শচীন, সৌরভ, শেবাগ, রাহুল দ্রাবিড়দের নিয়ে শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপ। বিশ্বকাপ শিরোপা জয়েরও অন্যতম দাবিদার। সত্যিকারার্থেই ২০০৭ বিশ্বকাপের টপ ফেবারিটের তালিকায় ছিলো তখনকার ভারত।
Advertisement
কিন্তু নিয়তি হয়তো সে বিশ্বকাপে ভারতের জন্য করুণ দুর্ভাগ্যই লিখে রেখেছিল। ভারতের শুরুটাই হয়েছিল বাংলাদেশের কাছে শোচনীয়ভাবে হেরে। বিশ্বকাপ শুরুর আগে ভারতীয় ওপেনার বিরেন্দর শেবাগ বাংলাদেশ নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যকরে মন্তব্য করেছিলেন। মাঠে নেমে সেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের দারুণ জবাব দিয়েছিলেন হাবিবুল বাশার অ্যান্ড কোং।
বাংলাদেশের বিশ্বকাপ স্মৃতি যখন আপনি রোমন্থন করতে যাবেন তখন চোখের সামনে পোর্ট অব স্পেন ভেসে উঠবেই। গোটা ক্রিকেট দুনিয়া অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছিল, কিভাবে বাংলাদেশের কয়েকজন তরুণের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছিল পরাক্রমশালী ভারত। সেই ধাক্কা আর সামলে উঠতে পারেনি রাহুল দ্রাবিড়ের দল। শেষ ম্যাচে শ্রীলংকার কাছে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিশ্বকাপকে বিদায় বলতে হয় তাদের।
ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশ উঠে যায় সুপার এইটে। ২০০৭ বিশ্বকাপ প্রসঙ্গ এলে স্বয়ং শচিন টেন্ডুলকারও স্বীকার করে নেন যে, তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে সবচেয়ে জঘণ্য ছিল সেই বিশ্বকাপ। এটা মূলতঃ করেছে বাংলাদেশই। হাবিবুল বাশারের দলের কাছে না হারলে তো ভারতকে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায়ই নিতে হতো না।
Advertisement
বাংলাদেশের কাছে হেরে দেশে ফিরেও শান্তিতে থাকতে পারেননি ভারতীয় ক্রিকেট দল। ঢিল পড়েছে দ্রাবিড়ের বাড়িতে। রাস্তায় পোড়ানো হয়েছে সৌরভ-শেবাগদের কুশপুত্তলিকা। হামলা হয়েছে মহেন্দ্র সিং ধোনির বাড়িতেও। তাদের ভুগতে হয়েছে নিরাপত্তাহীনতায়।
উল্টো চিত্র ছিল বাংলাদেশে। ক্রিকেট দুনিয়া তখন তামিম-মাশরাফি বন্দনায় মুখর। সে সময়ের বর্ণনা দিয়ে হাবিবুল বাশার একবার বলেছিলে, ‘সুপার এইটে আমরা এক ভেন্যু থেকে যখন্য অন্য ভেন্যুতে গিয়েছি সবার কাছ থেকে আলাদা শ্রদ্ধা পেয়েছি। সবাই আমাদের নিয়ে আলোচনা করেছে। মনে হয়েছে রাতারাতি আমাদের মর্যাদা বেড়ে গেল কয়েকগুণ।’
কুইন্স পার্ক ওভালে বাংলাদেশ খেলতে নামে একটা মর্মবেদনা নিয়ে। কারণ, তার আগে মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন মাশরাফিদের সতীর্থ মানজারুল রানা। যে কারণে ম্যাচ শুরুর আগে এক মিনিট নীরবতা পালন করে বাংলাদেশ-ভারত দুই দল। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররাও মাঠে নেমেছিল রানার মৃত্যুর শোককে শক্তিতে পরিণত করে।
