নতুন অর্থবছরের (২০১৯-২০) বাজেট উপলক্ষে বীমা খাতের জন্য নয় দফা দাবি জানিয়েছে বীমামলিক ও নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ)। মঙ্গলবার বিআইএ’র কার্যালয়ে আয়োজিত প্রাক-বাজেট সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি তুলে ধরা হয়।
Advertisement
সংবাদ সম্মেলনে বাজেটে বীমা খাতের দাবিগুলো তুলে ধরেন বিআইএ’র প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন। তিনি বলেন, লাইফ ও নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশেষ করে বেকারত্ব নিরসন, বিনিয়োগ, শেয়ারবাজার, সম্পদ পুঞ্জিভূতকরণ, সরকারি কোষাগারে কর প্রদান এবং অর্থ একত্রিকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। আমরা মনে করি, এ শিল্পের ভবিষৎ অনেক উজ্জ্বল। কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে আমাদের এ খাতের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
বাজেটে বীমা খাতের দাবিগুলো-
এক. পুনঃবীমা কমিশনের বিপরীতে ১৫ শতাংশ হারে যে উৎসে মূল্য সংযোজন কর আদায় করা হয়, তা থেকে অব্যাহতি দেয়া। এ দাবির পক্ষে বলা হয়, পুনঃবীমা প্রিমিয়ামের কমিশনের ওপর মূসক প্রযোজ্য নয়। বীমা কোম্পানি প্রিমিয়াম গ্রহণ করলেই গ্রাহকের নিকট থেকে ১৫ শতাংশ হারে মূসক গ্রহণ করে তা সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান করে। যেহেতু একই বিষয়ের ওপরে ভ্যাট প্রদান করা হয়েছে, পুনরায় একই বিষয়ে ভ্যাট প্রদান করা হলে তা দ্বৈত করের সামিল হবে।
Advertisement
দুই. নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্সের স্বাস্থ্য বীমার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট মওকুফ করা। এ দাবির পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হয়, লাইফ ইন্স্যুরেন্সগুলো (জীবন বীমা) হেলথ ইন্স্যুরেন্স কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের এ পলিসির জন্য ভ্যাট দিতে হয় না। পক্ষান্তরে নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্সকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রদান করে থাকে। যার ফলে হেলথ পলিসির মূল্যহার বেশি হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির হেলথ পলিসিসমূহ জনপ্রিয়তা অর্জনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। হেলথ পলিসির ওপর থেকে ভ্যাট মওকুফ করা হলে অনেক গ্রাহকই হেলথ পলিসির আওতায় আসবে।
তিন. জীবন বীমা পলিসিহোল্ডারদের পলিসি বোনাসের ওপর ৫ শতাংশ গেইন ট্যাক্স কর্তন বন্ধ করা। এ দাবির পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হয়, পলিসি বোনাসের ওপর ৫ শতাংশ গেইন ট্যাক্স আরোপ করার ফলে দেশের সব লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পলিসি হোল্ডারদের সংখ্যা কমে গেছে। গ্রাম-গঞ্জের ক্ষুদ্র পলিসি হোল্ডারদের ঝুঁকি ও মুনাফার কথা বুঝিয়ে তারপর পলিসি বিক্রি করা হয়। ক্ষুদ্র পলিসি হোল্ডারদের পলিসি বোনাসের ওপর ৫ শতাংশ গেইন ট্যাক্সের যে বিধান চালু করা হয়েছে তা যদি উঠিয়ে নেয়া না হয় তাহলে দেশে লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ব্যবসা প্রতিনিয়ত কমতে থাকবে এবং কোম্পানিগুলোর পক্ষে টিকে থাকা কষ্টসাধ্য হবে।
