জাতীয়

রোমানাকে রেখে চলে গেলেন রাজীব

বেহুলা-লক্ষীন্দর, লাইলী-মজনু প্রেম কাহিনির চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। এখানে শুধু প্রেম-ভালোবাসা ছিল তা নয়, ছিল একজন মৃত্যুপথযাত্রীর জীবন বাঁচানোর লড়াই। নিজের কিডনি দিয়ে বাঁচাতে চেয়েছিলেন আরেকজনের প্রাণ। তবে শেষ রক্ষা আর হলো না। জীবনযুদ্ধে পরাজিত হলেন আনোয়ার হোসেন রাজীব। হার না মানা যুদ্ধে হেরে গেলেন রোমানা তাসমিন।

Advertisement

সোমবার (২০ মে) ভোর ৫টার দিকে রাজধানীর ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রাজীব (৩১) (ইন্নালিল্লাহি ওয়া লিল্লাহি রাজিউন)। এর আগে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে শুক্রবার (১৭ মে) তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণে রাজীবের সঙ্গে পরিচয় রোমানা তাসমিনের। জানতে পারেন রাজীবের দুটি কিডনিই নষ্ট। জীবনযুদ্ধে মৃত্যুপথযাত্রী রাজীবকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে হয়। কথা ও দেখার ফাঁকে রাজীবকে ভালো লাগে রোমানার। ইচ্ছা জাগে রাজীবের পাশে দাঁড়ানোর, নতুন জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার।

রাজীবের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসেন জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের মেয়ে রোমানা তাসমিন। প্রস্তাব দেন একটি কিডনি দান করার। রাজীব ও তার পরিবারের কাছে অবিশ্বাস্য লাগলেও পেশায় প্যারামেডিক রোমানা সত্যি বাঁচাতে চান রাজীবকে। আইনি জটিলতা থাকায় রাজীবকে বিয়ে করেন তিনি। ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি দু’জনে ঘর বাঁধেন নতুন জীবনের সন্ধানে।

Advertisement

২০০২ সালে লৌহজং পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ২০০৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এমএ শেষ করেন রাজীব। এরপর পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালসে সিনিয়র অফিসার হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন। ২০১৪ সালের ১২ নভেম্বরে তার কিডনি রোগে ধরা পড়ে।

রোমানাকে পেয়ে রাজীব স্বপ্ন দেখেন নতুন জীবনের। নতুনভাবে বাঁচার আশা জাগে মনে। তবে এত কিছুর পরও অর্থাভাবে আটকে যায় রাজীবের কিডনি প্রতিস্থাপন। এদিকে রোমানা তাসমিনের এমন মানবিক সিদ্ধান্তের খবর ছড়িয়ে পরে চারদিকে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও পত্রিকায় তাদের নিয়ে সংবাদ প্রচার হওয়ায় এগিয়ে আসেন অনেকে।

মুন্সীগঞ্জ-২ (লৌহজং-টঙ্গিবাড়ী) আসনের তৎকালীন এমপি অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তি, সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসেন। হাত বাড়িয়ে দেন সাহায্যের। প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করে রাজীবকে নিয়ে ২০১৭ সালের ৭ আগস্ট ভারত যান রোমানা। তবে কিছু শারীরিক জটিলতার কারণে রাজীবের শরীরে কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। সেখানে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষ দেশে ফিরে আসেন রাজীব-রোমানা।

দেশে ফিরে চিকিৎসকদের পরামর্শে চলে রাজীবের চিকিৎসা। ডায়ালাইসিসের পাশাপাশি নিয়মিত চিকিৎসায় পূর্বে দেখা দেয়া শারীরিক নানা জটিলতা থেকে কেটে ওঠেন রাজীব। এরপর আবারও ভারতে কিডনি প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করতে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন রোমানা তাসমিন। তবে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় না হওয়ায় ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করে জীবন যুদ্ধে টিকে ছিলেন রাজীব।

Advertisement

রাজধানীর কেরানীগঞ্জের জিনজিরায় সাজেদা হাসপাতালে চাকরি করা প্যারামেডিক রোমানা হাসপাতালের কাছেই বাসা নিয়ে বসবাস শুরু করেন। সম্প্রতি রাজীব-রোমানা দম্পতি মিলে বাসার নিচেই একটি ফার্মেসি দেন। সেখানে রাজীবের পাশাপাশি অফিস শেষে রোমানাও সময় দিতেন।

এদিকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করলেও গত শুক্রবার (১৭ মে) রাজীবের স্বাস্থ্য খারাপ হলে সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শনিবার (১৮ মে) রোমানার সাথে কথা হলে জানান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে রাজীবের শরীরে হেপাটাইসিস-সি ভাইরাস ও নিউমোনিয়া ধরা পড়েছে। বর্তমানে ও হাসপাতালেই ভর্তি রয়েছে।

টানা তিনদিন চিকিৎসা চলার পর রোববার (১৯ মে) দিবাগত রাতে অবস্থা আরও খারাপ হলে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। সেখানেই সোমবার (২০ মে) ভোর ৫টার দিকে মারা যান রাজীব। থেমে যায় মানবিক প্রেমিকা রোমানা তাসমিনের যুদ্ধ।

সোমবার ইফতারের পর রাত ৮টার দিকে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে রাজীবের নিথর দেহ দাফন করা হয়। রাজীবের দাফনের খবর জানতে ফোন করা হলে ফোনের ওপাশ থেকে রোমানার কান্না যেন থামছিলই না। রাজীবের জন্য দোয়া চেয়ে রেখে দিলেন ফোন।

আরএস/এমএস