শুরুটা হয়েছিল দ্রাবিড়ের জয় দিয়েই। টস জিতে তিনি রান পাহাড়ে বাংলাদেশ দলকে চাপা দিতে চেয়েছিলেন! বেছে নিলেন ব্যাটিং। দ্রাবিড়ের সিদ্ধান্তকে বুমেরাং করে নিজে পক্ষে টেনে নিয়ে আসতে খুব বেশি সময় নেননি মাশরাফি-রাজ্জাকরা। স্কোরবোর্ডে ৬ রান উঠতেই মাশরাফির স্বপ্নের এক ডেলিভেরিতে বোল্ড বিরেন্দর শেবাগ (২)।
Advertisement
সপ্তম ওভারে রবিন উথাপ্পাকে (৯) ফিরিয়ে রীতিমতো উড়েছেন মাশরাফি। ৪০ রানের মাথায় টেন্ডুলকারকে (৭) মুশফিকের ক্যাচে পরিণত করেন রাজ্জাক। এরপর আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি ভারত। করতে পারলো মাত্র ১৯১ রান। যা একটু লড়াই করেছেন সৌরভ গাঙ্গুলি (৬৬) এবং যুবরাজ সিং (৪৭)। মাশরাফি ৯.৩ ওভারে ৩৮ রান দিয়ে নেন একাই ৪ উইকেট। যার মধ্যে ছিল ২টি মেডেনও। রফিক ৩৫ এবং রাজ্জাক ৩৮ রান দিয়ে পেয়েছিলেন ৩টি করে উইকেট।
১৯২ রান তাড়া করতে নেমে ভয়ডরহীন সব শর্ট উপহার দিয়েছিলেন ১৭ বছরের তামিম ইকবাল। সবচেয়ে বেশি ঝড়টা গেছে জহির খানের ওপর দিয়ে। ৫৩ বলে সাত চার, এক ছক্কায় ৫১ রান করে তামিম জানান দেন তার আগমনী বার্তা। কম যাননি মুশফিকুর রহীম এবং সাকিব আল হাসানও।
কেন খালেদ মাসুদ পাইলটের জায়গায় একজন তরুণ মুশফিককে নেয়া হলো দলে? এ প্রশ্ন উঠেছিল চারদিকে। কিন্তু বিশ্বকাপে গিয়ে নির্বাচকদের আস্থার দারুণ প্রতিদান দেন মুশফিক। ভারতের বিপক্ষে ঐতিহাসিক ম্যাচে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়েন তিনি। ১০৭ বলে মুশফিকের ৫৬ রানের ইনিংসে প্রতিপক্ষ অধিনায়ক দ্রাবিড়কেও মুগ্ধ করেছিল।
শুধু তা-ই নয়, ম্যাচ শেষে ভারত অধিনায়ক তাকে একটা ব্যাটও উপহার দিয়েছিলেন। ১০ ওভার বল করে ৪৪ রান দেওয়া সাকিব ব্যাট হাতে সেদিন করেছিলেন ৮৬ বলে ৫৩ রান। তাতেই বাংলাদেশ ৯ বল হাতে রেখে ৫ উইকেট হারিয়ে জয়ের বন্দরে নোঙর ফেলেছিল। দুর্দান্ত বোলিং করে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতেন মাশরাফি বিন মর্তুজা।
ভারত : ১৯১/১০, ৪৯.৩ ওভার (সৌরভ ৬৬, যুবরাজ ৪৭, জহির ১৫*, মুনাফ ১৫, দ্রাবিড় ১৪, উথাপ্পা ৯, টেন্ডুলকার ৭, শেবাগ ২, ধোনি ০, হরভজন ০, আগারকার ০; মাশরাফি ৩৮/৪, রফিক ৩৫/৩, রাজ্জাক ৩৮/৩)।
বাংলাদেশ: ১৯২/৫, ৪৮.৩ ওভার (মুশফিক ৫৬*, সাকিব ৫৩, তামিম ৫১, আশরাফুল ৮*, আফতাব ৮, শাহরিয়ার ২, হাবিবুল ১; শেবাগ ১৭/২, মুনাফ ৩৯/২, জহির ৪১/১)।
ফল: বাংলাদেশ ৫ উইকেটে জয়ী।ম্যান অব দ্য ম্যাচ: মাশরাফি বিন মর্তুজা।
আইএইচএস/এমএস