বিশ বছর ধইর্যা বাঁশের চালুন, কুলা, খাঁচা বানাইন্যা সংসার চালাইতাছি। আগে বাঁশ, গুনার দাম কম আছিল। তাই সংসারের খরচ চালাইয়াও দুই পয়সা হাতে থাকতো। কিন্তু এহন বাঁশ আর গুনার দাম বাইড়া যাওনে দুই পয়সা থাকন তো দূরের কথা সংসারের খরচই চালাবার পাইনা। একরাশ হতাশা নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন জামালপুর সদর উপজেলার শরিফপুর ইউনিয়নের ঢেংগারগড় গ্রামের মো. সামছুল হক। পাশে বসে চালনা তৈরিতে ব্যস্ত হালিমা খাতুন স্বামীর কথায় সায় দিয়ে জাগো নিউজকে জানালেন, সংসার ঠিকমতো চলে না।তাই সংসারে দু-পয়সা বাড়তি রোজগারের জন্য স্বামীর পাশাপাশি তিনিও কাজ করছেন। শুধু ঢেংগারগড়ের সামছুল-হালিমার পরিবারই নয়, জামালপুর জেলার প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবার বাঁশ শিল্পের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। সবুজ-শ্যামল ছায়া বেষ্টিত ঢেংগারগড় গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই নিম্ন আয়ের পেশায় জড়িত। বাঁশ আর চিকন গুনার তার এইটুকুই সম্বল নিয়ে দু’হাতের কারিগরি দক্ষতায় জামালপুরের শরিফপুর ইউনিয়নের ঢেংগারগড় গ্রামে গড়ে উঠেছে গ্রামীণ বাঁশ শিল্প। এখানকার মানুষের হাতে তৈরি কুলা, চালনা, খাঁচাসহ নানান বাঁশ সামগ্রীর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের জেলাগুলোয়। অল্প মূলধনেই বাঁশের সামগ্রী তৈরি করে ভালো উপার্জন হওয়ায় প্রায় ২৫ বছর যাবৎ এ গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবার বাঁশ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। সংসারে দু-পয়সা বাড়তি রোজগারে পুরুষের পাশাপাশি কাজ করছে মেয়েরাও।শুধু শরিফপুর ইউনিয়নের ঢেংগারগড় গ্রামই নয়, জামালপুরের দিগপাইত ইউনিয়নের ছোনটিয়া জোলাপাড়া, তারাভিটা, কালিবাড়ী পাঁচগুচি, নান্দিনা এলাকার তারাগঞ্জ, রনরামপুর, রাঙামাটিয়া, খরখড়িয়া, শ্রীবাড়ী, বেড়াপাথালিয়া, ফইত্যাপুর, মেলান্দহ উপজেলার বটতলা, ইসলামপুর উপজেলার জোলাপাড়া গ্রামের প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবার বাঁশের কুলা, চালনা, খাঁচা, ঢাকী, হাত পাখা, দাড়িপাল্লা, পলো, বাইড়, খালই, ওচা, ঝাড়ু, দাড়কি, চাইসহ নানা বাঁশ সামগ্রী তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। কিন্তু বাঁশ আর গুনার তারের মূল্য বৃদ্ধিসহ নানা সমস্যায় এই শিল্পে টিকে থাকা নিয়ে শঙ্কায়ে রয়েছে তারা। বর্তমানে বাঁশ ও গুনার তার বেশি দামে কিনতে হচ্ছে বিধায় আয় কমে গেছে এই পেশায় জড়িত কারিগরদের। ৫/৭ বছর আগেও ভালো একটি বাঁশের দাম ছিলো ৩০ থেকে ৪০ টাকা, সেখানে এখন ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় বাঁশ কিনতে হচ্ছে তাদের। আর ২০/২৫ টাকা কেজি গুনা এখন কিনতে হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায়। ঢেংগারগড় মধ্যপাড়া গ্রামের খাঁচা তৈরির কারিগর মুসলিম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ভাল একটি বাঁশ দিয়ে ৮ থেকে ১০টি খাঁচা তৈরি করা যায়। প্রতিটি খাঁচা পাইকাররা তাদের কাছ থেকে ২০-২৫ টাকা দরে কিনে নিয়ে যায়। তবে টমেটো, করল্লার মৌসুমে তারা প্রতি খাঁচা ৬০ টাকা দরে বিক্রি করে থাকে। কিন্তু ভালো একটি বাঁশ প্রায় ২০০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়। ফলে উৎপাদন ব্যয় মিটিয়ে তাদের খুব একটা লাভ হয় না। একই গ্রামের রজব আলী, তোফাজ্জল, খোকন, চঞ্চল, আবুল, মজিবর, আব্দুলসহ অনেকেই জানান, অল্প মূলধনে ভালো লাভ হওয়ায় পেশা হিসেবে এই বাঁশ শিল্পটিকেই বেঁছে নিয়েছিলেন তারা। কিন্তু বর্তমানে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় লাভের পরিমাণও কমে গেছে। ফলে বছর জুড়েই অর্থ সংকটে ভুগতে হচ্ছে তাদের।বাঁশ শিল্পের কারিগর স্বপ্না, মুর্শেদা, রিনা, কমলা, তাসলিমা জানান, সারাদিন পরিশ্রম করে মাত্র ৩০/৪০ টাকা আয় করি। এ সামান্য রোজগার দিয়ে অভাবের সংসারে কিছুটা হলেও সহযোগিতা করতে পারি। তারা বলেন, বাঁশ ও গুনার দাম কমে গেলে এবং ব্যবসা ভাল হলে তাদের আয়-রোজগারও বেড়ে যেতো।জামালপুর বিসিক শিল্প নগরীর সহকারী মহাব্যবস্থাপক নীহার রঞ্জন দাস জাগো নিউজকে জানান, বিসিক থেকে বিভিন্ন সময়ে বাঁশ ও বেত শিল্পের উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কৃষি ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্র শিল্পের উপর ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। বাঁশ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে যোগাযোগ করলে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা যাবে।সংসারের ব্যয় মিটিয়ে হাতে মূলধন না থাকায় চড়া সুদে ঋণ নিয়ে উৎপাদন সামগ্রী কিনতে হচ্ছে এ পেশার লোকদের। অভাব আর দারিদ্রতা নিত্য দিনের সঙ্গী হলেও বাঁচার তাগিদে তারা এখনও আঁকড়ে ধরে আছে এই শিল্পটিকে। এভাবে চলতে থাকলে পুঁজির অভাবে অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে সম্ভাবনাময় এই শিল্পটি। সরকার থেকে সহজশর্তে ঋণ পেলে এই পেশায় জড়িতরা স্বচ্ছলতার মুখ দেখবে এমনটাই আশা তাদের। এসএস/এমএস
Advertisement