চার. বীমা এজেন্টদের উৎসে কর থেকে অব্যাহতি দেয়া। এ দাবির পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হয়, বীমা এজেন্টদের কমিশনের ওপর ৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনের বিধান রয়েছে। পক্ষান্তরে, বিদ্যমান আয়কর আইন অনুযায়ী ব্যক্তি করদাতাদের ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়ের সীমা দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ পরিপ্রেক্ষিতে বীমা শিল্পে কর্মরত স্বল্প আয়ের এজেন্টদের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের ন্যয় ন্যূনতম করমুক্ত আয় সীমা পর্যন্ত উৎসে কর কর্তন থেকে অব্যাহতি দেয়া উচিত।
পাঁচ. পুনঃবীমা প্রিমিয়ামের ওপর উৎসে কর রহিত করা। এ দাবির পক্ষে বলা হয়, বর্তমানে বীমা কোম্পানিগুলো পুনঃবীমা প্রিমিয়াম পাঠানোর ক্ষেত্রে উৎসে কর কর্তন সম্পর্কিত অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। পুনঃবীমার ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ হারে কর আরোপিত হলে বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক ব্যয় ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে এবং এ শিল্পে একটি সংকটময় পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। যার ফলশ্রুতিতে কোম্পানি তার অর্জিত মুনাফা হতে বঞ্চিত হবে এবং সরকারও রাজস্ব হতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
Advertisement
ছয়. কর্পোরেট করের হার হ্রাস করা। এ দাবির পক্ষে বলা হয়, বীমা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের করের হার সাড়ে ৩৭ শতাংশ। অন্যদিকে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের করের হার ২৫ শতাংশ অথবা তার চেয়ে কম। তাই বীমা কোম্পানির কর্পোরেট করের হার কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা প্রয়োজন।
সাত. কৃষি বীমার ওপর থেকে কর রহিত করা। এ দাবির পক্ষে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ খাত ক্রমাগত বিপন্ন হচ্ছে। এর ফলে কৃষকরা কৃষিকাজে অনীহা প্রকাশ করছে। তাই কৃষকদের জন্য কৃষিবীমা অপরিহার্য। কৃষিবীমা উন্নয়নে কৃষিবীমা প্রিমিয়ামের ওপর মূল্য সংযোজন কর এবং কৃষিবীমা থেকে অর্জিত মুনাফার ওপর কর্পোরেট করহার রহিত করা প্রয়োজন।
আট. অনলাইন ভিত্তিক বীমার প্রিমিয়ামের ওপর মূল্য সংযোজন কর রহিত করা। এ দাবির পক্ষে বলা হয়, ভিশন-২০২০ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে ইতোমধ্যে বীমা খাত অনলাইন পলিসি ইস্যু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যা গ্রাহকদের সর্বোচ্চ বীমাসেবা দেবার পথকে সুগম করবে। আইসিটি কোম্পানিগুলোর মতো অনলাইনভিত্তিক পলিসির প্রিমিয়াম থেকে অর্জিত মুনাফার ওপর কর্পোরেট কর রহিত করা হলে গ্রাহকরা উৎসাহিত হয়ে বীমাসেবা গ্রহণ করবেন।
নয়. নতুন সামাজিক পণ্যে ট্যাক্স ও ভ্যাট ছাড়। এ দাবির পক্ষে বলা হয়, বিভিন্ন সামাজিক বীমাপণ্য এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্যবীমা ম্যাক্রো অর্থনীতির উন্নয়নে এবং উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে আমাদের জীবনযাত্রার মানের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। সামাজিক জীবনযাত্রার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়কে বীমা শিল্পের আওতায় আনতে যে বিশাল বিনিয়োগের প্রয়োজন তার জন্য বীমা কোম্পানিগুলোকে এবং গ্রাহকদের কর অবকাশের অথবা ক্যাশ ইনসেনটিভের সুযোগ দেয়া উচিত।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিতি ছিলেন বিআইএ’র সহ-সভাপতি রুবিনা হামিদ ও মনিরুল ইসলাম। কার্যনির্বাহী সদস্য মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, জামাল এ নাসের, নাসির উদ্দিন পাভেল, ফারজানা চৌধুরী, আদিবা সুলতানা প্রমুখ।
এমএএস/এমএআর/জেআইএম