খেলাধুলা

বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিকের গল্পগুলো

বোলারদের জন্য হ্যাটট্রিক মানেই বিশেষ কিছু, পরপর তিন বলে তিন ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে ফেরত পাঠানো সহজ কাজ নয় মোটেও। আর সেটা যদি বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে হয়, তাহলে সেটা চলে যায় কিংবদন্তির পর্যায়ে।

Advertisement

ক্রিকেট বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত এমন কিংবদন্তিতুল্য ঘটনা ঘটেছে মাত্র ৯ বার। প্রথম তিন আসরে মেলেনি কোনো হ্যাটট্রিকের দেখা। ১৯৮৭ সালে ভারতীয় বোলার চেতন শর্মা ভাঙেন গেরো, করেন বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাটট্রিক। এরপর আবার পরবর্তী তিন বিশ্বকাপেও হ্যাটট্রিক করতে পারেননি কোনো বোলার।

১৯৯৯ সালের আসরে সাকলাইন মুশতাকের হাত ধরে ফিরে আসে বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিকের কীর্তি। তারপর থেকে প্রতি বিশ্বকাপেই অন্তত ১টি করে হ্যাটট্রিক হয়েছে। এর মধ্যে আবার ২০০৩, ২০০৭ ও ২০১১ সালের বিশ্বকাপে হয়েছে ২টি করে হ্যাটট্রিক।

বিশ্বকাপে একের অধিক হ্যাটট্রিক করার রেকর্ড শুধুমাত্র একজনেরই আছে। তিনি আর কেউ নন লঙ্কান ঝাঁকড়া চুলের বিধ্বংসী পেসার লাসিথ মালিংগা। দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি হ্যাটট্রিকের রেকর্ডও শ্রীলংকার দখলে (৩টি) এবং সবচেয়ে বেশিবার হ্যাটট্রিকের শিকার হয়েছে কেনিয়া (২ বার)।

Advertisement

এক নজরে দেখা নেয়া যাক বিশ্বকাপের সবগুলো হ্যাটট্রিকের বৃত্তান্ত :

চেতন শর্মা (ভারত বনাম নিউজিল্যান্ড, ১৯৮৭)

বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম হ্যাটট্রিক আসে এর চতুর্থ আসরে। ভারত-পাকিস্তানে অনুষ্ঠতি ৮৭'র বিশ্বকাপে ভারত বনাম নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার গ্রুপ পর্বের ম্যাচটি সাক্ষী হয় প্রথম কোন বিশ্বকাপ হ্যাটট্রিকের। সে ম্যাচে নাগপুরে ভারতীয় মিডিয়াম পেসার চেতন শর্মা পরপর তিন বলে সাজঘরে পাঠান তিন কিউই ব্যাটসম্যান কেন রাদারফোর্ড, ইয়ান স্মিথ এবং ইউইন চ্যাটফিল্ডকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে চেতন শর্মা তিনজনকেই করেন ক্লিন বোল্ড।

সাকলাইন মুশতাক (পাকিস্তান বনাম জিম্বাবুয়ে, ১৯৯৯)

Advertisement

চেতন শর্মার হ্যাটট্রিকের দীর্ঘ ১ যুগ (৩ বিশ্বকাপ) পর আবারও কোন হ্যাটট্রিক দেখার সুযোগ পায় ক্রিকেট বিশ্ব। এবারো হ্যাটট্রিক করেন আরেক এশিয়ান, পাকিস্তানি সাকলাইন মুশতাক। ওভালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সাকলাইনের প্রথম শিকার ছিলেন হেনরি ওলোঙ্গা, মঈন আলির করা স্ট্যাম্পিংটি ছিল চোখে পড়ার মতো। দ্বিতীয় শিকার অ্যাডাম হাকলকে কট বিহাইন্ড করার পর পমি বাঙ্গোয়াকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন সাকলাইন।

চামিন্দা ভাস (শ্রীলঙ্কা বনাম বাংলাদেশ, ২০০৩)

দিনটি ছিলো বিশ্ব ভালোবাসা দিবস তথা ১৪ই ফেব্রুয়ারি। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য সেদিন কোনো ভালোবাসাই রাখেননি লঙ্কান বাঁহাতি পেসার চামিন্দা ভাস। পিটারমরিজবার্গে সেদিন বিশ্ব দেখেছিল এক অনন্য কীর্তি। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইনিংসের প্রথম ৩ বলে ৩ উইকেট নেয়ার বিরল রেকর্ড করে বসেন ভাস। তার বিখ্যাত সুইং ঝড়ে একে একে সাজঘরে ফিরেছিলেন হান্নান সরকার, মোহাম্মদ আশরাফুল এবং ইহসানুল হক। সে ওভারের পঞ্চম বলে সানোয়ার হোসেনের উইকেটও নিয়েছিলেন ভাস।

ব্রেট লি (অস্ট্রেলিয়া বনাম কেনিয়া, ২০০৩)

কেনিয়ার বিপক্ষে ব্রেট লি'র হ্যাটট্রিকটি ছিল বিশ্বকাপে উপমহাদেশের বাইরে প্রথম কোন বোলারের। ভাসের হ্যাটট্রিকের ১২ দিনের মাথায় অস্ট্রেলিয়ান গতিদানবের গতির তোপে সেদিন ভেসে গিয়েছিল কেনিয়ার টপ অর্ডার। ওপেনার কেনেডি ওটিয়েনোকে বোল্ডের পর, রিকি পন্টিয়ের হাতে ধরা পড়েন ব্রিজাল প্যাটেল।হ্যাটট্রিকের শিকার ডেভিড ওবুয়া ৯৭ মাইল বেগে আসা ব্রেট লির আগুনে গোলার সামনে দাঁড়াতেই পারেননি, হয়েছিলেন সরাসরি বোল্ড।

