ঠিক বলে কয়ে না হলেও, আজকাল বাংলাদেশ দল ক্রিকেটের বড় শক্তিগুলোকে প্রায়ই হারায়। এই যেমন ওয়েস্ট ইন্ডিজ শেষ ছয়বারে টাইগারদের কাছে হেরেছে পাঁচবার।
Advertisement
কথায় বলে, রোম নগরী একদিনে তৈরি হয়নি। আজকের অবস্থায়ও টিম বাংলাদেশ একদিনে আসেনি। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে গেলো অনেকটা কম্পিত হৃদয়ে, দ্বিধা আড়ষ্টতায় পা ফেলে। তবুও সে বছরের ৩১ মে নর্দাম্পটনে পাকিস্তানের মতো বিশ্বসেরা (সেবারের ফাইনালিস্ট) দলকে হারিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে তাক লাগিয়েছিল বুলবুল, আকরাম, বিদ্যুৎ, দুর্জয়, সুজনদের দল।
শুধু বিশ্বকাপ নয়, একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও কোনো বড় দলের বিপক্ষে সেটাই ছিলো বাংলাদেশের প্রথম জয়। সেই জয়ের রূপকার ছিলেন খালেদ মাহমুদ সুজন। ব্যাট হাতে ২৭ রান এবং বল হাতে ৩ উইকেট নিয়ে তিনিই ছিলেন ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়।
কুড়ি বছর পর এসে খালেদ মাহমুদ সুজন পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই ম্যাচের ব্যাপারে অনেক অজানা কথা জানিয়েছেন জাগোনিউজকে। প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, শোয়েব আখতার, সাকলাইন মুশতাকদের বোলিং তোপ সামলে এবং সাঈদ আনোয়ার, শহিদ আফ্রিদি, ইনজামাম-উল হক, সেলিম মালিকদের মতো বিশ্বমানের ব্যাটসম্যানদের আটকে রেখে ৬২ রানের জয়ের গল্পটা শুনিয়েছেন সুজন।
Advertisement
পাশাপাশি উঠে এসেছে কোচ গর্ডন গ্রিনিজের বিদায়ের অন্যতম প্রধান কারণও। পাকিস্তানের সঙ্গে সেই ঐতিহাসিক বিজয়ের আগের দিন আনুষ্ঠানিকভাবে বরখাস্ত হয়েছিলেন তখনকার বাংলাদেশের কোচ, ক্যারিবীয় গ্রেট গর্ডন গ্রিনিজ। সুজনের কথায় উঠে এসেছে গ্রিনিজের বিদায় এবং প্রায় সাড়ে তিন বছরের কোচিংয়ে প্রথম বড় জয়ের শুভক্ষণে দলের সঙ্গে থাকতে না পারার হাহাকার।
বিশ বছর এবারও দলের সঙ্গেই থাকছেন খালেদ মাহমুদ। বিশ্বকাপ মিশনে টাইগারদের ম্যানেজারের গুরুদায়িত্ব বর্তেছে তার ওপর। দেশ ছাড়ার আগে জাগোনিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন সামগ্রিক বিষয়ে। সেটি তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য:
জাগোনিউজ : বাংলাদেশ প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েই পাকিস্তানকে হারাবে। আর আপনি হবেন ম্যান অফ দ্য ম্যাচ, কখনো কি এমন স্বপ্ন দেখেছিলেন? আদৌ মাথায় এমন চিন্তা এসেছিল কোনদিন?
