গত কয়েক বছরে ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটিতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আবারও ক্ষমতায় এলে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশটি মুসলিমদের জন্য আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
Advertisement
দেশটিতে লোকসভা নির্বাচনের ভোট চলছে। এই ভোটেও চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। সাত দফায় ভোট অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যেই ছয় দফার ভোট শেষ হয়েছে। অপেক্ষা এখন শেষ দফার। এর মধ্যেই প্রথম দফার ভোটের কয়েকদিন পরেই একদল লোকের রোষের মুখে পড়েন উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসামের এক মুসলিম ব্যবসায়ী।
শওকত আলি নামের ওই ব্যবসায়ীকে ঘিরে ধরেন কয়েকজন। তাকে কাদামাটির মধ্যে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করা হয়। ভিড়ের ভেতর থেকেই একজন চিৎকার করে বলেন, তুমি কি বাংলাদেশি? এমন কথার পরে তার নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
অন্য একজন তাকে ধাক্কা দিয়ে বলেন, এখানে গোমাংস বিক্রি করেছো কেন? আশেপাশের লোকজন তাকে সাহায্য করার বদলে এই ঘটনা ক্যামেরাবন্দী করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সবাই যার যার মোবাইল ফোনে এই ঘটনার ছবি এবং ভিডিও ধারণ করা শুরু করেন।
Advertisement
ওই ঘটনার এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না শওকত আলি। বিছানায় শুয়ে ওই ভয়াবহ ঘটনা মনে করতেই চোখে পানি চলে আসে ৪৮ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ীর। তিনি বলেন, তারা লাঠি দিয়ে আমাকে পিটিয়েছে, তারা আমার মুখে লাথি মেরেছে।
তিনি এবং তার বাবা কয়েক দশক ধরেই আসামে একটি ছোট খাবারের দোকান চালান। সেখানে অন্যান্য খাবারের সঙ্গে গোমাংসও থাকে। কিন্তু আগে কখনওই তাকে এর জন্য এমন সমস্যার মুখে পড়তে হয়নি। অনেক রাজ্যেই গোমাংস বিক্রি নিষিদ্ধ কারণ হিন্দুরা গরুকে পবিত্র হিসেবে মানে। কিন্তু আসামে গরুর মাংস কেনা-বেচা অবৈধ না।
শওকত আলি শুধু শারীরিকভাবেই আহত হয়েছেন তা নয় বরং, এই ঘটনার জন্য মানসিকভাবেও তিনি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তার সামাজিক মান-মর্যাদাও নষ্ট হয়ে গেছে। ধার্মিক এই মুসলিমকে জোর করে শুকরের মাংস খেতে বাধ্য করেছে উন্মত্ত জনতা।
শুকরের মাংস মুসলিমদের জন্য হারাম। কিন্তু কট্টরপন্থী হিন্দুরা তাকে মুখে শুকরের মাংস নিয়ে তা চাবিয়ে খেতে বাধ্য করেছে। এতে পুরোপুরিই ভেঙে পড়েছেন তিনি। শওকত আলি বলেন, আমার আর বেঁচে থাকার কোন মানেই নেই। তারা আমার ওপর নয় বরং আমার ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর আক্রমণ করেছে।
Advertisement
এই ঘটনার পর মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকেই শওকত আলির সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তার মুখে সব কিছু শুনে অনেকেই কেঁদে ফেলেন। তাদের মধ্যে এখন একটাই আতঙ্ক বিরাজ করছে যে, সামনের দিনগুলোতে তাদেরও হয়তো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
আসামে নাগরিকপঞ্জির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে বিজেপি। যারা ভারতের নাগরিক নন তাদের বের করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা যাচ্ছে এখানেও বেছে বেছে মুসলিমদের ওপরই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বেশি।
ভারতে বর্তমানে ১৭ কোটি ২০ লাখ মুসলিম বাস করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক এই দেশটি এই বিপুল সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠীকে কিভাবে দেখছে? বর্তমানে মোদির শাসনামলে গোমাংস ক্রয়, বিক্রয়, সঙ্গে বহন করা বা খাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বহু মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে।
নির্বিচারে যে কোন মুসলিমকে গোমাংস বহনের অভিযোগে আক্রমণ করছে উন্মত্ত জনতা। পুলিশও এর বিরুদ্ধে কঠোর কোন ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে মুসলিমদের। মোদি যদি আবারও ক্ষমতায় আসেন তাহলে মুসলিমদের জন্য পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে বলেই আতঙ্ক বিরাজ করছে।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের খবরে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের মে থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতের ১২ রাজ্যে কমপক্ষে ৪৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৬ জনই মুসলিম। ওই একই সময়ে ২০ রাজ্যে শতাধিক হামলার ঘটনায় প্রায় ২৮০ জন আহত হয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনের প্রধান মিশেল বেচলেট তার এক প্রতিবেদনে সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলিম এবং দলিত সম্প্রদায়ের মতো নিচু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর হামলা এবং হয়রানি বৃদ্ধির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
টিটিএন/আরআইপি