মতামত

‘আর করবো না ধান চাষ, দেখবো তোরা কী খাস’

কোনো বছর আগাম বন্যা, কোনো বছর হঠাৎ বৃষ্টি বা ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যায় মাঠ। বিনা মেঘে বজ্রপাত হয় কৃষকের মাথায়। ফণীর হালকা ছোঁয়া বাদ দিলে, এবার প্রকৃতি ছিল কৃষকের পক্ষে। মাঠজুড়ে তাই সোনালি ধানের হাসি। হিসাব বলছে, এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হবে, হয়েছেও। মাঠে হাসি থাকলেও কৃষকের মুখে তার ছোঁয়া নেই। মাঠজুড়ে সোনালি ফসলের ঢেউ আর কৃষকের বুকজুড়ে হাহাকার। প্রতি বছর এই সময়ে পত্রিকার পাতা ওল্টালেই দেখা যায়, ‘ধানের দাম না পেয়ে কৃষক হতাশ’, ‘এক মণ ধানে এক কেজি গরুর মাংস’, ‘দুই মণ ধানে একটা ইলিশমাছ। ’

Advertisement

এ ধরনের সংবাদ পত্রিকার ভেতরের পাতায় বা পেছনের পাতায় ছাপা হয়। আগে ‘পানির দরে ধান’ এ ধরনের শিরোনাম দেখা গেলেও এখন তা অপ্রাসঙ্গিক। কারণ কখনো কখনো ধানের দাম বোতলজাত পানির চেয়েও কম। এই সংবাদগুলোর কৌতুকটাই আমাদের চোখে পড়ে, পেছনের কান্নাটা আমরা দেখতে পাই না। তবে এবার সংবাদ শিরোনামে নতুনত্ব এসেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ধানের দাম না পেয়ে ক্ষুব্ধ কৃষক ক্ষেতে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। পাকা ধানে মই দেয়ার কথা শুনেছি, দেখিনি কখনো। সাধারণত মানুষ শত্রুর পাকা ধানে মই দেয়। এবার দেখলাম, কৃষক নিজের পাকা ধানে নিজেই মই দিচ্ছে। তবে এই হতাশার পেছনে আশার কথাও আছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাশ্রমে কৃষকদের ধান কেটে দিচ্ছে। ঢাকায়ও শিক্ষার্থীরা ধানের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে রাস্তায় নেমেছে।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। বাংলাদেশের অগ্রগতি, সাফল্যের বড় কৃতিত্ব কৃষকদের। তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল ফলান বলেই আমরা পেটপুড়ে খেয়ে বড় বড় বক্তৃতা দিতে পারি, শহরে বসে রাজা-উজির মারতে পারি। মাঠের পর মাঠভর্তি ধানের ক্ষেতে সোনালি ঢেউ দেখে আমরা আপ্লুত হই। দেশাত্মবোধক গান গাই। কিন্তু ভেবে দেখি না, এই সোনালি ঢেউ কৃষকের কতটা হাহাকার বয়ে বেড়ায়। বাংলাদেশে সবকিছুর দাম বাড়ে, খালি ধানের দাম কমে যায়। ধানের দাম আসলে খুব স্পর্শকাতর ইস্যু। ধানের দাম বেশি বেড়ে গেলে অস্থিরতা তৈরি হবে সারাদেশে। আর ধানের দাম কমে গেলে মরে যাবে কৃষক। এ এক অভেদ্য চক্র। এই ভারসাম্যটা ধরে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই সরকারের দায়িত্ব বেশি। সময়মত সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। ধানের দাম বেড়ে গেলে সরকার আমদানি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। আবার দাম কমে গেলেও সরকারকেই ন্যায্যমূল্যে ধান কিনে কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সময়মত চাল আমদানি বন্ধ করতে হবে।

