ভূমধ্যসাগরে আহমেদ বিলালের চোখের সামনেই একে একে ডুবে যাচ্ছিল অনেক সহযাত্রী। তিনি নিজেও ঠাণ্ডা পানিতে ডুবে মরার উপক্রম হয়েছিল। তারপর একদল জেলে এসে উদ্ধার করলো তাকে।
Advertisement
আল্লাহ আমাদের বাঁচাতে জেলেদের পাঠিয়েছিলেন, ‘বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলছেন তিনি। এই সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন কীভাবে বাংলাদেশের সিলেট থেকে ইউরোপের পথে শুরু হয়েছিল তার এই বিপদজনক যাত্রা।
আহমেদ বিলাল এখন আছেন তিউনিসিয়ার উপকূলীয় শহর জারজিসে রেড ক্রিসেন্টের একটি আশ্রয় কেন্দ্রে। নিজে বেঁচে গেলেও এই ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন তার দু’জন আত্মীয়। তাদের জন্য কান্না থামাতে পারছেন না তিনি।
তাদের নৌকা যখন পানিতে ডুবে গেল, তখন মোট ১৬ জনকে সেখান থেকে জীবিত উদ্ধার করে এই জেলেরা। আহমেদ বিলাল সেই সৌভাগ্যবানদের একজন। কিন্তু আরও প্রায় ৬০ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। এদের বেশিরভাগই ছিল বাংলাদেশি।
Advertisement
সিলেট থেকে ইউরোপের পথে
৩০ বছর বয়সী আহমেদ বিলালের বাড়ি সিলেটে। সেখান থেকে উন্নত জীবনের আশায় তিনি ইউরোপের পথে পাড়ি জমিয়েছিলেন দালালদের মাধ্যমে। পারিবারিক জমি বিক্রি করে তিনি দালালের হাতে এজন্যে তুলে দেন সাত হাজার মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। এই দালালকে তিনি চেনেন ‘গুডলাক’ ছদ্মনামে।
‘এই দালাল আমাকে বলেছিল, আমরা বেশ ভালো জীবনযাপন করতে পারবো। আমরা তাকে বিশ্বাস করেছিলাম।আমি নিশ্চিত যত লোককে সে এভাবে পাঠায়, তাদের বেশিরভাগই মারা যায়।’
ছয় মাস আগে তাদের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে তারা যান দুবাই। সঙ্গে ছিল আরও দু’জন। সেখান থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে। সেখান থেকে আরেকটি ফ্লাইটে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলিতে।
Advertisement
বিলাল জানান, ত্রিপলিতে আরও প্রায় ৮০ জন বাংলাদেশি তাদের সঙ্গে যোগ দেন। এরপর পশ্চিম লিবিয়ার কোন একটা জায়গায় একটি রুমে তাদের তিন মাস আটকে রাখা হয়।
‘আমার মনে হয়েছিল, আমি লিবিয়াতেই মারা যাব। আমাদের দিনে মাত্র একবার খাবার দেয়া হতো। অনেক সময় তারও কম। আশি জন মানুষের জন্য সেখানে টয়লেট ছিল একটি। আমরা শৌচকর্ম পর্যন্ত করতে পারতাম না। আমরা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করতাম।’
নৌকায় বিপজনক যাত্রা
একদিন তাদের উত্তর-পশ্চিম লিবিয়া থেকে একটি বড় নৌকায় তোলা হয়। এরপর সাগরের মাঝে তাদের আরেকটি ছোট নৌকায় তোলা হয়। আহমেদ বিলালের সঙ্গে ওই একই নৌকায় ছিলেন একজন মিশরীয় নাগরিক মনজুর মোহাম্মদ মেতওয়েলা। তিনি জানান, এই ছোট নৌকাটি সঙ্গে সঙ্গে ডুবে যেতে শুরু করে।
‘আমরা সারারাত ধরে সাঁতার কেটে ভেসে থাকি।’
বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা বলেন, ‘তাদের সহযাত্রীদের সবাই ছিলেন পুরুষ। এর মধ্যে ৫১ জন ছিলেন বাংলাদেশের। তিন জন মিশরের। এ ছাড়া মরক্কো, শাদ এবং আরও কয়েকটি আফ্রিকান দেশেরও কয়েকজন ছিলেন।’
বিলাল বলেন, ‘বেঁচে থাকার সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। তারপর আল্লাহ যেন আমাদের বাঁচাতে এই জেলে নৌকা পাঠালেন।’ জেলেরা মোট ১৬ জনকে উদ্ধার করেন যাদের ১৪ জন বাংলাদেশি। বাকি দু’জনের একজন মরোক্কোর, একজন মিশরের।
রেড ক্রিসেন্টের কর্মকর্তা মনজি স্লিম বলেন, ‘যদি তিউনিসিয়ার জেলেরা এদের দেখতে না পেত, এদের কেউই আসলে বাঁচতো না এবং এই ঘটনার কথাও হয়তো আমরা জানতে পারতাম না।’
এই বেঁচে যাওয়া মানুষদের সামনে এখন তিনটি পথ খোলা আছে। তারা হয় নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে, অথবা জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার মাধ্যমে আশ্রয় চাইতে পারে। অথবা তিউনিসিয়াতেই তাদের ভাগ্য পরীক্ষা করতে পারে।
‘আমরা তো সবকিছু হারিয়েছি। আমার এখন কিছুই নেই’, বলছেন বিলাল। তিনি এখনো ইউরোপেই যেতে চান, যাতে করে সেখানে গিয়ে কিছু অর্থ উপার্জন করতে পারেন।
সূত্র : বিবিসি/এমআরএম/পিআর