খালেদ মাহমুদ সুজন : সত্যি কথা বলতে কি, ঠিক এমননটা ভাবিনি। কি করে ভাবি বলুন! বিশ্বকাপে আমরা তখন নতুন দল। প্রথমবার গেছি ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসরে খেলতে। তাই এতদুর পর্যন্ত চিন্তা করিনি। করার কথাও না। আসলে আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল কাছাকাছি শক্তির স্কটল্যান্ডকে হারানো, এবং আসল কথা হলো ওই একটি ম্যাচ জেতাই ছিল প্রথম বিশ্বকাপে আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। বলতে পারেন স্কটল্যান্ডের সাথে একটি ম্যাচ জয়ের স্বপ্ন নিয়েই বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিলাম আমরা।
Advertisement
যদিও বয়সের বিচারে এবং ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা চিন্তা করলে আমাদের দলটি কিন্তু মোটেও অনভিজ্ঞ এবং আনকোরা ছিল না। মোটামুটি পরিণত আর অভিজ্ঞ এক দলই ছিল। লাইনআপে নান্নু ভাই, আকরাম ভাই, বুলবুল ভাই, মনি ভাইয়ের মত সিনিয়র প্লেয়াররা ছিলেন। যারা ওই বিশ্বকাপের বহু আগে থেকে ক্রিকেটের সাথে নিবিঢ়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন। দীর্ঘ দিন বিভিন্ন লেভেলে প্রচুর টুর্নামেন্ট ও ম্যাচ খেলেছেন। আমি দুর্জয়, রফিক, পাইলট আমরাও অনেক দিন ধরে ঢাকা লিগ খেলে হাত পাকিয়ে ফেলেছি।
কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না খেলাটা ছিল বিশ্বকাপে! বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর। যার মান, আকর্ষণ, প্রতিদ্বন্দ্বীতা আর প্রতিপক্ষ দল সবকিছুই বিশ্বমানের। এককথায় ডিফারেন্ট।
আমাদের সবারই সেটা ছিল প্রথম বিশ্বকাপ। এমনিতে যত দীর্ঘ সময়ই অন্য লেভেলে ক্রিকেট খেলি না কেন, ওয়ার্ল্ডকাপে আমরা সেবার সবাই ছিলাম নতুন। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো বিশ্বকাপে যে লেভেলে খেলা হয় আমরা তখনো ঐ লেভেলে পৌঁছাইনি। আমরা আসলে অত সাত-পাঁচ ভেবে খেলতেও যাইনি। আমাদের মূল লক্ষ্যই ছিল স্কটল্যান্ড ম্যাচ।
স্কটিশদের হারানোই ছিল টার্গেট। সবাই স্কটিশদের সাথে ম্যাচ নিয়েই উৎসাহী ছিল। বলা যায় আমরা সবাই ওই ম্যাচের দিকেই ফোকাসড ছিলাম। স্কটিশদের হারানোর পর আমরা খানিক রিলাক্সড হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের মনে হচ্ছিল যে লক্ষ্য নিয়ে বিশ্বকাপে এসেছিলাম, তা তো পূর্ণ হয়ে গেছে। একটা ম্যাচ জেতার দরকার ছিল, জিতেছি।
এরপর আমরা পাকিস্তানকে হারাবো, সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করবো- এমনটা চিন্তায়ও আসেনি। তবে মাঠে নেমে আমরা সেই অভাবনীয় কাজটিই করে ফেললাম। পাকিস্তানিদের হারানো ছিল সেবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় অঘটন। কেউ কল্পনাও করেনি পাকিস্তানের মত বিশ্বশক্তির সাথে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে আমরা জিতে যাবো।
জাগোনিউজ : আচ্ছা আগে জয়ের কথা না ভাবলেও মাঠে নেমে কি হলো, ম্যাচের চালচিত্রের কথা একটু বলুন...।
খালেদ মাহমুদ : প্রথম ব্যাট করে আমরা যখন ২২৩ রান করলাম তখন যে জয়ের চিন্তায় সবাই বিভোর হয়ে পড়েছিলাম, তা নয়। ওই রান করে জেতার কথা মাথায় আনাও হয়ত যুক্তিযুক্ত ছিল না। তারপরও পাকিস্তানের যে ব্যাটিং লাইনআপ তখন, সাঈদ আনোয়ার, আফ্রিদি, সেলিম মালিক, ইনজামাম, ইজাজ, মঈন খানের মত তারকা ব্যাটসম্যান।
ওই আসরে আগের চার ম্যাচে পাকিস্তানিরা খেলছিলও বেশ। এমন এক ইনফর্ম ও বিশ্বমানের দলের বিপক্ষে ২২৩ রানের পুঁজি নিয়ে আসলে আশা করারও কিছু ছিল না। তবে একটা একটা চিন্তা এসে ভর করেছিল যে, উইকেটে বল সুইং করছে, দেখি না চেষ্টা করে, কি হয়! তারপরও বলবো, জয়ের কথা ভাবার চেয়ে পাকিস্তানের শক্তিশালি আর অমন তীক্ষ্ণ ধারালো বোলিংয়ের বিপক্ষে ওই রান করাই ছিল আমাদের মনের সন্তুষ্টি।
জাগোনিউজ : তাহলে প্রথম সেশনের পর আপনারা কি ভেবে লাঞ্চ করলেন? আপনাদের টিম প্ল্যান বা লক্ষ্য কি ছিল তখন?