এটুকু সুরক্ষা না দিলে কৃষকরা বাঁচবে কীভাবে? ধান ওঠার মৌসুমটা তো সবার জানা। তাহলে ধানের দাম পড়ে গেলে আমরা হৈচৈ করি। আগে থেকে ব্যবস্থা নেই না কেন? এখন এই মধ্য মে’তে এসে কেন সরকারকে চাল আমদানি বন্ধ করার কথা ভাবতে হবে? এই ভাবনাটা আমরা আগে ভাবিনি কেন? প্রকৃতির সাথে কৃষকরা লড়তে পারে। কিন্তু বাজারের কূটকৌশলের সাথে পারে না, মজুতদারদের সাথে পারে না। এখানেই সরকারের দায়িত্ব। সরকারকে সহমর্মিতা নিয়ে কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে হবে। অবশ্য সরকার দাঁড়িয়েছে। এবার বোরো মৌসুমে ১২ লাখ ৫০ হাজার টন ধান-চাল কেনার কথা ছিল। কথা ছিল ২৫ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে অভিযান শুরু করা যায়নি। কিছুটা দেরিতে হলেও ইতিমধ্যে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। সরকার নির্ধারিত মূল্যে এই পুরোটাই যদি সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে কেনা যেতো, তাহলে সত্যি সত্যি তাদের মুখে হাসি ফুটতো। কিন্তু এখানেই মার খেয়ে যায় কৃষকরা। সরকারের গুদাম পর্যন্ত যেতে পারে না প্রান্তিক কৃষকরা। চাতাল মালিক আর মধ্যস্বত্বভোগীরা খেয়ে নেয় লাভের গুড়টুকু।

Advertisement

তবে ন্যায্যমূল্যে ধান-চাল সংগ্রহ করার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, মমতা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে এই মমতার বড় অভাব। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, সরকারকে বিব্রত করার জন্য নাকি পরিকল্পিতভাবে কৃষককে দিয়ে পাকা ধানে আগুন দেয়া হয়েছে। যদি পরিকল্পিতভাবে ধানে আগুন দেয়া হয়ও ধানের উৎপাদন খরচের চেয়ে যে ধানের দাম অনেক কম, এটা তো মিথ্যা নয়। ধানের ভাণ্ডার নওগাঁর গ্রাম থেকে উঠে আসা সাধন চন্দ্র মজুমদার, যিনি ইউপি চেয়ারম্যান থেকে ধাপে ধাপে মন্ত্রী হয়েছেন, তিনিও যদি অন্তর থেকে কৃষকদের দুঃখটা না বোঝেন; তাহলে আর কে বুঝবেন? সরকারি দলের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ফেসবুকে কৃষকদের সাথে মশকরা না করতে খাদ্যমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

ধানের দাম কমে যাওয়ার সুফল যদি সাধারণ মানুষ পেতো, তাও না হয় সান্ত্বনা মিলতো। কিন্তু ধানের কম দামের পুরো মুনাফাটা যায় মজুতদারের পকেটে। মৌসুমের শুরুতে যখন ধানের অঢেল সরবরাহ, তখন পড়ে যায় দাম। কষ্ট করে কয়েক দিন রাখতে পারলেই ভালো দাম পাওয়া সম্ভব। কিন্তু প্রান্তিক কৃষকরা নানারকমের ঋণ নিয়ে ফসল ফলান। তাই তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না, ধান ধরে রেখে লাভ করার। আর ধান রাখার মত জায়গাও থাকে না ছোট কৃষকের। তাই যত দ্রুত সম্ভব, সম্ভব হলে মাঠ থেকেই ধান বিক্রি করে দিতে হয় তাদের।

মজুতদাররা অল্প দামে ধান কিনে বেশি দামে বিক্রি করে। তাই লাভটা না যায় কৃষকের পকেটে, না যায় সাধারণ মানুষের পেটে। আরো পোক্ত হয় মজুতদারের সিন্দুক। বীজ সংগ্রহ, বীজতলা তৈরি, চারা রোপণ, সেচ, সার- ধান চাষের ধাপে ধাপে টাকা লাগে। সরকার সেচ, সারে ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের পাশে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা যথেষ্ট হয় না। পুরো মারটা যায় কৃষকের ওপর দিয়ে। এবারও কৃষকদের ধান বেঁচতে হচ্ছে উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কম দামে। আর উৎপাদন খরচ বিবেচনার সময় কৃষক এবং তার পরিবারের সদস্যদের শ্রমের মূল্য কিন্তু ধরা হয় না। বন্যায় ধান ভেসে গেলেও কৃষকের ক্ষতি। ধানের বাম্পার ফলন হলেও কৃষকেরই ক্ষতি।

