মুমূর্ষু রোগীদের সর্বোচ্চ সুচিকিৎসার শেষ ভরসাস্থল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ)। তবে এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে সুচিকিৎসার এই শেষ ভরসাস্থলটি! আইসিইউ বিশেষজ্ঞদের মতে স্পর্শকাতর বিশেষায়িত এ চিকিৎসা সেবা চালু করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান এবং ল্যাবরেটরি সুযোগ-সুবিধা থাকা অত্যাবশ্যক। তবে জাগো নিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীসহ সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো প্রায় অর্ধশতাধিক আইসিইউ স্থাপিত হলেও ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা নেই অধিকাংশ আইসিইউতে।অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুমূর্ষু রোগীর জীবন-মরণের সঙ্গে সম্পর্কিত চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র আইসিইউ খোলার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয় না। এছাড়া কোন ধরনের রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি করতে হবে -এ সংক্রান্ত কোন আইন, নীতিমালা কিংবা গাইডলাইনও নেই। আর এ সুযোগে এক শ্রেণির মুনাফা লোভী ব্যবসায়ী স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের লাইসেন্স নিয়ে আইসিইউ খুলে বসছে।সম্প্রতি চার বছরের ছোট্ট শিশু সাদমান কেসপারের মৃত্যুর পর পেডিয়েট্রিক আইসিইউ সংকটের বিষয়টি সামনে ওঠে আসলে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদক সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে দেশে আইসিইউ সামগ্রিক চিকিৎসা সুবিধা সম্পর্কে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে অনুমতি ছাড়াই আইসিইউ খোলা যাওয়ার অবিশ্বাস্য এ তথ্যটি জানতে পারেন।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ থাকলেও মুমূর্ষু রোগীর সংখ্যার তুলনায় তা খুবই কম। ফলে অধিকাংশ রোগীকে নিরুপায় হয়ে প্রাইভেট হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। আর এ সুযোগে মোটা অঙ্কের কমিশন প্রদানের মাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতালের কর্মকর্তারা এক শ্রেণির অসৎ ডাক্তার, নার্স ও দালাল চক্রের সহায়তায় রোগীর অভিভাবকদের মানসিক দুর্বলতাকে পুঁজি করে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বহু সংখ্যক রোগীকে প্রাইভেট হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করানো হচ্ছে।জানা যায়, বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে ওঠা বড় বড় হাসপাতালে আইসিইউতে গড়ে প্রতিদিনের খরচ ৫০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা। মাঝারি মানের হাসপাতালে ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে এমন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা খরচ ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। এ বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করেও শেষ পর্যন্ত রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। ভুক্তভোগিরা বলছেন, এসব যাওয়ায় কিচিৎসা করানোর ফলে ভিটেমাটি জমিজমা বিক্রি করে সর্বশান্ত হচ্ছে গোটা পরিবার।ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, ১৮৫৪ সালে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের ধারণা শুরু করেন। ১৯৫০ সালে অ্যানেসথেসিওলজিস্ট পিটার সাফার ‘অ্যাডভান্সড সাপোর্ট অব লাইফ’ ধারণার চিকিৎসা শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে কোপেনহেগেনে পোলিও সংক্রমণ রোধে প্রথম আইসিইউ চিকিৎসা শুরু হয়।জানা গেছে, বাংলাদেশে ১৯৮০ সালে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে প্রথম আইসিইউ খোলা হয়। ১৯৮২ সালে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ), ১৯৮৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ১৯৯২ সালে বিএসএমএমইউ-তে আইসিইউ খোলা হয়।নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থিত একটি বেসরকারি হাসপাতালের পরিচালক জাগো নিউজকে বলেন, চিকিৎসা সেবা এখন ব্যবসা আর সেই ব্যবসার সবচেয়ে লাভজনক শাখা হলো ‘আইসিইউ’। হাসপাতালের অন্যান্য ওয়ার্ডে বেড খালি থাকতে পারে কিন্তু আইসিইউ’র বেড কখনও ফাঁকা থাকে না।তিনি আরো বলেন, রাজধানীসহ সারাদেশের আইসিইউ এখন মুমূর্ষু রোগীর মরণফাঁদ! স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রয়োজনীয় মনিটরিং ও সুপারভিশন সর্বোপরি আইসিইউ পরিচালনার নীতিমালা না থাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য মানহীন কথিত আইসিইউ গজিয়ে ওঠেছে। এসব কথিত আইসিইউতে ভর্তি হয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা-পয়সা খরচ করে সুচিকিৎসার অভাবে রোগীর মৃত্যু হয়, সর্বশান্ত হয় তার পরিবার।