ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ, বিনিয়োগের জন্য ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)-কে তহবিল প্রদান, প্লেসমেন্ট নৈরাজ্য বন্ধ, নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার বিক্রির চাপ কমানোর পদক্ষেপ, দুর্বল কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) ঠেকানোর উদ্যোগসহ নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো।
Advertisement
মন্দা থেকে বের করে দেশের পুঁজিবাজারে গতি ফেরাতে সম্প্রতি এমন নানামুখী উদ্যোগ নিয়ে তৎপর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বিএসইসির এ উদ্যোগ সফল করতে সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও দেয়া হচ্ছে নানা ছাড়।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার পাশাপাশি স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে পুঁজিবাজারে গতি ফেরাতে বিভিন্ন প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। ২০১০ সালের মহাধসের সময়ও বাজার-সংশ্লিষ্ট ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর এমন তৎপরতা দেখা যায়নি বলে অভিমত অনেকের। তবে বিনিয়োগকারীরা বলছেন, শুধু উদ্যোগ নিলেই হবে না, তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে, গতি ফিরে পাবে বাজার।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, তিন মাসের বেশি সময় ধরে পুঁজিবাজারে দরপতন চললেও মে মাসের আগ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো অনেকটা নিশ্চুপ ছিল। দিনের পর দিন দরপতনের প্রতিবাদে বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নামলেও তাদের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু ৩০ এপ্রিল জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী পুঁজিবাজার নিয়ে বক্তব্য দিলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। বাজারে গতি ফেরাতে তৎপর হয়ে ওঠে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
Advertisement
প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, পুঁজিবাজারে আমরা সবধরনের সুযোগ দিচ্ছি। এখানে আগে অনেক ঘটনা ঘটেছে। আমরা স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছি। এ নিয়ে খুব বেশি শঙ্কিত হওয়ার কিছু নাই। নিয়ন্ত্রণে যা যা দরকার সে পদক্ষেপগুলো আমরা নিচ্ছি। তবে কেউ যদি গেম খেলতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি ও নেব। ছাড় দেয়া হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর পুঁজিবাজারে গতি ফেরাতে তৎপর হয়ে ওঠে বিএসইসি। বাজার-সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে বসে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। স্টক এক্সচেঞ্জ, মার্চেন্ট ব্যাংক ও শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউসগুলো থেকে নেয়া হয় অভিমত। ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে ছুটে যান বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক খায়রুল হোসেন।
স্টক এক্সচেঞ্জ, মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আইপিও আবেদন গ্রহণ ও প্লেসমেন্ট বন্ধের ঘোষণা দেয় বিএসইসি। একই সঙ্গে আইপিও প্রক্রিয়ায় তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক ও প্লেসমেন্টধারীদের শেয়ারের লক ইন (বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা) সীমা বাড়ানো হয়। পাশাপাশি আইপিও, প্লেসমেন্ট, আইপিওপরবর্তী বোনাস শেয়ার এবং উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের এককভাবে ২ শতাংশ ও সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ সংক্রান্ত বিদ্যমান নোটিফিকেশনের সংশোধনী আনতে গঠন করা হয় দুটি কমিটি।
এদিকে সরকারের নির্দেশে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য আইসিবিকে ৮৫৬ কোটি টাকার তহবিল দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি বাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য অতালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার বিনিয়োগসীমার মধ্যে না ধরার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এক্সপোজারে সংশোধনী আনা এবং আইসিবিতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একক গ্রাহকের ঋণসীমার শর্ত শিথিলের আশ্বাস দেয়া হয়।
Advertisement
বিএসইসির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ে সরকার একধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রয়েছে। যে কারণে বাজারের গতি ফেরাতে সরকার বেশ তৎপর। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করে বাজারে গতি ফেরাতে সরকারের পক্ষ থেকে বিএসইসিকে পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে পুঁজিবাজারের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোও বাজারে গতি ফেরাতে একমত হয়েছে। বাজার পরিস্থিতি কোনোভাবে এমন পর্যায়ে যেতে দেয়া যাবে না যাতে সরকার আরও বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে। এজন্য প্রতিটি সংস্থা নিজ নিজ অবস্থান থেকে নীতিসহায়তা অব্যাহত রাখবে।
ডিএসইর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, বিএসইসি এখন যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে, এগুলো আরও আগে নিলে পুঁজিবাজারের এমন অবস্থা হতো না। আমরা আশা করছি, সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজার নিয়ে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাজার কিছুদিন ভালো থাকলে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকটও কেটে যাবে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক ও সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান বলেন, আমি মনে করি প্রধানমন্ত্রী পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বাজার ভালো করার জন্য যখন হস্তক্ষেপ করেছেন, সেদিন থেকে যে সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়নের জন্য বিএসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় চেষ্টা করে যাচ্ছে।
‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমরা যদি কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারি তাহলে বাজারের আস্থা ও অর্থসংকট সব কেটে যাবে। সেই সঙ্গে বাজার একটি দৃঢ়ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে।’
তিনি আরও বলেন, এতদিন যে প্লেসমেন্ট বাণিজ্য চলেছে তা বন্ধ হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে দুর্বল ও মানহীন কোম্পানির তালিকাভুক্ত হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। এতে বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ফিরে আসবে এবং ট্রান্সপারেন্ট (স্বচ্ছতা) বাজার প্রতিষ্ঠিত হবে। সাম্প্রতিক সময়ের উদ্যোগগুলো আমি অত্যন্ত পজেটিভ হিসেবে দেখছি।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান-উর রশিদ চৌধুরী বলেন, বাজারের বড় সমস্য হলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা। তাদের আস্থা ফিরলে বাজারে অবশ্যই গতি ফিরবে। সম্প্রতি যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা আমরা খুবই ইতিবাচকভাবে দেখছি। তবে শুধু মুখে বললে হবে না, কাজে প্রমাণ দিতে হবে। ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়ার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে শিগগিরই সে-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।
ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগবেমেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ, যা দৈনন্দিন লেনদেনে প্রভাব ফেলে না তা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হিসাবে ধরা হবে না। বিদ্যমান নিয়মে ব্যাংকগুলো আদায় করা মূলধন, শেয়ার প্রিমিয়াম হিসাবে রক্ষিত স্থিতি, সংবিধিবদ্ধ সঞ্চিতি ও রিটেইন্ড আর্নিং-এর ২৫ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। সমন্বিত পদ্ধতিতে ব্যাংক ও তার সাবসিডিয়ারি মিলে বিনিয়োগ করতে পারে ৫০ শতাংশ।
এ বিনিয়োগ হিসাবের ক্ষেত্রে ব্যাংকের ধারণ করা সব ধরনের শেয়ার, ডিবেঞ্চার, করপোরেট বন্ড, মিউচ্যুয়াল ফান্ড ইউনিট ও অন্যান্য পুঁজিবাজার নির্দেশনাপত্রের বাজারমূল্যে হিসাব করা হয়। সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের গ্রাহককে দেয়া মার্জিন ঋণের স্থিতি, ভবিষ্যৎ মূলধন প্রবাহ বা শেয়ার ইস্যুর বিপরীতে বিভিন্ন কোম্পানিকে দেয়া ব্রিজ ঋণ এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে গঠিত তহবিলের চাঁদাও এ হিসাবের মধ্যে ধরা হয়।
আইসিবির সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগপুঁজিবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় প্রণোদনা প্যাকেজের সুদ ও আসলসহ আদায় করা ৮৫৬ কোটি টাকা পুনর্ব্যবহারের জন্য আইসিবিকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি তহবিলটির মেয়াদ ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে বাড়িয়ে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া ব্যাংকগুলোর একক গ্রাহকের ঋণসীমার শর্ত আপাতত শিথিলের আশ্বাস দিয়েছে আইসিবি। এর মাধ্যমে বাজারে তারল্য বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আইপিও, প্লেসমেন্ট বন্ধস্টেকহোল্ডারদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আপাতত আইপিও আবেদন না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। পাশাপাশি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক ইস্যু) রুলস, ২০১৫ এর সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এ সংশোধন হওয়ার আগ পর্যন্ত চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল থেকে আইপিও সংক্রান্ত নতুন কোনো আবেদন গ্রহণ করা হবে না। তবে ইতোমধ্যে যেসব কোম্পানির আইপিও আবেদন জমা পড়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী বিবেচনা করা হবে।
একই সঙ্গে বিএসইসি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ৩০ এপ্রিল থেকে অ-তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির মূলধন উত্তোলন সংক্রান্ত কোনো আবেদন গ্রহণ করা হবে না। তবে ইতোমধ্যে যেসব অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির মূলধন উত্তোলনের (ক্যাপিটাল রাইজিং) আবেদন জমা পড়ে আছে সেগুলোর ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী বিবেচনা করা হবে।
লক-ইনের সময় বৃদ্ধিনতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার বিক্রির চাপ কমাতে লক-ইনের সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। এজন্য নিয়মে পরিবর্তন এনে লেনদেনের প্রথম দিন থেকে লক-ইন গণনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আগে প্রসপেক্টাস ইস্যুর তারিখ থেকে লক-ইন গণনা করা হতো। এ পরিবর্তনের ফলে ভিএফএস থ্রেড ডাইং, এমএল ডাইং, ইন্দো-বাংলা ফার্মা, সিলভা ফার্মাসিউটিক্যালস, কাট্টালি টেক্সটাইল, এসএস স্টিল, স্কয়ার নিট কম্পোজিট ও জেনেক্স ইনফোসিসের লক-ইনের সময় বেড়েছে।
নোটিফিকেশনে সংশোধনী আনতে কমিটি গঠনপ্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও), প্লেসমেন্ট, আইপিও-পরবর্তী বোনাস শেয়ার এবং উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের এককভাবে ২ শতাংশ ও সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ সংক্রান্ত বিদ্যমান নোটিফিকেশনের সংশোধনীর জন্য দুটি কমিটি গঠন করেছে বিএসইসি।
এমএএস/এমএআর/জেআইএম