বলেন, পর্যাপ্ত বাজেটের অভাব এবং বিদ্যমান বরাদ্দকৃত বাজেটে যুব উন্নয়নমূলক খাতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় তরুণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নয়নে যুব শক্তিতে সুপরিকল্পিত বিনিয়োগ প্রয়োজন। তা নাহলে দেশ ও সমাজ একটি স্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হবে। যেটি হবে জাতীয় সংকট।
Advertisement
অনুষ্ঠানের শুরুতে যুব বাজেট নিয়ে গবেষণাপত্রটি তুলে ধরেন ইংরেজি দৈনিক দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্ল্যানিং এডিটর আসজাদুল কিবরিয়া।
গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান শাসন কাঠামো অনুযায়ী ২২টি মন্ত্রণালয় যুব ও যুবদের উন্নয়ন সম্পর্কিত। ২০১৮ সালের বাজেটে এই ২২টি মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেটে মোট বরাদ্দ ছিল ১.৬৬ লাখ কোটি টাকা যা পরবর্তীতে ২১.৬ শতাংশ কমে ১.৩৭ লাখ কোটিতে নেমে আসে। একই সময় মূল জাতীয় বাজেট চার লক্ষ কোটি থেকে ৭.৮১ শতাংশ কমে ৩.৭২ লাখ কোটিতে নেমে আসে, অর্থাৎ সামগ্রিক বাজেটের তুলনায় এই ২২টি মন্ত্রণালয়ের বাজেট কমার হার বেশি।
গবেষণায় দেখা গেছে, মন্ত্রণালয়গুলোতে নানাভাবে, আলাদাভাবে বা যৌথভাবে তরুণদের জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে তরুণদের জন্য পরিকল্পনা নেই। আবার মন্ত্রণায়গুলোর এই বাজেট ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে সমন্বয়েরও ঘাটতি আছে।
গবেষণার আলোকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান-বিআইডিএস’র সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তাফা কে মুজেরী বলেন, ‘তরুণরাই আমাদের দেশ ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। অথচ আমাদের দেশের বাজেটে যুব উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ অবহেলিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মস্থানের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে যে পরিমাণ বরাদ্দ দরকার তা করা হচ্ছে না। এই বিনিয়োগ দুরবস্থা আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিনিয়োগ না হলে অদূর ভবিষ্যতে আমরা খুব খারাপ পরিস্থিতিতে পড়ব।’
Advertisement
তিনি আরও বলেন, ‘সামগ্রিক বাজেট কাঠামোতে তরুণদের যুক্ত করা হয় না। আবার তাদের সংগঠিত হয়ে বাজেটে কথা বলার সুযোগ নেই। অন্যদিকে, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে অগ্রসর হওয়া চতুর্থ শিল্প বিপ্লবেও পিছিয়ে পড়ছে আমাদের তরুণরা। পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি হচ্ছে না। ফলে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যত সৃষ্টি হচ্ছে আমাদের তরুণদের সামনে।’
ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, বাজেটে তরুণদের জন্য বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। গর্বাবস্থায় মায়ের স্বাস্থ্য উন্নয়নসহ সব বিষয়ে শিশুদের মানসিক বিকাশে সুস্পষ্ট বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। শিশু ও যুব শক্তির উন্নয়ন বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। অনেক শিশু পুষ্টিহীনতায় আছে। পুষ্টিহীনতায় থাকলে আমরা কর্মময় যুবশক্তি পাব না। তা করতে না পারলে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে। আমাদের জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি তৈরি করতে হবে। আমাদের ইনফরমাল ইকোনমিতে ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ যুবক কাজ করে। মাত্র ১০ শতাংশ ফরমাল ইকোনমিতে কাজ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. তাহমিনা আখতার বলেন, ‘শিক্ষায় জোর দেয়ার বিকল্প নেই। বাজেট বরাদ্দ তো কমই, আবার মন্ত্রণালয়ের বাজেটে সমন্বয়ও থাকে না। যুব উন্নয়নে বরাদ্দকৃত বাজেটের বাস্তবায়নকে ফলপ্রসূ করতে যুব ইস্যুতে সম্পর্কিত যে ২২টি মন্ত্রণালয় রয়েছে তাদের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে, যুবদের জন্য বিনিয়োগ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে একটি সামাজিক বিনিয়োগ।’
বিজিএমইএ’র সভাপতি রুবানা হক বাংলাদেশে তরুণদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তার মতে, মানসিক স্বাস্থ্য, উদ্দীপনার অভাব, দক্ষতার ঘাটতি ও যুগোপযোগী শিক্ষার অভাব বর্তমানে তরুণদের প্রধান সমস্যা।
রুবানা হক বলেন, ‘আমাদের বাজেট, কর্মকাণ্ড তরুণদের ভালো মানসিকতা নিশ্চিত করতে পারছে না। ফলে তার কোনো কাজ করতে উদ্দীপ্ত হয় না। আমাদের শিক্ষা কিংবা উন্নয়ন কাঠামো তরুণদের উদ্ভাবনী শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক নয়। এদেশের তরুণরা অনেক নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করছে, ছোট ছোট ব্যবসা শুরু করছে। তবে এগুলো এগিয়ে নিতে তারা কোনো সহযোগিতা পান না। ফলে তাদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে যায়।’
এমইউএইচ/এমবিআর/এমএস