রোহিঙ্গা সংকট নিরসন এবং প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের চতুর্থ বৈঠকেও মিয়ানমারের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাড়া পায়নি বাংলাদেশ। এসব বিষয়ে ঢাকার একাধিক প্রস্তাবেরও সুনির্দিষ্ট জবাব দেয়নি দেশটি।
Advertisement
সদ্য সমাপ্ত যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের চতুর্থ বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। গত ৩ মে মিয়ানমারের নেপিডোতে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো পরিবেশই আসলে মিয়ানমারে তৈরি হয়নি’ জাগো নিউজকে এমনটাই জানান বৈঠকে অংশ নেওয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এছাড়া বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কিছু প্রস্তাবও দেওয়া হয়। সেসব প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি নেপিডো।
সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য দেশটির সরকার কী কী করেছে এবং রাখাইনে ফেরার জন্য কতটুকু ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করেছে -এসব বিষয় দেখাতে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের প্রস্তাব দিয়েছে ঢাকা।
Advertisement
প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ছিল। কারণ, রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা সরেজমিন ঘুরে দেখলে তাদের আস্থা অর্জন সহজ হবে এবং তারা ফিরে এসে কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের বোঝাতে সক্ষম হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটি কম্প্রিহেনসিভ ডকুমেন্ট তৈরি করে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য যা যা করেছে তা তাদের সামনে উপস্থাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে এসব প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা কোনো জবাব দেয়নি।’
আরও পড়ুন > রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্বকে চাপ দেয়ার সময় এসেছে
এছাড়া আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব দেওয়া হলেও তাতে মিয়ানমার রাজি হয়নি বলে জানান বাংলাদেশের কর্মকর্তারা।
Advertisement
এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, নিজেদের পূর্বের অবস্থান থেকে এতটুকু সরে আসেনি মিয়ানমার। বস্তুত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের নামে সময়ক্ষেপণই করছে তারা। এমন অবস্থায় কূটনৈতিক জোর তৎপরতার মাধ্যমে দেশটির উপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট ধীরে ধীরে দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জের দিকে চলে যাচ্ছে। আমরা আশা করেছিলাম দ্রুত প্রত্যাবাসন হবে। তবে সেটা হচ্ছে না। মিয়ানমারের সদিচ্ছা এবং চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো প্রভাবশালী দেশগুলোও তাদেরকে অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।’
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে শুধু দ্বিপাক্ষিকভাবে নয়, চীন এবং ভারতের মতো প্রভাবশালী দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশকে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আসলে ফলপ্রসূ কোনো আলোচনাই আমরা দেখতে পাচ্ছি না।’
আরও পড়ুন > মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনায় ‘বডি ল্যাংগুয়েজ’ পরিবর্তন দরকার
এই গবেষক মনে করেন, ‘মিয়ানমারের উপর কোনো চাপই সৃষ্টি করতে পারছে না বাংলাদেশ।’ ড. ফাহমিদার মতে, ‘বিমসটেক, বিসিআইএম-এর মতো আঞ্চলিক এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মগুলো ব্যবহার করে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে।’
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনের একটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার ঘটনার জের ধরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতন শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। পাশাপাশি স্থানীয় মগরাও এতে অংশ নেয়। এসব নিপীড়ন থেকে প্রাণে বাঁচতে সাড়ে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এছাড়া এর আগে থেকে আরও প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে বসবাস করছিল।
চলমান এই সংকট নিরসনে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। ওই চুক্তি অনুযায়ী, সে বছরের ১৯ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ঢাকা-নেপিডোর মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর ও ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের ফেরত নেবে মিয়ানমার। চুক্তি সইয়ের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াও শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে সে চুক্তির দেড় বছর পার হলেও একজন রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবাসন করানো সম্ভব হয়নি। নানা অজুহাতে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি এড়িয়ে গেছে দেশটি।
জেপি/আরএস/জেআইএম