রাজধানীর লালবাগের বাসিন্দা আবদুল হাকিম জানান, তার বাবার বয়স ৬৫ বছর। সপ্তাহখানেক আগে তার বাবার হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেলে দ্রুত সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে ভর্তির পর পরই তাকে আইসিইউতে হস্তান্তর করেন চিকিৎসকরা। তিনদিন অবস্থানকালে বার বার রোগীর অবস্থা জানতে চাইলেও তাকে সুস্পষ্ট করে জানানো হয়নি। শুধু আল্লাহকে ডাকতে বলেছেন। পরে দেড় লাখ টাকা পরিশোধ করে হাসপাতাল থেকে বাবাকে রিলিজ করান।এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি আরো বলেন, বাবাকে নিয়ে খুব টেনশনে ছিলাম। বাবার কী হয়েছে তা জানতে চাওয়ার অধিকার আমাদের নেই।বর্তমানে রাজধানীসহ সারাদেশে উল্লেখযোগ্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে আইসিইউ চালু রয়েছে। সেগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা হলো- ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক), মিটফোর্ড, বিএসএমএমইউ, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, ইউনাইটেড, অ্যাপোলো, বারডেম, সিটি হাসপাতাল, শমরিতা, কমফোর্ট হাসপাতাল, ইসলামি ব্যাংক হাসপাতাল, সেন্ট্রাল হাসপাতাল, মর্ডান হাসপাতাল, গ্যাষ্ট্রো লিভার হাসপাতাল, রেনাল হাসপাতাল, মেট্রোপলিটন, পদ্মা জেনারেল, রেনেসা, জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ হাসপাতাল, রাশমনো, সাফেনা, কেয়ারল্যান্ড, নববজাতক, আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ, ল্যাবএইড হাসপাতাল, গ্রীণ লাইফ, ইবনে সিনা, নিরুপম হাসপাতাল, কেয়ার হাসপাতাল, হার্ট অ্যান্ড চেষ্ট, শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ, শিকদার মেডিকেল কলেজ, হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল, ইডেন মাল্টি কেয়ার, ফুয়াদ আল খতিব, মাকর্স হাসপাতাল, আল হেলাল, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, ডিফ্যাম হাসপাতাল, বিএমএসআরআই, আল আশরাফি হাসপাতাল, নর্দান হাসপাতাল, আমেরিকান হাসপাতাল, প্যাসেন্ট কেয়ার হাসপাতাল, ফরচুন হাসপাতাল, কমিউনিটি হাসপাতাল ও জাহানারা হাসপাতাল।স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মনিটরিং ও সুপারভিশনের অভাবে বিশেষায়িত সুযোগ-সুবিধা (চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান ও যন্ত্রপাতি) না থাকলেও হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভেদে বিভিন্ন নামের আইসিইউ- (নিওনেটাল, পেডিয়েট্রিক, স্পেশাল কেয়ার নার্সারি, সাইয়েট্রিক, করোনারি কেয়ার ইউনিট, কার্ডিওভাসকুলার, মেডিকেল সার্জিক্যাল, ওভারনাইট কেয়ার রিকভারি, নিউরো, নিউরোসায়েন্স, নিউরো ট্রমা, রেসপিরেটরি, ট্রমা নিউরো ক্রিটিক্যাল, জেরিয়েট্রিক ও মোবাইল) পরিচালিত হচ্ছে।ঢামেক হাসপাতালের অ্যানেসথেসিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবদুর রহমান বলেন, হাতে গোনা স্বল্প সংখ্যক ছাড়া রাজধানীসহ সারাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত অধিকাংশ হাসপাতালের আইসিইউ’র গুণমান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাদের অধিকাংশই সঠিক নিয়মনীতি মেনে চলছে না।তিনি আরো বলেন, আইসিইউ রোগীর জন্য প্রতিটি মিনিট ও সেকেন্ড অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। আইসিইউতে সার্বক্ষণিকভাবে যেসব চিকিৎসক ও নার্স কাজ করবে, তাদের অবশ্যই আইসিইউ রোগীদের চিকিৎসা প্রদানের ওপর বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। এছাড়া আইসিইউ রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে সার্বিক কার্যক্রম সার্বক্ষণিকভাবে তত্ত্বাবধান করতে হবে।অধ্যাপক ডা. আবদুর রহমান বলেন, আইসিইউ রোগীদের তিনটি ধাপ- নিবিড় পর্যবেক্ষণ, নিবিড় চিকিৎসা ও নিবিড় সেবা প্রদান করতে হয়। এক্ষেত্রে ব্যত্যয় হলে রোগীর মৃত্যু অবধারিত।নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর বাংলা মোটর এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তা জানান, বহু বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে সাধারণ এমবিবিএস ও নন-মেট্রিক অদক্ষ নার্স কাজ করেন। একজন দুজন কনসালটেন্ট সপ্তাহে ২/১ দিন অন-কলে আসেন।স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটি ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ ই মাহবুব জাগো নিউজকে বলেন, অধিকাংশ হাসপাতালের আইসিইউ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে। আইসিইউর মতো স্পর্শকাতর ইউনিট খুলতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমতি না লাগার বিষয়টি ভাবাই যায় না।যত্রতত্র আইসিইউ খুলে ব্যবসা বন্ধে অবিলম্বে আইন করা উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইসিইউ খোলার অনুমতি দেয়ার আগে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে আইসিইউ খোলার মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান এবং ল্যাবরেটরি সুযোগ সুবিধা রয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখতে হবে।# দেশের একটি সরকারি হাসপাতালেও পেডিয়েট্রিক আইসিইউ নেই# পিআইসিইউ চিকিৎসার নামে শিশুদের গিনিপিগ বানানো হচ্ছে!# পিআইসিইউ সংকটে জিবিএস আক্রান্ত শিশুর মৃত্যু-পঙ্গুত্ব বাড়ছেএমইউ/আরএস
Advertisement