খালেদ মাহমুদ : আমরা জয়ের কথা মাথায় না আনলেও একটা চিন্তা করেছিলাম যে, পাকিস্তানের মত বড় দলের বিরুদ্ধে ২২৩ রান করেছি। সেটা বড় বা খুব লড়াকু না হলেও একদম ফেলনাও না। আর উইকেটে সুইং আছে। বল ম্যুভ করছে। আমরা হয়ত ফাইট করতে পারি। বাজেভাবে না হারি। ভাল বল করতে পারি। বোলারদের একটা পুঁজি দিতে পেরেছি। যেহেতু উইকেটে বল সুইং করছিলো আর ইংল্যান্ডে সব সময় নতুন বল সুইং করে। এসব ভেবে আর নিজেদের মধ্যে কথা-বার্তা বলেই মাঠে নামি আমরা।
জাগোনিউজ : আপনার নিজের লক্ষ্যটা কি ছিল তখন? আপনি কিভাবে নিজেকে মোটিভেট করেছিলেন?
খালেদ মাহমুদ : আসলে সেটা ছিল আমাদের বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচ। অথচ কঠিন সত্য হলো, সেই ম্যাচের আগের দিন ও রাতে ঘটে যায় অনেক ঘটনা। আমি আজ কুড়ি বছর পরে এসে তা বলতেও চাই না। তবে এটুকু বলতে পারি, আমরা চিন্তা করেছিলাম, এটাই প্রথম বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচ আমাদের। আবার কবে বিশ্বকাপ খেলতে পারবো, তাও জানা ছিল না।
তাই সবাই মিলে বসে ঠিক করা হলো যারা যারা খেলেনি, তাদের সুযোগ করে দেয়া যায় কি না? রাহুল একটি ম্যাচও খেলেনি। শফিউদ্দীন বাবুও খেলেনি কোন ম্যাচ। তাদের দুজনকেই খেলানো হবে। খেলানোও হলো।
তখন আমাকেই বোলিং ওপেন করতে বলা হলো। নতুন বলটা আমার হাতেই দেয়া হলো। আমিও সানন্দে রাজি হয়েছিলাম। বললাম ঠিক আছে আমি নতুন বলেই বল করবো। আমি জানতাম ইংলিশ উইকেটে নতুন বল শুরুতে সুইং করে। সুইং করাতে পারলে প্রাথমিক সাফল্যের দেখা মিলতেও পারে। আমিও শুরুতে সুইং পেলাম। এডভান্টেজ পেলাম।
আফ্রিদি সুইংয়ের মুখে আউট হলো। ফ্লিক করতে গিয়েছিলেন গালিতে, কিন্তু ক্যাচ দিলেন পয়েন্টে। আর সেলিম মালিক এবং ইনজামাম উল হকও আমার ইনসুইংয়ে ভিতরে আসা বলে লেগবিফোর উইকেটের ফাঁদে পড়লেন। বল সুইং করছিল। হ্যাঁ ওই কন্ডিশনে নতুন বলে বল করা ছিল অন্যরকম মজা।
আমার মূল শক্তিই ছিল সুইং। আমিতো আর জোরে বল করতে পারতাম না তেমন। গড়পড়তা ১৩০ কিলোমিটারের আশপাশে থাকতো আমার বল। আমারতো অত পেস ছিল না। আমার মূল শক্তিই ছিল সুইং।
জাগোনিউজ : আফ্রিদিকে আউট করার পর কি মনে হচ্ছিল আপনার?
