শিক্ষা

জিপিএ-৫ পেয়েও দুশ্চিন্তায়!

বাবা ছাত্র হিসেবে খুব ভালো ছিলেন। কিন্তু অর্থনৈতিক কারণে লেখাপড়া পঞ্চম শ্রেণিতে এসে থেমে যায়। সেই পিতার সন্তানেরও ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় জীবনযুদ্ধ। শত দরিদ্রতা, মেঘ-বৃষ্টি, রোদ সবকিছু উপেক্ষা করে বিদ্যালয়ে হাজির হয়। ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত কঠোর সাধনার ফল আজ পেয়েছে।

Advertisement

বলছিলাম চাঁদপুর ফরিদগঞ্জ থানার কড়ৈতলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৯ সালে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত হতদরিদ্র ছাত্র শাকিল শেখের হৃদয়বিদারক কথা। শাকিলের জীবনের গল্প শুনিয়েছেন মরিয়ম আক্তার।

ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথেই শুরু হত শাকিলের সাধনা। বাবা শফিকুর রহমান এবং মাতা জাহানারা বেগম। পাঁচ সন্তানের মাঝে শাকিলই সবার ছোট। শফিকুর রহমান বর্তমানে বেকার। তিনি তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলের মাঝে বড় ছেলে গাড়ি চালায়। এ অবস্থায় সংসার চালানো সত্যিই বড় দায়। দারিদ্র্যের কারণে কোনো ছেলে-মেয়েকেই বেশি পড়াতে পারেননি। কিন্তু ছোট ছেলে শাকিলের পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ যেন উপচেপড়ে। একদিকে সংসার খরচ আর অন্যদিকে শাকিলের পড়ার খরচ চালানো তার ড্রাইভার ভাইয়ের পক্ষে যেন অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

শাকিল সংসারের হাল অবস্থা বোঝে, কিন্তু কি করবে? পড়ালেখার প্রতি যে তার অসম্ভব টান। অভাব-অনটনের সঙ্গে সে সংগ্রাম করতে শিখে গেছে। থেমে থাকেনি। টাকার জন্য বই কিনতে পারেনি তো কি হয়েছে, বন্ধুদের কাছ থেকে তো ধার করে পড়েছে। প্রয়োজন হলেই বই ধার করে পড়ত। পড়ার প্রতি তার আগ্রহ দেখে স্কুলের শিক্ষকরাও অবাক হতেন। ক্লাসের বাহিরেও তাকে পড়ালেখার ব্যাপারে অনেকে সাহায্য করতেন। অনেকটা প্রাইভেটের মতই কিন্তু বিনিময়ে টাকা নিতেন না।

Advertisement

কিন্তু শাকিল টাকার জন্য তেমন একটা প্রাইভেট পড়তে পারত না। তবে ক্লাসে ছিল তার কঠোর মনোযোগ। ক্লাসে যা শিখত বাড়ি গিয়ে তা অনুশীলনের চেষ্টা করত। গভীর রাত পর্যন্ত চলত তার এই সাধনা। কখনো বা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যেত।

এভাবে সে পার করেছে কৈশর। অষ্টম শ্রেণিতে তার ফলাফল ছিল জিপিএ- ৪.৫০। বলা যায় এমন ফলাফল আশানুরূপ নয়। সে এবার আরও পরিশ্রম শুরু করল। ২০১৯ সালে এসে স্বপ্ন সত্যি হলো। সে জিপিএ-৫ পেয়েছে। কিন্তু তার লেখাপড়া সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। বিদ্যালয়ে সবার সঙ্গে সমানভাবে মিশতো শাকিল। ব্যক্তিগত কোনো বন্ধু ছিল না। তবে সে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ আশাহত!

শাকিল বলেন, ‘যেখানে আমার পরিবারের নুন আনতে পানতা ফুঁরায়, সেখানে তবুও যেন আমার আকাশ কুসুম ভাবনা। আমি ভালো একটা কলেজে ভর্তি হতে চাই, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। এখন দুঃস্বপ্ন আমার ওপর ভর করেছে। কীভাবে যে আমার পরিবার এমন অবস্থার মাঝেও আমার লেখাপড়ার খরচ চালাবে সেই ভাবনা যেন আমাকে চিরে খাচ্ছে। আমার বাবাও লেখাপড়ায় ভালো ছিল, ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত তিনি পড়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে তিনি আর পড়তে পারেননি।’

শাকিলের বাবা-মা খুব খুশি ছেলের ফলাফল নিয়ে। কিন্তু তাদের এই খুশিটাও দুঃখে পরিণত হয়েছে। কীভাবে যে নিজের ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালাবে, ছেলেটার যে বুক ভরা আশা।

Advertisement

বাবা শফিকুর বলেন, ‘আমার ছেলে পাশ করেছে। আমি খুব খুশি। কিন্তু দুঃশ্চিন্তা যে বেড়ে গেছে বহুগুণে। ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালানো যে আমার পক্ষে আকাশ কুসুম কল্পনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার ছেলে অনেক বড় হবে। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখি, সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি চাইলে সব কিছুই পারেন।’

এমন হালে থাকা সত্ত্বেও শাকিলের স্বপ্ন বিশাল। সে জীবনে অনেক বড় কিছু হতে চায়। শুধুমাত্র অভাবের কারণে তার এই হাল, সে চায় বড় হয়ে গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াবে। অভাবের কারণে সে তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে পারছে না, একদিন সে এমন হাজারও দরিদ্র মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সাহায্য করবে। শাকিলের অনেক বড় স্বপ্ন। সামান্য অর্থের জন্য আজ সে স্বপ্ন বৃথা হতে যাচ্ছে।

এমআরএম/এমএস