ঘূর্নিঝড় ফণীর পর থেকেই রহস্যময় বাঘ আতঙ্কে রয়েছেন সুন্দরবন সংলগ্ন বরগুনার তালতলীবাসী। প্রতি রাতেই কোনো না কোনো বাড়িতে হানা দিচ্ছে বাঘ। ইতোমধ্যে কয়েকটি ছোট গরু, বাছুর ও ছাগল আহত হয়েছে এবং বাঘের শিকারে পরিণত হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কেউ স্বচক্ষে বাঘ দেখেননি।
Advertisement
এলাকাবাসীরা জানান গত ৪ মে প্রলয়ঙ্করী ঝড় ফণী আঘাত হানার পর থেকেই এলাকায় দেখা দিয়েছে বাঘের উপদ্রব। বিগত কয়েক দিনে বাঘ তালতলী এলাকায় গৃহপালিত পশুর উপর বহুবার আক্রমণ চালিয়েছে।
প্রথম সেই বাঘ আক্রমণ চালায় মরানিদ্রা সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয় সংলগ্ন লালমিয়া ফরাজীর একটি ছোট বাছুরের উপর। রাতে সবার অজান্তে বাঘ গোয়ালে আক্রমণ করে ছোট একটি বাছুর টেনে নিয়ে যায়। পরের দিন সকালে বাড়ির লোকজন পাশের মাঠে সেই বাছুরের আধা খাওয়া দেহ দেখতে পান। এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে গ্রামের লোকজন বাছুরের অবশিষ্ট দেহ দেখে অনুমান করেন হয়তো বাঘ এমন কাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে। ফলে সুন্দরবন সংলগ্ন বলেশ্বর নদীর পূর্ব পাড়ের তালতলীর এলাকায় বাঘের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে প্রায় প্রতি রাতেই গ্রামের কোনো না কোনো বাড়িতে হানা দিচ্ছে বাঘ। ইতোমধ্যে কয়েকটি ছোট গরু, বাছুর ও ছাগল বাঘের হামলার শিকার হয়েছে।
এলাকাবাসীর ধারণা ঘূর্ণিঝড় ফণীর তোড়ে সুন্দরবন থেকে কোনো বাঘ তালতলীতে ভেসে আসতে পারে। এলাকাবাসী বিষয়টি নিকটস্থ ট্যাংরাগিরি বন অফিসে জানিয়েছেন।
Advertisement
ট্যাংরাগিরি বন অফিসের কর্মকর্তা মো. জাহিদ জানান, তিনি এই ঘটনা সম্পর্কে অবগত আছেন ও নিজেও বিষয়টি তদন্ত করছেন। তবে গ্রামবাসী বা বন কর্মকর্তা কেউ বাঘের উপস্থিতির বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি।
এদিকে গবাদিপশুর উপর বাঘের আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন তালতলীর লোকজন। বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে গ্রামের মানুষ রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন। বাঘের ভয়ে গ্রামের নারী, বৃদ্ধ, শিশুরা সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না।
সুন্দরবনের আদি প্রত্নতত্ব ও বাঘ গবেষক ইসমে আজম জাগো নিউজকে জানান, তালতলীর বাঘ আতঙ্কের খবরে সরেজমিনে গিয়ে সেখানে বিগত কয়েক দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনায় বাঘের উপস্থিতির উল্লেখযোগ্য কোনো আলামত পাইনি। তালতলীর আক্রান্ত গবাদিপশুগুলোর দেহে নখের আঁচড় পর্যবেক্ষণে তা বাঘের বলে মনে হয়নি। ঘটনাস্থলে পাওয়া প্রাণিটির পায়ের ছাপ আকারে মেছো বিড়ালের পায়ের মতো। তাছাড়া সুন্দরবন ও ঘটনাস্থলের দূরত্ব বিবেচনায় বাঘের এতো দূর নদীপথ পাড়ি দিয়ে আসা স্বাভাবিক নয়, কেননা সুন্দরবন থেকে পূর্বে তালতলীর নিকটতম দূরত্ব অন্তত প্রায় ১৪ থেকে ১২ কিলোমিটার। এমনকি এই অঞ্চলে এমন কোনো বন নেই যেখানে বাঘের মত বড় একটি প্রাণি দিনের বেলা লুকিয়ে থাকতে পারে।
এদিকে প্রথম ঘটনায় যে বাছুরটির আধা খাওয়া দেহ পাওয়া গেছে তা কোনোভাবেই একটি মেছো বিড়ালের একার পক্ষে এক রাতেই সাবাড় করা সম্ভব নয়। তবে মেছো বিড়ালের পক্ষে গরুর ছোট বাছুর শিকারের এমন ঘটনার প্রমাণ সিলেট-মৌলভীবাজারের হাওর অঞ্চলে এর আগেও পাওয়া গেলেও এমন ধারাবাহিক গবাদিপশুর উপর আক্রমণ সচরাচর হয় না। ফলে বিষয়টি আশঙ্কাজনক। তাছাড়া মেছো বিড়ালের পক্ষে গরুর বাছুরের হাড় চিবিয়ে খাওয়া সম্ভব নয়। হতে পারে বিড়ালের শিকারের পরে ঐ অঞ্চলের শিয়াল বা কুকুর পরবর্তীতে সকালের আগেই মরা বাছুরের বেশিরভাগ অংশ খেয়েছে। আবার এমন ধারাবাহিক আক্রমণ গ্রামের বেওয়ারিশ দলবদ্ধ কুকুর বা শেয়ালেরও হতে পারে। তবে আতঙ্ক ও রহস্যের এখানেই শেষ নয়।
Advertisement
অপরদিকে বাঘের উপদ্রবের কয়েক দিন বাদেই স্থানীয় লোকজন গ্রামীণ বনে বাঘ সদৃশ একটি প্রাণি দেখতে পেয়ে ধাওয়া দিলে সেটি দৌঁড়ে ঝোপঝাড়ে হারিয়ে যায়। পরে খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে বিড়ালের মত দেখতে একটি প্রাণিকে ঝোপের আড়ালে বিশ্রাম নিতে দেখে গ্রামবাসী মোবাইলে ছবি তুলে রাখে। যা আরও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। ছবিতে প্রাণীটির অবস্থানগত দূরত্ব, কম রেজুলেশন ও মুখ দেখা না যাওয়ায় শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রাণিটি গড়নে বিড়াল সদৃশ হলেও সাধারণ বন বিড়াল বা মেছো বিড়াল নয়।
স্থানীয়দের মতে প্রাণিটি আকারে কুকুরের সমান কিংবা তার থেকেও বড়, তবে কুকুর নয়। আবার ছবির এই প্রাণিটিই যে বিগত ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী তাও নিশ্চিত হওয়া যায় না। ফলে এলাকায় বাঘ আতঙ্ক রয়েই গেছে। তাই বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
রিপন দে/এমএমজেড/এমএস