খালেদ মাহমুদ : হ্যাঁ, বল যেহেতু সুইং করছিল, তখন একটু আশার সঞ্চার হয়েছিল অবশ্যই। তারপরও দলটি পাকিস্তান। যাদের ব্যাটিং লাইনআপ অনেক সমৃদ্ধ। আর ব্যাটিং গভীরতা ও দৈর্ঘ্য দুই’ই বেশি। অনেক বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যান ছিল দলটিতে। অনেকে ফর্মেও ছিলেন। তাই আশাবাদি হতে গিয়েও রাজ্যের দ্বিধা এসে ভর করছিল মনে।
আবার এও মনে হচ্ছিল, ক্রিকেট হচ্ছে মাত্র একটা বলের খেলা। একটা ভাল বল হলে যে কেউ আউট হতে পারে। সে যত বড় আর বাঘা ব্যাটসম্যানই হোন না কেন। ভাল জায়গায় বল ফেলতে পারলে যে কাউকেই আউট করা যায়। আমি সে ম্যাচে খুব ভাল জায়গায় বল করছিলাম। অনেক ভাল জায়গায় বল করেছিলাম। আমার লেন্থটা খুব ভাল ছিল। আমি যখন আফ্রিদির উইকেট পেলাম, তার অল্প কিছুক্ষণ পর শফিউদ্দীন বাবু শূন্য রানে ইজাজ আহমেদকে বোল্ড করে দিল।
ঠিক অল্প সময় পর সাঈদ আনোয়ার রান আউট হলেন। তখনই জয়ের চিন্তা এলো মাথায়। মন বলছিল ভাল জায়গায় বল ফেলতে পারলে কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। আর চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম, জিতেও যেতে পারি।
জাগোনিউজ : ঠিক কোন সময় মনে হলো আপনারা জিততে পারেন?
খালেদ মাহমুদ : নান্নু ভাইয়ের বলে যখন ওয়াসিম আকরাম ডিপ স্কোয়ার লেগে বিদ্যুতের হাতে ক্যাচ আউট হলেন, তখন মনে হলো আমরা জিততে যাচ্ছি। হয়ত জিতবোই।
জাগোনিউজ : পাকিস্তান অধিনায়ক ওয়াসিম আকরামের সাথে আপনার কি হয়েছিল? শোনা যায়, আপনি ওয়াসিম আকরামের চোখে চোখ রেখে কটমট করে তাকাচ্ছিলেন, তা নাকি পছন্দ হয়নি পাকিস্তান কাপ্তানের! আসলে কি হয়েছিল, খুলে বলবেন?
খালেদ মাহমুদ : এগুলো হচ্ছে পার্ট অফ দ্য গেম। এতদিন পর আমি নতুন করে তেমন কিছু বলতেও চাই না। তবে এটুকু বলতে পারি আমি কোন স্লেজিং করিনি। গালাগালিও দেইনি। আমি শুধু ওয়াসিম আকরামের চোখের দিকে পলক না ফেলে তাকিয়ে ছিলাম খানিকটা সময়। চোখ দিয়ে কথা বলেছি শুধু। সেটাই ভাল লাগেনি ওয়াসিম আকরামের।
আমি যখন বোলিং করছিলাম, ওই সময় ওয়াসিম আকরাম ব্যাটিংয়ে। তখন আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে চোখের ভাষায় কথা বলেছিলাম। ওয়াসিম আকরাম তা সহ্য করতে না পেরে আকরাম ভাইকে (আকরাম খান) ডেকে কমপ্লেন করলেন। আকরাম ভাই যদিও ক্যাপ্টেন ছিলেন না (ক্যাপ্টেন ছিলেন বুলবুল ভাই), তারপরও ওয়াসিম আকরামের সাথে আকরাম ভাইয়ের একটা সম্পর্ক খুব ভাল ছিল। আগে থেকে চেনা-জানা ছিল দু’জনার। কথা-বার্তাও হতো। সে চিন্তায় আকরাম ভাইয়ের কাছে কমপ্লেন করছিলেন। আকরাম ভাইয়ের কাছে গিয়ে ওয়াসিম আকরাম বললেন, আমাকে তার চোখের দিকে না তাকাতে। আকরাম ভাইও ভাল মানুষ, আমাকে বললেন, সুজন এতবড় প্লেয়ার, সে চেতে গেছে। অমন করিস না আর। আমিও নাছোড়বান্দা, আকরাম ভাইকে বললাম, আপনি কাইন্ডলি চুপ করে থাকেন। আমি অমন করবোই। থামবো না। আর চেতলেই তো ভাল। চেতলেই মারতে গিয়ে আউট হবে।’
আসলে তখন পাকিস্তান অনেক বড় দল ছিল। ওয়াসিম আকরাম বিশ্ব তারকা আর আমরা তখন ‘মিনোজ’। আমরা অমন করতে পারি, তা হয়ত ওয়াসিম আকরামের কল্পনায়ও আসেনি। ধারনাও ছিল না; কিন্তু ওয়াসিম আকরামরা জানতেনই না পাকিস্তান মানেই আমাদের একটা অন্যরকম আর বাড়তি জিদ।
জাগো নিউজ : ২০ বছর পরও কিছু দুর্মুখ প্রচার করে বেড়ান, ১৯৯৯ সালের ৩১ মে নর্দাম্পটনে বাংলাদেশের কাছে ইচ্ছে করেই হেরে গিয়েছিল পাকিস্তান! আপনার কানে কি কখনো এ কথা এসেছে? তা নিয়ে কিছু বলার ইচ্ছে আছে আপনার?
খালেদ মাহমুদ : আমার কানেও যে এমন কথা আসেনি, তা নয়। এসেছে। আমিও শুনেছি। কেউ কেউ অমন অপপ্রচার চালিয়েছেন। আমরাতো আসলে জানি না। আমরা এটুকু বলতে পারি, ওই ম্যাচে আমরা অনেক কষ্ট করেছি। ঘাম ঝরিয়েছি। সামথ্যের সবটুকু নিংড়ে দিয়েছি। এবং আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি ওই জয়টি আমাদের ওয়েল ডিজার্ভ ভিক্টরি ছিল।
আমরা জানি সেই ম্যাচে কত কষ্ট করেছিলাম। আমার প্রশ্ন হলো, পাকিস্তান যদি ইচ্ছে করেই হারবে, আমাদের ম্যাচ ছেড়েই দিবে তাহলেতো আর শোয়েব আখতার, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস আর অজহার মেহমুদের মত চার-চারজন ফাস্ট বোলার নিয়ে মাঠে নামতো না পাকিস্তান। তাদের মূল দল নিয়ে খেলাতো না।
একটা ভগ্ন, দূর্বল ও কমজোরি লাইনআপই মাঠে নামতো; কিন্তু পাকিস্তান তা কি করেছে? ওয়াসিম আকরামের নেতৃত্বে সে ম্যাচে পাকিস্তান সম্ভাব্য সেরা দল নিয়েই মাঠে নেমেছিল। এক ঝাঁক ফাস্ট বোলারের সাথে সে সময়ের অন্যতম সেরা অফস্পিনার সাকলাইন মুশতাকও খেলেছিলেন ওই ম্যাচে।
মোটকথা, পাকিস্তানের ওই সময়ের যেটা মূল ব্যাটিং লাইনআপ, সেটাই ছিল। বোলিংয়ের ক্ষেত্রেও তাই। ওই আসরে যেটা হতে পারে পাকিস্তানের মেইন বোলিং অ্যাটাক- আমাদের বিপক্ষে ঠিক সেটাই খেলেছে। কি হয়েছে, না হয়েছে আমরা জানি না।
আমরা বলতে পারবো নিজেদের কথা। আমি সব সময় বিশ্বাস করি, ওই ম্যাচে আমরাই ছিলাম বেটার টিম। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং আর ক্যাচিং ও রান আউট করার ক্ষেত্রে সেদিন আমরা পাকিস্তানিদের চেয়ে অনেক ভাল পারফর্ম করেছি।
আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওই জয়। আইসিসি ট্রফি বিজয়ের পর বিশ্বকাপের টিকিট পেয়ে প্রথম আসরে একটি বড় দলকে হারানো আসলে অনেক বড় কৃতিত্ব। বিশাল অর্জন এবং প্রাপ্তি। আমার মনে হয় প্রথমবার বিশ্বকাপের মাঠে নেমে পাকিস্তানকে হারানো আমাদের এক অবিস্মরণীয় কৃতিত্ব। অনেক অনেক বড় সাফল্য। সে সাফল্যের গায়ে কালো দাগ দেয়ার কোনই যৌক্তিকতা নেই। আপনি একটু ওই ম্যাচের স্মৃতি রোমন্থন করে দেখুন! দেখবেন, ব্যাটিং-বোলিংয়ের পাশাপাশি ফিল্ডিং, ক্যাচিং আর রান আউটের ক্ষেত্রে আমরা কত সজাগ, তৎপর ও পারফেক্ট ছিলাম।
আমাদের ফিল্ডিং দেখেন, অপি আর দুর্জয় যে দুটি রান আউট করেছে, তা ছিল এক কথায় ‘অসাধারণ।’ তারপর বিদ্যুৎ স্কোয়ার লেগে অসামান্য দক্ষতায় এক ক্যাচ ধরে ফেললো। সব মিলে আমাদের ‘ওয়েল ডিজার্ভ ভিক্টরি’ ছিল সেটা। একটা টেস্ট খেলুড়ে দলকে বিশ্বকাপ আবির্ভাবে হারানো ছিল অনেক বড় ব্যাপার। আমরা সেই বড় ঘটনা ঘটিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলাম।
জাগো নিউজ : ম্যাচ সেরা পারফরমারের পুরস্কার হিসেবে ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পরে আপনার হাতে একটি ট্রফির পাশাপাশি শ্যাম্পেইনের বড় বোতল উপহার দেয়া হয়েছিল। সবার চোখের সামনে শ্যাম্পেইনের বোতল নিচ্ছেন, মা-বাবা টিভিতে বসে দেখছেন, ভাই-বোন, আত্মীয়-পরিজন, সুহৃদ-শুভানুধ্যায়ী সবার চোখ টিভির সামনে, আর আপনি মঞ্চ থেকে শ্যাম্পেইনের বোতল হাতে নিচ্ছেন। কেমন লাগছিল?
খালেদ মাহমুদ : আসলে কি দেবে, না দেবে, তারচেয়ে বেশি চিন্তায় ছিলাম কি জিজ্ঞেস করবে? বলতে দ্বিধা নেই, বুঝলেও এখনকার মত তখন ইংরেজি তেমন ভাল বলতে পারতাম না। জড়তা ছিল। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বলতাম। তাই খানিক চিন্তায় ছিলাম, কি জানতে চাইবে? ঠিকমত উত্তর দিতে পারবো তো!
তবে পরে যখন আমার হাতে শ্যাম্পেইনের বোতলটা দেয়া হলো, সত্যি বলতে কি আমার তেমন নেতিবাচক অনুভুতি হয়নি। আমি সেটাকে ইংলিশ ক্রিকেটের ‘ট্র্যাডিশন’ বলেই ধরে নিয়েছিলাম। ইংল্যান্ডে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হলে শ্যাম্পেইনের বোতল দেয়া হয়। এটা একটা রীতি। ক্রিকেটে অনেক রীতিই কিন্তু শুরু থেকে বহাল আছে। কাজেই আমাকে যখন সেটা দেয়া হলো, আমি যে তখন নিষেধ করবো, নাহ আমরা মুসলিম দেশ, শ্যাম্পেইনের বোতল নিব না। এমন চিন্তা আমার মাথায়ই আসেনি।
জাগো নিউজ : ম্যাচ শেষের কোন ঘটনা বা স্মৃতি এখনো মনে দাগ কেটে আছে?
খালেদ মাহমুদ : হ্যাঁ, ম্যাচ শেষে পুরো পাকিস্তান দলই আমাদের প্রশংসা করেছে। তবে সেটা এখনকার মত দু’দল মাঠে লাইন করে এক দল আরেক দলকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি করমর্দন করার সুযোগ হয়নি। কারণ, খেলা শেষে মাঠ ভর্তি হয়ে গিয়েছিল আমাদের সমর্থকে। তাই পাকিস্তানীরা আমাদের অভিনন্দন জানিয়েছে। ‘ওয়েল প্লেইড, ওয়েল ডান’ বলছিল আমাদের ড্রেসিং রুমে এসে।
জাগো নিউজ : ম্যাচ শেষ হবার আগে একটি রান আউটের সিদ্ধান্ত থার্ড আম্পায়ারের কাছে রেফার করার সময় বাংলাদেশের হাজারো সমর্থক জয় নিশ্চিত বলে মাঠে ঢুকে পড়েছিলেন, তখনকার অনুভুতি কেমন ছিল?
খালেদ মাহমুদ : সত্যি কথা বলতে কি, যখন আমরা মাঠে যাচ্ছিলাম টিম বাসে করে, তখনই দেখছিলাম হাজার হাজার বাঙ্গালি মাঠে যাচ্ছেন। কেউবা আমাদের লাল-সবুজ জাতীয় পতাকা হাতে, জার্সি গায়ে, কেউ বা হাতে বাঘ নিয়ে মাঠের দিকে যাচ্ছেন।
তা দেখে আমাদের আসলে সবার মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভুতি হচ্ছিল। আসরা চিন্তা করছিলাম, ইস! এত স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন! আমরা আর বিশ্বকাপে খেলতে পারবো কি না ভবিষ্যতে? দল খেললেও কে সুযোগ পাবে আর? ভাল করার এটাই যে শেষ সুযোগ! কাজেই একটা অন্যরকম অনুভুতি কিন্তু ভিতরে জেগেছিল সবার। আমরা বুঝতেই পারিনি, রান আউট হয়েছে কি হয়নি। পরে লাল বাতি জ্বলার পর বোঝা গেল রান আউট; কিন্তু ততক্ষণে মাঠ ভর্তি হয়ে গিয়েছিল আমাদের সমর্থকে। আমরা যে কারণে কেউ উইকেট তুলে নিজের স্মৃতিতে রাখার সুযোগটাও পাইনি। উইকেট তুলতেই পারিনি।
জাগো নিউজ : শেষ ম্যাচের ঠিক আগের দিন আসলে কি হয়েছিল? কোচ গর্ডন গ্রিনিজকে কবে কখন ‘না’ করে দেয়া হয়েছিল? তিনি কি আপনাদের সাথে পাকিস্তানের সাথে ওই অবিস্মরণীয় জরে শুভক্ষণে ড্রেসিং রুমে ছিলেন?
খালেদ মাহমুদ : শেষ ম্যাচে গর্ডন গ্রিনিজ আর আমাদের দলের কোচ থাকবেন না। তিনি ‘স্যাকড’। তাকে পদচুত্য করা বা অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। পুরো টিম এ খবর জানতো কি না জানি না। তবে আমি জানতাম। কারণ, গর্ডন আমাকে খুব পছন্দ করতেন। আর টিম হোটেলে ঠিক আমার বিপরীত দিকের রুমটাতেই থাকতেন তিনি। তাই নিজেই আমাকে রুমে ডেকে নিয়ে অব্যাহতি পত্র দেখিয়েছিলেন। আমার মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
কারণ, গর্ডন আমাদের নিয়ে প্রায় চার বছর অনেক ঘাম ঝরিয়েছেন। প্রচুর কষ্ট করে ট্রেনিং করিয়েছিলেন। অব্যাহতি পত্র পাবার পরও গর্ডন আমাকে বলেছিলেন, সুজন আমি কাল ঠিকই মাঠে যাব। এবং আমার এখনো মনে আছে, মাঠে যাবার আগে টিম বাসে সবার আগেই উঠে বসেছিলেন গর্ডন। আগের দিন অব্যাহতি দেয়া হলেও কেউ তাকে শেষ ম্যাচে টিম বাসে চড়ার ও বসার ব্যাপারে ‘না’ বলতে পারেননি।
মাঠে আমাদের ওয়ার্মআপের সময়ও ছিলেন গর্ডন। এরপর আমরা যখন গলা ধরে সবাই দিনের লক্ষ্য, দায়িত্ব-কর্তব্য নিয়ে কথা বলি, তখন গর্ডন সবাইকে জানিয়ে দেন, এটাই এবারের বিশ্বকাপে তোমাদের শেষ ম্যাচ। আর আমারও তোমাদের সাথে শেষ ম্যাচ। এরপর পথ আলাদা হয়ে যাবে। তোমরা জান-প্রাণ দিয়ে এ ম্যাচ খেলো। নিজেদের সেরা ক্রিকেট খেলো। সবাই একশত ভাগ দিয়ে খেলবা। জয়-পরাজয় পরের কথা। মাঠে সামথ্যের সবটুকু ঢেলে উজাড় করে দিবা।’
এরপর খেলা শুরু হলো। আমরা যেহেতু আগে ব্যাটিংয়ে ছিলাম, সবাই তা নিয়েই ব্যস্ত। আমি যদিও চার ওভার আগে আউট হয়েছিলাম। তারপরও ঠিক বলতে পারবো না যে, গর্ডন ঠিক কখন ড্রেসিং রুম ছেড়ে চলে গেছেন! জানি না।
এরপর খেলা শেষে আমি তাকে ফোন দিয়েছিলাম। আমি তাকে ফোন দিয়ে বলেছিলাম, গর্ডন আপনি কোথায়? আমরা জিতে গেছি। আপনি আসুন। গর্ডন জবাবে বললেন, হ্যাঁ, জানি তোমরা জিতেছো। আমি খুব খুশি। অনেক ভাল লাগছে। তবে এখন আর তোমাদের মাঝে ফিরে যেতে পারবো না। কারণ, আমি এখন অনেকটা পথ দুরে চলে গেছি। সেখান থেকে আর ফিরে যেতে পারবো না। কোন না কোন সময় হয়ত তোমাদের সাথে দেখা হবে।’
এআরবি/আইএইচএস/পিআর