লাসিথ মালিংগা (শ্রীলঙ্কা বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০০৭)

বিশ্বকাপের একমাত্র বোলার হিসেবে বিশ্বকাপে দুটি হ্যাটট্রিকের পাশাপাশি, ক্রিকেটের বিশ্ব আসরে ডাবল হ্যাটট্রিক তথা চার বলে আর উইকেট নেয়া একমাত্র বোলারও লঙ্কান লাসিথ মালিঙ্গা। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে সুপার এইটের ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পরপর চার বলে ৪ উইকেট নিয়ে ইতিহাসের পাতায় আলাদা জায়গা করে নেন মালিঙ্গা। দক্ষিণ আফ্রিকার তখন মাত্র দরকার ছিল ৪ রানের, হাতে ছিলো ৫ উইকেট। সে পরিস্থিতিতে আচমকাই শুরু হয় মালিঙ্গা ঝড়। পরপর দুই স্লোয়ারে সাজঘরে পাঠান শন পোলক এবং এন্ড্রু হলকে। ওভার শেষ হয়ে যাওয়ায় হ্যাটট্রিকের জন্য অপেক্ষা করতে হয়ে তার পরবর্তী ওভারের জন্য। পরের ওভারের প্রথম বলে উইকেটে থিতু হয়ে যাওয়া জ্যাক ক্যালিসকে ফেরানোর পরের বলেই আঘাত হানেন মাখায়া এনটিনির উপর। পরপর চার বলে চার উইকেট নেয়ার পর ও একবুক আক্ষেপ নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন মালিঙ্গা। কারণ সেদিন তার দল যে হেরে বসেছিল ১ উইকেটে।

কেমার রোচ (ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম নেদারল্যান্ড, ২০১১)

উপমহাদেশে হওয়া বিশ্বকাপের সবশেষ আসরে প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বোলার হিসেবে বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক করার রেকর্ড করেছিলেন কেমার রোচ। ২০১১ সালের বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের টেইল এন্ডার ধসিয়ে দেন ৩ বলেই। ৩৩১ রানের টার্গেটে নামা নেদারল্যান্ডসকে ১১৫/৭ থেকে ১১৫/১০ পরিণত করার পথে রোচ একে একে ফিরিয়েছিলেন পিটার শিলার, বার্নার্ড লুটস এবং ব্যারেন্ড ওয়েস্টডাইককে।

লাসিথ মালিংগা (শ্রীলঙ্কা বনাম কেনিয়া, ২০১১)

এটিতে যেনো ২০০৭ বিশ্বকাপের পুনরাবৃত্তিই করেন মালিঙ্গা। সেবারের মতো ২০১১তেও আলাদা আরেকটি ওভারে লেগেছিল মালিঙ্গার হ্যাট্রিক পূরণ করতে। ব্যক্তিগত সপ্তম ওভারের শেষ বলে তন্ময় মিশ্রকে প্যাভিলিয়নে পাঠানোর পর অষ্টম ওভারের প্রথম বলে পিটার ওংগোডো এবং পরের বলে শেম এঙ্গোচেকে আউট করেন মালিঙ্গা।

স্টিভেন ফিন (ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়া, ২০১৫)

বিশ্বকাপের গত আসরে প্রথম ইংলিশ বোলার হিসেবে বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক করার গৌরব অর্জন করেছিলেন স্টিভেন ফিন। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে সেদিন অস্ট্রেলিয়ার পাহাড়সম রানের চাপে দিশেহারা ইংলিশদের একমাত্র প্রাপ্তি ছিল স্টিভেন ফিনের হ্যাট্রিক। ইনিংসের শেষ ওভারে পরপর তিন বলে ব্রাড হাডিন, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল এবং মিচেল জনসনের উইকেট শিকার করে শুধু হ্যাটট্রিক ই করেননি ফিন, অজিদের ৩৫০ রানের মধ্যে বেঁধে ফেলতে রাখেন সবচেয়ে বড় ভূমিকা। যদিও ফিনের দল সেদিন হেরেছিল ১১১ রানের বিশাল ব্যবধানে।

জেপি ডুমিনি (দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম শ্রীলঙ্কা, ২০১৫)

সবচেয়ে বেশিবার হ্যাটট্রিক করা দল শ্রীলঙ্কা সে ম্যাচে নিজেই শিকার হয় হ্যাটট্রিক যাতনার। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খণ্ডকালীন স্পিনার জেপি ডুমিনির আচমকা ঘূর্নিতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কার মিডল অর্ডার। মালিঙ্গার মতো ডুমিনিরও লেগেছিল দুটি ভিন্ন ওভার। অষ্টম ওভারের শেষ বলে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজকে ফিরতি ক্যাচে আউট করে তিন উইকেটের প্রথমটি নেন ডুমিনি। পরে নবম ওভারের প্রথম বলে নুয়ান কুলাসেকারাকে ডি ককের হাতে ক্যাচে পরিণত করার পর, কুশালকে বোল্ড করে প্রথম কোনো দক্ষিণ আফ্রিকান হিসেবে বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক করেন ডুমিনি!

আরজে/এসএএস/জেআইএম