বাংলাদেশের জমি কম, মানুষ বেশি। আমাদের বিজ্ঞানীরা নানা জাতের উচ্চফলনশীল ধান আবিষ্কার করেছেন। আর কৃষকরা মাঠে তা ফলিয়ে নিশ্চিত করছেন অতি জরুরি খাদ্যনিরাপত্তা। মানুষের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধানের উৎপাদন। ব্যাপারটি এত অনায়াস আর অবশ্যম্ভাবী মনে হয় যে আমরা ধরেই নিয়েছি বছরের পর তাদের পেটে লাথি মারবো, প্রান্তিক কৃষক আরো প্রান্তে চলে যাবে, আর আমরা আরাম করে খাবো। কিন্তু কৃতজ্ঞতার ঢেঁকুরটুকুও তুলবো না। আমরা শহরের মানুষেরা ‘এক মণ ধানে এক কেজি গরুর মাংস’ পড়ে পত্রিকাটি পাশে রেখে অনায়াসে উঠে যাই। ভাবিই না, কীভাবে কৃষকদের বাঁচানো যাবে, কীভাবে বাম্পার ফলনের সুফলটা, মাঠের সোনালি ঢেউটা তাদের মুখেও ছড়িয়ে দেয়া যাবে। কীভাবে মজুদতার আর মধ্যস্বত্বভোগীদের কবল থেকে লাভের অঙ্কটা কৃষকের জেবে পুড়ে দিতে পারবো। পেটে খেলে পিঠে সয়, এই প্রবাদটা যে কৃষকের ক্ষেত্রেও সত্যি, এটা আমরা বুঝতেই চাই না। যেন কৃষকদের পেট পিঠ কিছুই নেই, থাকতে নেই।

Advertisement

আমি খালি অবাক হই, বারবার পুঁজি খোয়ানোর পরও তারা টিকে থাকে কীভাবে? তারপরও কৃষকরা বছরের পর বছর ফসল ফলান কেন? কারণ তাদের আর কিছু করার নেই। এক বছর কিছুটা লাভের মুখ দেখলে সেটা আকড়ে ধরেই স্বপ্ন দেখেন আগামী বছরের। কিন্তু পরের বছরই আবার ধাক্কা খায়। ফলে তারা কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। আমি ঠিক জানি না, আমরাই এই চক্রটা এভাবে সাজিয়ে রেখেছি, যে কৃষক খালি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের পেটের ভাত জোগাড় করবে, আর আমরা শহুরে বাবুরা খালি তাদের পেটে লাথি মেরে যাবো? বারবার এত ধাক্কা খাওয়ার পরও যে তারা ফসল ফলান, এ জন্য তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা। তাদের অদম্য মনোবলকে আমারনতমস্তক কুর্ণিশ।

একবার বন্যায় ফসল তলিয়ে যাবে, একবার লসে ধান বেঁচতে হবে। তাহলে এই কৃষকরা বেঁচে থাকবে কীভাবে? ধান ফলাবে কেন? আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, ধান চাষটা কৃষকদের নেশার মত। নিশ্চিত লোকসান জেনেও অনেকে যেমন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। কৃষকরা তেমনি নিশ্চিত লোকসান জেনেও ধান চাষ করে। ভাবি আর ভয় পাই, কৃষকদের ধান চাষের নেশাটা যদি টুটে যায়; আমরা খাবো কী? এবার শুনছি অনেক এলাকায় কৃষক ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। আমরা কিন্তু তাদের বাধ্য করছি আগ্রহ হারাতে। তারা যদি ধান ফেলে তামাক চাষ করে, আমরা আবার তাদের গালি দেবো।

এবার ফেসবুকে কৃষকদের একটি স্লোগান দেখছি, ‘‘আর করবো না ধান চাষ, দেখবো তোরা কী খাস?’। তেমন দিন এলে কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর আমাদের গলায় আটকে যাবে। তার আগেই সরকারকে কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সময়মত ন্যায্যমূল্যে পর্যাপ্ত ধান চাল সংগ্রহ করতে হবে। আর সরকারের টাকাটা যাতে কৃষকের পকেটে যায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম